ওদের সাথে মেলাও যারা চরায় তোমার ধেনু
ওদের সাথে মেলাও যারা চরায় তোমার ধেনু,
তোমার নামে বাজায় যারা বেণু ॥
পাষাণ দিয়ে বাঁধা ঘাটে এই-যে কোলাহলের হাটে
কেন আমি কিসের লোভে এনু ॥
কী ডাক ডাকে বনের পাতাগুলি, কার ইশারা-তৃণের অঙ্গুলি!
প্রাণেশ আমার লীলাভরে খেলেন প্রাণের খেলাঘরে,
পাখির মুখে এই-যে খবর পেনু ॥
ওরে পথিক, ওরে প্রেমিক
ওরে পথিক, ওরে প্রেমিক,
বিচ্ছেদে তোর খণ্ড মিলন পূর্ণ হবে।
আয় রে সবে
প্রলয়গানের মহোৎসবে॥
তাণ্ডবে ওই তপ্ত হাওয়ায় ঘূর্ণি লাগায়,
মত্ত ঈশান বাজায় বিষাণ, শঙ্কা জাগায়–
ঝঙ্কারিয়া উঠল আকাশ ঝঞ্ঝারবে॥
ভাঙন-ধরার ছিন্ন-করার রুদ্র নাটে
যখন সকল ছন্দ বিকল, বন্ধ কাটে,
মুক্তিপাগল বৈরাগীদের চিত্ততলে
প্রেমসাধনার হোমহুতাশন জ্বলবে তবে।
ওরে পথিক, ওরে প্রেমিক,
সব আশাজাল যায় রে যখন উড়ে পুড়ে
আশার অতীত দাঁড়ায় তখন ভুবন জুড়ে–
স্তব্ধ বাণী নীরব সুরে কথা কবে।
আয় রে সবে
প্রলয়গানের মহোৎসবে॥
ওরে ভীরু, তোমার হাতে নাই ভূবনের ভার
ওরে ভীরু, তোমার হাতে নাই ভূবনের ভার।
হালের কাছে মাঝি আছে, করবে তরী পার ॥
তুফান যদি এসে থাকে তোমার কিসের দায়–
চেয়ে দেখো ঢেউয়ের খেলা, কাজ কি ভাবনায়?
আসুক-নাকো গহন রাতি, হোক-না অন্ধকার–
হালের কাছে মাঝি আছে, করবে তরী পার ॥
পশ্চিমে তুই তাকিয়ে দেখিস মেঘে আকাশ ডোবা,
আনন্দে তুই পুবের দিকে দেখ্-না তারার শোভা।
সাথি যারা আছে তারা তোমার আপন ব’লে
ভাবো কি তাই রক্ষা পাবে তোমারি ওই কোলে?
উঠবে রে ঝড়, দুলবে রে বুক, জাগবে হাহাকার–
হালের কাছে মাঝি আছে, করবে তরী পার ॥
ওরে, আগুন আমার ভাই
ওরে, আগুন আমার ভাই,
আমি তোমারই জয় গাই।
তোমার ওই শিকল-ভাঙা এমন রাঙা মূর্তি দেখি নাই॥
তুমি দু হাত তুলে আকাশ-পানে মেতেছ আজ কিসের গানে,
একি আনন্দময় নৃত্য অভয় বলিহারি যাই॥
যেদিন ভবের মেয়াদ ফুরোবে ভাই, আগল যাবে সরে–
সেদিন হাতের দড়ি, পায়ের বেড়ি, দিবি রে ছাই করে।
সেদিন আমার অঙ্গ তোমার অঙ্গে ওই নাচনে নাচবে রঙ্গে–
সকল দাহ মিটবে দাহে, ঘুচবে সব বালাই॥
ওরে, কে রে এমন জাগায় তোকে
ওরে, কে রে এমন জাগায় তোকে?
ঘুম কেন নেই তোরই চোখে?
চেয়ে আছিস আপন-মনে– ওই-যে দূরে গগন-কোণে
রাত্রি মেলে রাঙা নয়ন রুদ্রদেবের দীপ্তালোকে ॥
রক্তশতদলের সাজি
সাজিয়ে কেন রাখিস আজি?
কোন্ সাহসে একেবারে শিকল খুলে দিলি দ্বারে–
জোড়হাতে তুই ডাকিস কারে, প্রলয় যে তোর ঘরে ঢোকে ॥
ওরে, তোরা যারা শুনবি না
ওরে, তোরা যারা শুনবি না
তোদের তরে আকাশ- ‘পরে নিত্য বাজে কোন্ বীণা ॥
দূরের শঙ্খ উঠল বেজে, পথে বাহির হল সে যে,
দুয়ারে তোর আসবে কবে তার লাগি দিন গুনবি না?।
রাতগুলো যায় হায় রে বৃথায়, দিনগুলো যায় ভেসে–
মনে আশা রাখবি না কি মিলন হবে শেষে?
হয়তো দিনের দেরি আছে, হয়তো সে দিন আস্ল কাছে–
মিলনরাতে ফুটবে যে ফুল তার কি রে বীজ বুনবি না?।
ওহে সুন্দর, মরি মরি
ওহে সুন্দর, মরি মরি,
তোমায় কী দিয়ে বরণ করি॥
তব ফাল্গুন যেন আসে
আজি মোর পরানের পাশে,
দেয় সুধারসধারে-ধারে
মম অঞ্জলি ভরি ভরি॥
মধু সমীর দিগঞ্চলে
আনে পুলকপূজাঞ্জলি–
মম হৃদয়ের পথতলে
যেন চঞ্চল আসে চলি।
মম মনের বনের শাখে
যেন নিখিল কোকিল ডাকে,
যেন মঞ্জরীদীপশিখা
নীল অম্বরে রাখে ধরি॥
ওহে জীবনবল্লভ, ওহে সাধনদুর্লভ
ওহে জীবনবল্লভ, ওহে সাধনদুর্লভ,
আমি মর্মের কথা অন্তরব্যথা কিছুই নাহি কব–
শুধু জীবন মন চরণে দিনু বুঝিয়া লহো সব।
আমি কী আর কব ॥
এই সংসারপথসঙ্কট অতি কণ্টকময় হে,
আমি নীরবে যাব হৃদয়ে লয়ে প্রেমমুরতি তব।
আমি কী আর কব ॥
সুখ দুখ সব তুচ্ছ করিনু প্রিয় অপ্রিয় হে–
তুমি নিজ হাতে যাহা সঁপিবে তাহা মাথায় তুলিয়া লব।
আমি কী আর কব ॥
অপরাধ যদি ক’রে থাকি পদে, না করো যদি ক্ষমা,
তবে পরানপ্রিয়, দিয়ো হে দিয়ো বেদনা নব নব।
তবু ফেলো না দূরে, দিবসশেষে ডেকে নিয়ো চরণে–
তুমি ছাড়া আর কী আছে আমার মৃত্যু-আঁধার ভব।
আমি কী আর কব ॥
কণ্ঠে নিলেম গান
কণ্ঠে নিলেম গান, আমার শেষ পারানির কড়ি–
একলা ঘাটে রইব না গো পড়ি ॥
আমার সুরের রসিক নেয়ে
তারে ভোলাব গান গেয়ে,
পারের খেয়ায় সেই ভরসায় চড়ি ॥
পার হব কি নাই হব তার খবর কে রাখে–
দূরের হাওয়ায় ডাক দিল এই সুরের পাগলাকে।
ওগো তোমরা মিছে ভাব’,
আমি যাবই যাবই যাব–
ভাঙল দুয়ার, কাটল দড়াদড়ি ॥
কত অজানারে জানাইলে তুমি
কত অজানারে জানাইলে তুমি, কত ঘরে দিলে ঠাঁই–
দূরকে করিলে নিকট, বন্ধু, পরকে করিলে ভাই॥
পুরানো আবাস ছেড়ে যাই যবে মনে ভেবে মরি কী জানি কী হবে,
নূতনের মাঝে তুমি পুরাতন সে কথা যে ভুলে যাই॥
জীবনে মরণে নিখিল ভুবনে যখনি যেখানে লবে
চিরজনমের পরিচিত ওহে তুমিই চিনাবে সবে।
তোমারে জানিলে নাহি কেহ পর, নাহি কোনো মানা, নাহি কোনো ডর–
সবারে মিলায়ে তুমি জাগিতেছ দেখা যেন সদা পাই॥
কবে আমি বাহির হলেম তোমারি গান গেয়ে
কবে আমি বাহির হলেম তোমারি গান গেয়ে–
সে তো আজকে নয় সে আজকে নয়।
ভুলে গেছি কবে থেকে আসছি তোমায় চেয়ে
সে তো আজকে নয় সে আজকে নয়।
ঝরনা যেমন বাহিরে যায়, জানে না সে কাহারে চায়,
তেমনি করে ধেয়ে এলেম জীবনধারা বেয়ে–
সে তো আজকে নয় সে আজকে নয়।
কতই নামে ডেকেছি যে, কতই ছবি এঁকেছি যে,
কোন্ আনন্দে চলেছি, তার ঠিকানা না পেয়ে–
সে তো আজকে নয় সে আজকে নয়।
পুষ্প যেমন আলোর লাগি না জেনে রাত কাটায় জাগি,
তেমনি তোমার আশায় আমার হৃদয় আছে ছেয়ে–
সে তো আজকে নয় সে আজকে নয়॥