ইচ্ছা যবে হবে লইয়ো পারে
ইচ্ছা যবে হবে লইয়ো পারে,
পূজাকুসুমে রচিয়া অঞ্জলি
আছি ব’সে ভবসিন্ধু-কিনারে ॥
যত দিন রাখ তোমা মুখ চাহি
ফুল্লমনে রব এ সংসারে ॥
ডাকিবে যখনি তোমার সেবকে
দ্রুত চলি যাইব ছাড়ি সবারে ॥
উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে
উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে
ওই-যে তিনি, ওই-যে বাহির পথে ॥
আয় রে ছুটে, টানতে হবে রশি–
ঘরের কোণে রইলি কোথায় বসি!
ভিড়ের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে গিয়ে
ঠাঁই ক’রে তুই নে রে কোনোমতে ॥
কোথায় কী তোর আছে ঘরের কাজ
সে-সব কথা ভুলতে হবে আজ।
টান্ রে দিয়ে সকল চিত্তকায়া,
টান্ রে ছেড়ে তুচ্ছ প্রাণের মায়া,
চল্ রে টেনে আলোয় অন্ধকারে
নগর-গ্রামে অরণ্যে পর্বতে ॥
ওই-যে চাকা ঘুরছে রে ঝন্ঝনি,
বুকের মাঝে শুনছ কি সেই ধ্বনি?
রক্তে তোমার দুলছে না কি প্রাণ?
গাইছে না মন মরণজয়ী গান?
আকাঙক্ষা তোর বন্যাবেগের মতো
ছুটছে না কি বিপুল ভবিষ্যতে?।
এ অন্ধকার ডুবাও তোমার অতল অন্ধকারে
এ অন্ধকার ডুবাও তোমার অতল অন্ধকারে
ওহে অন্ধকারের স্বামী।
এসো নিবিড়, এসো গভীর, এসো জীবন-পারে
আমার চিত্তে এসো নামি।
এ দেহ মন মিলায়ে যাক, হইয়া যাক হারা
ওহে অন্ধকারের স্বামী।
বাসনা মোর, বিকৃতি মোর, আমার ইচ্ছাধারা
ওই চরণে যাক থামি।
নির্বাসনে বাঁধা আছি দুর্বাসনার ডোরে
ওহে অন্ধকারের স্বামী।
সব বাঁধনে তোমার সাথে বন্দী করো মোরে–
ওহে, আমি বাঁধন-কামী।
আমার প্রিয়, আমার শ্রেয়, আমার হে পরম,
ওহে অন্ধকারের স্বামী,
সকল ঝ’রে সকল ভ’রে আসুক সে চরম–
ওগো, মরুক-না এই আমি ॥
এ আবরণ ক্ষয় হবে গো ক্ষয় হবে
এ আবরণ ক্ষয় হবে গো ক্ষয় হবে,
এ দেহমন ভূমানন্দময় হবে ॥
চক্ষে আমার মায়ার ছায়া টুটবে গো,
বিশ্বকমল প্রাণে আমার ফুটবে গো,
এ জীবনে তোমারি, নাথ, জয় হবে ॥
রক্ত আমার বিশ্বতালে নাচবে যে,
হৃদয় আমার বিপুল প্রাণে বাঁচবে যে,
কাঁপবে তোমার আলো-বীণার তারে সে,
দুলবে তোমার তারামণির হারে সে,
বাসনা তার ছড়িয়ে গিয়ে লয় হবে ॥
এ দিন আজি কোন্ ঘরে গো খুলে দিল দ্বার
এ দিন আজি কোন্ ঘরে গো খুলে দিল দ্বার?
আজি প্রাতে সূর্য ওঠা সফল হল কার?।
কাহার অভিষেকের তরে সোনার ঘটে আলোক ভরে,
উষা কাহার আশিস বহি হল আঁধার পার?।
বনে বনে ফুল ফুটেছে, দোলে নবীন পাতা–
কার হৃদয়ের মাঝে হল তাদের মালা গাঁথা?
বহু যুগের উপহারে বরণ করি নিল কারে,
কার জীবনে প্রভাত আজি ঘুচায় অন্ধকার?।
এ পথ গেছে কোন্খানে গো কোন্খানে
এ পথ গেছে কোন্খানে গো কোন্খানে–
তা কে জানে তা কে জানে ॥
কোন্ পাহাড়ের পারে, কোন্ সাগরের ধারে,
কোন্ দুরাশায় দিক-পানে–
তা কে জানে তা কে জানে ॥
এ পথ দিয়ে কে আসে যায় কোন্খানে
তা কে জানে তা কে জানে।
কেমন যে তার বাণী, কেমন হাসিখানি,
যায় সে কাহার সন্ধানে–
তা কে জানে তা কে জানে ॥
এ পরবাসে রবে কে হায়
এ পরবাসে রবে কে হায়!
কে রবে এ সংশয়ে সন্তাপে শোকে ॥
হেথা কে রাখিবে দুখভয়সঙ্কটে–
তেমন আপন কেহ নাহি এ প্রান্তরে হায় রে ॥
এ মণিহার আমায় নাহি সাজে
এ মণিহার আমায় নাহি সাজে–
এরে পরতে গেলে লাগে, এরে ছিঁড়তে গেলে বাজে ॥
কণ্ঠ যে রোধ করে, সুর তো নাহি সরে–
ওই দিকে যে মন পড়ে রয়, মন লাগে না কাজে ॥
তাই তো বসে আছি,
এ হার তোমায় পরাই যদি তবেই আমি বাঁচি।
ফুলমালার ডোরে বরিয়া লও মোরে–
তোমার কাছে দেখাই নে মুখ মণিমালার লাজে ॥
এ মোহ-আবরণ খুলে দাও, দাও হে
এ মোহ-আবরণ খুলে দাও, দাও হে ॥
সুন্দর মুখ তব দেখি নয়ন ভরি,
চাও হৃদয়মাঝে চাও হে ॥
এ যে মোর আবরণ
এ যে মোর আবরণ
ঘুচাতে কতক্ষণ!
নিশ্বাসবায় উড়ে চলে যায়
তুমি কর যদি মন॥
যদি পড়ে থাকি ভূমে
ধূলার ধরণী চুমে,
তুমি তারি লাগি দ্বারে রবে জাগি
এ কেমন তব পণ॥
রথের চাকার রবে
জাগাও জাগাও সবে,
আপনার ঘরে এসো বলভরে
এসো এসো গৌরবে।
ঘুম টুটে যাক চলে,
চিনি যেন প্রভু ব’লে–
ছুটে এসে দ্বারে করি আপনারে
চরণে সমর্পণ ॥
এই মলিন বস্ত্র ছাড়তে হবে
এই মলিন বস্ত্র ছাড়তে হবে, হবে গো এইবার–
আমার এই মলিন অহংকার॥
দিনের কাজে ধুলা লাগি অনেক দাগে হল দাগি,
এমনি তপ্ত হয়ে আছে সহ্য করা ভার।
আমার এই মলিন অহংকার॥
এখন তো কাজ সাঙ্গ হল দিনের অবসানে–
হল রে তাঁর আসার সময়, আশা এল প্রাণে।
স্নান করে আয় এখন তবে প্রেমের বসন পরতে হবে,
সন্ধ্যাবনের কুসুম তুলে গাঁথতে হবে হার।
ওরে আয়, সময় নেই যে আর॥
এই আসা-যাওয়ার খেয়ার কূলে আমার বাড়ি
এই আসা-যাওয়ার খেয়ার কূলে আমার বাড়ি।
কেউ বা আসে এ পারে, কেউ পারের ঘাটে দেয় রে পাড়ি॥
পথিকেরা বাঁশি ভ’রে যে সুর আনে সঙ্গে ক’রে
তাই যে আমার দিবানিশি সকল পরান লয় রে কাড়ি॥
কার কথা যে জানায় তারা জানি নে তা,
হেথা হতে কী নিয়ে বা যায় রে সেথা।
সুরের সাথে মিশিয়ে বাণী দুই পারের এই কানাকানি,
তাই শুনে যে উদাস হিয়া চায় রে যেতে বাসা ছাড়ি॥
এই কথাটা ধরে রাখিস– মুক্তি তোরে পেতেই হবে
এই কথাটা ধরে রাখিস– মুক্তি তোরে পেতেই হবে।
যে পথ গেছে পারের পানে সে পথে তোর যেতেই হবে ॥
অভয় মনে কণ্ঠ ছাড়ি গান গেয়ে তুই দিবি পাড়ি,
খুশি হয়ে ঝড়ের হাওয়ায় ঢেউ যে তোরে খেতেই হবে।
পাকের ঘোরে ঘোরায় যদি, ছুটি তোরে পেতেই হবে।
চলার পথে কাঁটা থাকে, দ’লে তোমায় যেতেই হবে।
সুখের আশা আঁকড়ে লয়ে মরিস নে তুই ভয়ে ভয়ে,
জীবনকে তোর ভ’রে নিতে মরণ-আঘাত খেতেই হবে ॥