এই করেছ ভালো নিঠুর
এই করেছ ভালো, নিঠুর,
এই করেছ ভালো।
এমনি করে হৃদয়ে মোর
তীব্র দহন জ্বালো।
আমার এ ধূপ না পোড়ালে
গন্ধ কিছুই নাহি ঢালে,
আমার এ দীপ না জ্বালালে
দেয় না কিছুই আলো।
যখন থাকে অচেতনে
এ চিত্ত আমার
আঘাত সে যে পরশ তব
সেই তো পুরস্কার।
অন্ধকারে মোহে লাজে
চোখে তোমায় দেখি না যে,
বজ্রে তোলো আগুন করে
আমার যত কালো।
এই তো তোমার আলোকধেনু সূর্য তারা দলে দলে
এই তো তোমার আলোকধেনু সূর্য তারা দলে দলে–
কোথায় ব’সে বাজাও বেণু, চরাও মহাগগনতলে॥
তৃণের সারি তুলছে মাথা, তরুর শাখে শ্যামল পাতা–
আলোয়-চরা ধেনু এরা ভিড় করেছে ফুলে ফলে॥
সকালবেলা দূরে দূরে উড়িয়ে ধূলি কোথায় ছোটে,
আঁধার হলে সাঁঝের সুরে ফিরিয়ে আনে আপন গোঠে।
আশা তৃষা আমার যত ঘুরে বেড়ায় কোথায় কত–
মোর জীবনের রাখাল ওগো, ডাক দেবে কি সন্ধ্যা হলে ?।
এই লভিনু সঙ্গ তব, সুন্দর হে সুন্দর
এই লভিনু সঙ্গ তব, সুন্দর হে সুন্দর !
পুণ্য হল অঙ্গ মম, ধন্য হল অন্তর সুন্দর হে সুন্দর॥
আলোকে মোর চক্ষুদুটি মুগ্ধ হয়ে উঠল ফুটি,
হৃদ্গগনে পবন হল সৌরভেতে মন্থর সুন্দর হে সুন্দর॥
এই তোমারি পরশরাগে চিত্ত হল রঞ্জিত,
এই তোমারি মিলনসুধা রইল প্রাণে সঞ্চিত।
তোমার মাঝে এমনি ক’রে নবীন করি লও যে মোরে
এই জনমে ঘটালে মোর জন্ম-জনমান্তর সুন্দর হে সুন্দর॥
এই-যে কালো মাটির বাসা শ্যামল সুখের ধরা
এই-যে কালো মাটির বাসা শ্যামল সুখের ধরা–
এইখানেতে আঁধার-আলোয় স্বপন-মাঝে চরা ॥
এরই গোপন হৃদয় ‘পরে ব্যথার স্বর্গ বিরাজ করে
দুঃখে-আলো-করা ॥
বিরহী তোর সেইখানে যে একলা বসে থাকে–
হৃদয় তাহার ক্ষণে ক্ষণে নামটি তোমার ডাকে।
দুঃখে যখন মিলন হবে আনন্দলোক মিলবে তবে
সুধায়-সুধায়-ভরা ॥
এই-যে তোমার প্রেম, ওগো হৃদয়হরণ
এই-যে তোমার প্রেম, ওগো হৃদয়হরণ,
এই-যে পাতায় আলো নাচে সোনার বরন॥
এই-যে মধুর আলসভরে মেঘ ভেসে যায় আকাশ ’পরে,
এই-যে বাতাস দেহে করে অমৃতক্ষরণ॥
প্রভাত-আলোর ধারায় আমার নয়ন ভেসেছে।
এই তোমারি প্রেমের বাণী প্রাণে এসেছে।
তোমারি ওই মুখ নুয়েছে, মুখে আমার চোখ থুয়েছে,
আমার হৃদয় আজ ছুঁয়েছে তোমারি চরণ॥
এক হাতে ওর কৃপাণ আছে, আর-এক হাতে হার
এক হাতে ওর কৃপাণ আছে, আর-এক হাতে হার।
ও যে ভেঙেছে তোর দ্বার॥
আসে নি ও ভিক্ষা নিতে, না না না– লড়াই করে নেবে জিতে
পরানটি তোমার ॥
মরণেরই পথ দিয়ে ওই আসছে জীবন-মাঝে,
ও যে আসছে বীরের সাজে।
আধেক নিয়ে ফিরবে না রে, না না না– যা আছে সব একেবারে
করবে অধিকার ॥
একটি নমস্কারে, প্রভু, একটি নমস্কারে
একটি নমস্কারে, প্রভু, একটি নমস্কারে
সকল দেহ লুটিয়ে পড়ুক তোমার এ সংসারে॥
ঘন শ্রাবণমেঘের মতো রসের ভারে নম্র নত
একটি নমস্কারে, প্রভু, একটি নমস্কারে
সমস্ত মন পড়িয়া থাক্ তব ভবনদ্বারে॥
নানা সুরের আকুল ধারা মিলিয়ে দিয়ে আত্মহারা
একটি নমস্কারে, প্রভু, একটি নমস্কারে
সমস্ত গান সমাপ্ত হোক নীরব পারাবারে।
হংস যেমন মানসযাত্রী তেমনি সারা দিবসরাত্রি
একটি নমস্কারে, প্রভু, একটি নমস্কারে
সমস্ত প্রাণ উড়ে চলুক মহামরণ-পারে॥
একমনে তোর একতারাতে একটি যে তার সেইটি বাজা
একমনে তোর একতারাতে একটি যে তার সেইটি বাজা–
ফুলবনে তোর একটি কুসুম, তাই নিয়ে তোর ডালি সাজা ॥
যেখানে তোর সীমা সেথায় আনন্দে তুই থামিস এসে,
যে কড়ি তোর প্রভুর দেওয়া সেই কড়ি তুই নিস রে হেসে।
লোকের কথা নিস নে কানে, ফিরিস নে আর হাজার টানে,
যেন রে তোর হৃদয় জানে হৃদয়ে তোর আছেন রাজা–
একতারাতে একটি যে তার আপন-মনে সেইটি বাজা ॥
একি এ সুন্দর শোভা ! কী মুখ হেরি এ
একি এ সুন্দর শোভা ! কী মুখ হেরি এ !
আজি মোর ঘরে আইল হৃদয়নাথ,
প্রেম-উৎস উথলিল আজি॥
বলো হে প্রেমময় হৃদয়ের স্বামী,
কী ধন তোমারে দিব উপহার।
হৃদয় প্রাণ লহো লহো তুমি, কী বলিব–
যাহা-কিছু আছে মম সকলই লও হে নাথ॥
একি করুণা করুণাময়
একি করুণা করুণাময়!
হৃদয়শতদল উঠিল ফুটি অমল কিরণে তব পদতলে ॥
অন্তরে বাহিরে হেরিনু তোমারে লোকে লোকে লোকান্তরে–
আঁধারে আলোকে সুখে দুখে, হেরিনু হে
স্নেহে প্রেমে জগতময় চিত্তময় ॥
একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ, প্রাণেশ হে
একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ, প্রাণেশ হে,
আনন্দবসন্তসমাগমে॥
বিকশিত প্রীতিকুসুম হে
পুলকিত চিতকাননে॥
জীবনলতা অবনতা তব চরণে।
হরষগীত উচ্ছসিত হে
কিরণমগন গগনে॥
একি সুগন্ধহিল্লোল বহিল
একি সুগন্ধহিল্লোল বহিল
আজি প্রভাতে, জগত মাতিল তায়॥
হৃদয়মধুকর ধাইছে দিশি দিশি পাগলপ্রায়॥
বরন-বরন পুষ্পরাজি হৃদয় খুলিয়াছে আজি,
সেই সুরভিসুধা করিছে পান
পূরিয়া প্রাণ, সে সুধা করিছে দান–
সে সুধা অনিলে উথলি যায়॥
এখন আমার সময় হল
এখন আমার সময় হল,
যাবার দুয়ার খোলো খোলো॥
হল দেখা, হল মেলা, আলোছায়ায় হল খেলা–
স্বপন যে সে ভোলো ভোলো॥
আকাশ ভরে দূরের গানে,
অলখ দেশে হৃদয় টানে।
ওগো সুদূর, ওগো মধুর, পথ বলে দাও পরানবঁধুর–
সব আবরণ তোলো তোলো॥
এখনো আঁধার রয়েছে হে নাথ
এখনো আঁধার রয়েছে হে নাথ–
এ প্রাণ দীন মলিন, চিত অধীর,
সব শূন্যময় ॥
চারি দিকে চাহি, পথ নাহি নাহি–
শান্তি কোথা, কোথা আলয়?
কোথা তাপহারী পিপাসার বারি–
হৃদয়ের চির-আশ্রয়?।