এখনো গেল না আঁধার
এখনো গেল না আঁধার, এখনো রহিল বাধা।
এখনো মরণ-ব্রত জীবনে হল না সাধা।
কবে যে দুঃখজ্বালা হবে রে বিজয়মালা,
ঝলিবে অরুণরাগে নিশীথরাতের কাঁদা॥
এখনো নিজেরি ছায়া রচিছে কত যে মায়া।
এখনো কেন যে মিছে চাহিছে কেবলি পিছে,
চকিতে বিজলি আলো চোখেতে লাগাল ধাঁদা॥
এখনো ঘোর ভাঙে না তোর যে, মেলে না তোর আঁখি
এখনো ঘোর ভাঙে না তোর যে, মেলে না তোর আঁখি,
কাঁটার বনে ফুল ফুটেছে রে জানিস নে তুই তা কি।
ওরে অলস, জানিস নে তুই তা কি?
জাগো এবার জাগো, বেলা কাটাস না গো॥
কঠিন পথের শেষে কোথায় অগম বিজন দেশে
ও সেই বন্ধু আমার একলা আছে গো, দিস নে তারে ফাঁকি॥
প্রথম রবির তাপে নাহয় শুষ্ক গগন কাঁপে,
নাহয় দগ্ধ বালু তপ্ত আঁচলে দিক চারি দিক ঢাকি–
পিপাসাতে দিক চারি দিক ঢাকি।
মনের মাঝে চাহি দেখ্ রে আনন্দ কি নাহি।
পথে পায়ে পায়ে দুখের বাঁশরি বাজবে তোরে ডাকি–
মধুর সুরে বাজবে তোরে ডাকি॥
এত আনন্দধ্বনি উঠিল কোথায়
এত আনন্দধ্বনি উঠিল কোথায়,
জগতপুরবাসী সবে কোথায় ধায় ॥
কোন্ অমৃতধনের পেয়েছে সন্ধান,
কোন্ সুধা করে পান!
কোন্ আলোকে আঁধার দূরে যায় ॥
এত আলো জ্বালিয়েছ এই গগনে
এত আলো জ্বালিয়েছ এই গগনে
কী উৎসবের লগনে॥
সব আলোটি কেমন ক’রে ফেল আমার মুখের ‘পরে,
তুমি আপনি থাকো আলোর পিছনে ॥
প্রেমটি যেদিন জ্বালি হৃদয়-গগনে
কী উৎসবের লগনে
সব আলো তার কেমন ক’রে পড়ে তোমার মুখের ‘পরে,
আমি আপনি পড়ি আলোর পিছনে ॥
এবার দুঃখ আমার অসীম পাথার পার হল যে, পার হল
এবার দুঃখ আমার অসীম পাথার পার হল যে, পার হল।
তোমার পায়ে এসে ঠেকল শেষে, সকল সুখের সার হল ॥
এত দিন নয়নধারা বয়েছে বাঁধনহারা,
কেন বয় পাই নি যে তার কূলকিনারা–
আজ গাঁথল কে সেই অশ্রুমালা, তোমার গলার হার হল ॥
তোমার সাঁঝের তারা ডাকল আমায় যখন অন্ধকার হল।
বিরহের ব্যথাখানি খুঁজে তো পায় নি বাণী,
এত দিন নীরব ছিল শরম মানি–
আজ পরশ পেয়ে উঠল গেয়ে, তোমার বীণার তার হল ॥
এবার রঙিয়ে গেল হৃদয়গগন সাঁঝের রঙে
এবার রঙিয়ে গেল হৃদয়গগন সাঁঝের রঙে।
আমার সকল বাণী হল মগন সাঁঝের রঙে॥
মনে লাগে দিনের পরে পথিক এবার আসবে ঘরে,
আমার পূর্ণ হবে পুণ্যলগন সাঁঝের রঙে॥
অস্তাচলের সাগরকূলের এই বাতাসে
ক্ষণে ক্ষণে চক্ষে আমার তন্দ্রা আসে।
সন্ধ্যাযূথীর গন্ধভারে পান্থ যখন আসবে দ্বারে
আমার আপনি হবে নিদ্রাভগন সাঁঝের রঙে॥
এবার নীরব করে দাও হে তোমার মুখর কবিরে
এবার নীরব করে দাও হে তোমার মুখর কবিরে।
তার হৃদয়-বাঁশি আপনি কেড়ে বাজাও গভীরে॥
নিশীথরাতের নিবিড় সুরে বাঁশিতে তান দাও হে পুরে
যে তান দিয়ে অবাক কর’ গ্রহশশীরে॥
যা-কিছু মোর ছড়িয়ে আছে জীবন-মরণে,
গানের টানে মিলুক এসে তোমার চরণে।
বহুদিনের বাক্যরাশি এক নিমেষে যাবে ভাসি–
একলা বসে শুনব বাঁশি অকূল তিমিরে॥
এবার আমায় ডাকলে দূরে
এবার আমায় ডাকলে দূরে
সাগর-পারের গোপন পুরে॥
বোঝা আমার নামিয়েছি যে, সঙ্গে আমায় নাও গো নিজে,
স্তব্ধ রাতের স্নিগ্ধ সুধা পান করাবে তৃষ্ণাতুরে॥
আমার সন্ধ্যাফুলের মধু
এবার যে ভোগ করবে বঁধু।
তারার আলোর প্রদীপখানি প্রাণে আমার জ্বালবে আনি,
আমার যত কথা ছিল ভেসে যাবে তোমার সুরে॥
এমনি করে ঘুরিব দূরে বাহিরে
এমনি করে ঘুরিব দূরে বাহিরে,
আর তো গতি নাহি রে মোর নাহি রে ॥
যে পথে তব রথের রেখা ধরিয়া
আপনা হতে কুসুম উঠে ভরিয়া,
চন্দ্র ছুটে, সূর্য ছুটে, সে পথতলে পড়িব লুটে–
সবার পানে রহিব শুধু চাহি রে ॥
তোমার ছায়া পড়ে যে সরোবরে গো
কমল সেথা ধরে না, নাহি ধরে গো।
জলের ঢেউ তরল তানেসে ছায়া লয়ে মাতিল গানে,
ঘিরিয়া তারে ফিরিব তরী বাহি রে।
যে বাঁশিখানি বাজিছে তব ভবনে
সহসা তাহা শুনিব মধু পবনে।
তাকায়ে রব দ্বারের পানে, সে তানখানি লইয়া কানে
বাজায়ে বীণা বেড়াব গান গাহি রে ॥
এরে ভিখারি সাজায়ে কী রঙ্গ তুমি করিলে
এরে ভিখারি সাজায়ে কী রঙ্গ তুমি করিলে,
হাসিতে আকাশ ভরিলে ॥
পথে পথে ফেরে, দ্বারে দ্বারে যায়, ঝুলি ভরি রাখে যাহা-কিছু পায়–
কতবার তুমি পথে এসে, হায়, ভিক্ষার ধন হরিলে ॥
ভেবেছিল চির-কাঙাল সে এই ভুবনে, কাঙাল মরণে জীবনে।
ওগো মহারাজা, বড়ো ভয়ে ভয়ে দিনশেষে এল তোমারি আলয়ে–
আধেক আসনে তারে ডেকে লয়ে নিজ মালা দিয়ে বরিলে ॥
এসেছে সকলে কত আশে দেখো চেয়ে
এসেছে সকলে কত আশে দেখো চেয়ে–
হে প্রাণেশ, ডাকে সবে ওই তোমারে ॥
এসো হে মাঝে এসো, কাছে এসো,
তোমায় ঘিরিব চারি ধারে ॥
উৎসবে মাতিব হে তোমায় লয়ে,
ডুবিব আনন্দ-পারাবারে ॥
ও অকূলের কূল ও অগতির গতি
ও অকূলের কূল, ও অগতির গতি,
ও অনাথের নাথ, ও পতিতের পতি।
ও নয়নের আলো, ও রসনার মধু,
ও রতনের হার, ও পরানের বঁধু।
ও অপরূপ রূপ, ও মনোহর কথা,
ও চরমের সুখ, ও মরমের ব্যথা।
ও ভিখারির ধন, ও অবোলার বোল–
ও জনমের দোলা, ও মরণের কোল ॥
ও নিঠুর, আরো কি বাণ তোমার তূণে আছে
ও নিঠুর, আরো কি বাণ তোমার তূণে আছে?
তুমি মর্মে আমায় মারবে হিয়ার কাছে ॥
আমি পালিয়ে থাকি, মুদি আঁখি, আঁচল দিয়ে মুখ যে ঢাকি গো–
কোথাও কিছু আঘাত লাগে পাছে ॥
আমি মারকে তোমার ভয় করেছি ব’লে
তাই তো এমন হৃদয় ওঠে জ্বলে।
যে দিন সে ভয় ঘুচে যাবে সে দিন তোমার বাণ ফুরাবে গো–
মরণকে প্রাণ বরণ করে বাঁচে ॥