আমি হেথায় থাকি শুধু গাইতে তোমার গান
আমি হেথায় থাকি শুধু গাইতে তোমার গান,
দিয়ো তোমার জগত্-সভায় এইটুকু মোর স্থান॥
আমি তোমার ভুবন-মাঝে লাগি নি, নাথ, কোনো কাজে—
শুধু কেবল সুরে বাজে অকাজের এই প্রাণ॥
নিশায় নীরব দেবালয়ে তোমার আরাধন,
তখন মোরে আদেশ কোরো গাইতে হে রাজন।
ভোরে যখন আকাশ জুড়ে বাজবে বীণা সোনার সুরে—
আমি যেন না রই দূরে, এই দিয়ো মোর মান॥
আর কত দূরে আছে সে আনন্দধাম
আর কত দূরে আছে সে আনন্দধাম।
আমি শ্রান্ত, আমি অন্ধ, আমি পথ নাহি জানি ॥
রবি যায় অস্তাচলে আঁধারে ঢাকে ধরণী–
করো কৃপা অনাথে হে বিশ্বজনজননী ॥
অতৃপ্ত বাসনা লাগি ফিরিয়াছি পথে পথে–
বৃথা খেলা, বৃথা মেলা, বৃথা বেলা গেল বহে।
আজি সন্ধ্যাসমীরণে লহো শান্তিনিকেতনে,
স্নেহকরপরশনে চিরশান্তি দেহো আনি ॥
আর নহে, আর নয়
আর নহে, আর নয়,
আমি করি নে আর ভয়।
আমার ঘুচল-কাঁদন, ফলল সাধন, হল বাঁধন ক্ষয় ॥
ওই আকাশে ওই ডাকে,
আমায় আর কে ধ’রে রাখে–
আমি সকল দুয়ার খুলেছি, আজ যাব সকলময় ॥
ওরা ব’সে ব’সে মিছে
শুধু মায়াজাল গাঁথিছে–
ওরা কী-যে গোনে ঘরের কোণে আমায় ডাকে পিছে।
আমার অস্ত্র হল গড়া,
আমার বর্ম হল পরা–
এবার ছুটবে ঘোড়া পবনবেগে, করবে ভুবন জয় ॥
আর রেখো না আঁধারে, আমায় দেখতে দাও
আর রেখো না আঁধারে, আমায় দেখতে দাও।
তোমার মাঝে আমার আপনারে দেখতে দাও ॥
কাঁদাও যদি কাঁদাও এবার, সুখের গ্লানি সয় না যে আর,
নয়ন আমার যাক-না ধুয়ে অশ্রুধারে–
আমায় দেখতে দাও ॥
জানি না তো কোন্ কালো এই ছায়া,
আপন ব’লে ভুলায় যখন ঘনায় বিষম মায়া।
স্বপ্নভারে জমল বোঝা, চিরজীবন শূন্য খোঁজা–
যে মোর আলো লুকিয়ে আছে রাতের পারে
আমায় দেখতে দাও।
আরাম-ভাঙা উদাস সুরে
আরাম-ভাঙা উদাস সুরে
আমার বাঁশির শূন্য হৃদয় কে দিল আজ ব্যথায় পূরে ॥
বিরামহারা ঘরছাড়াকে ব্যাকুল বাঁশি আপনি ডাকে–
ডাকে স্বপন-জাগরণে, কাছের থেকে ডাকে দূরে ॥
আমার প্রাণের কোন্ নিভৃতে লুকিয়ে কাঁদায় গোধূলিতে–
মন আজও তার নাম জানে না, রূপ আজও তার নয়কো চেনা–
কেবল যে সে ছায়ার বেশে স্বপ্নে আমার বেড়ায় ঘুরে ॥
আরো আঘাত সইবে আমার
আরো আঘাত সইবে আমার, সইবে আমারো।
আরো কঠিন সুরে জীবন-তারে ঝঙ্কারো ॥
যে রাগ জাগাও আমার প্রাণে বাজে নি তা চরম তানে,
নিঠুর মূর্ছনায় সে গানে মূর্তি সঞ্চারো ॥
লাগে না গো কেবল যেন কোমল করুণা,
মৃদু সুরের খেলায় এ প্রাণ ব্যর্থ কোরো না।
জ্ব’লে উঠুক সকল হুতাশ, গর্জি উঠুক সকল বাতাস,
জাগিয়ে দিয়ে সকল আকাশ পূর্ণতা বিস্তারো ॥
আরো আরো প্রভু, আরো আরো
আরো আরো প্রভু, আরো আরো।
এমনি করে আমায় মারো।
লুকিয়ে থাকি আমি পালিয়ে বেড়াই,
ধরা পড়ে গেছি আর কি এড়াই?
যা কিছু আছে সব কাড়ো কাড়ো।
এবার যা করবার তা সারো সারো।
আমি হারি কিম্বা তুমিই হারো!
হাটে ঘাটে বাটে করি মেলা,
কেবল হেসে খেলে গেছে বেলা,
দেখি কেমনে কাঁদাতে পারো।
আরো চাই যে, আরো চাই গো– আরো যে চাই
আরো চাই যে, আরো চাই গো– আরো যে চাই।
ভাণ্ডারী যে সুধা আমায় বিতরে নাই ॥
সকালবেলার আলোয় ভরা এই-যে আকাশ বসুন্ধরা
এরে আমার জীবন-মাঝে কুড়ানো চাই–
সকল ধন যে বাইরে আমার, ভিতরে নাই ॥
প্রাণের বীণায় আরো আঘাত, আরো যে চাই।
গুণীর পরশ পেয়ে সে যে শিহরে নাই।
দিনরজনীর বাঁশি পূরে যে গান বাজে অসীম সুরে
তারে আমার প্রাণের তারে বাজানো চাই।
আপন গান যে দূরে তাহার, নিয়ড়ে নাই ॥
আলো যে আজ গান করে মোর প্রাণে গো
আলো যে আজ গান করে মোর প্রাণে গো।
কে এল মোর অঙ্গনে কে জানে গো॥
হৃদয় আমার উদাস করে কেড়ে নিল আকাশ মোরে,
বাতাস আমায় আনন্দবাণ হানে গো॥
দিগন্তের ওই নীল নয়নের ছায়াতে
কুসুম যেন বিকাশে মোর কায়াতে।
মোর হৃদয়ের সুগন্ধ যে বাহির হল কাহার খোঁজে,
সকল জীবন চাহে কাহার পানে গো॥
আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও
আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও।
আপনাকে এই লুকিয়ে-রাখা ধুলার ঢাকা ধুইয়ে দাও ॥
যে জন আমার মাঝে জড়িয়ে আছে ঘুমের জালে
আজ এই সকালে ধীরে ধীরে তার কপালে
এই অরুণ আলোর সোনার-কাঠি ছুঁইয়ে দাও।
বিশ্বহৃদয়-হতে-ধাওয়া আলোয়-পাগল প্রভাত হাওয়া,
সেই হাওয়াতে হৃদয় আমার নুইয়ে দাও ॥
আজ নিখিলের আনন্দধারায় ধুইয়ে দাও,
মনের কোণের সব দীনতা মলিনতা ধুইয়ে দাও।
আমার পরান-বীণায় ঘুমিয়ে আছে অমৃতগান–
তার নাইকো বাণী, নাইকো ছন্দ, নাইকো তান।
তারে আনন্দের এই জাগরণী ছুঁই’য়ে দাও।
বিশ্বহৃদয়-হতে-ধাওয়া প্রাণে-পাগল গানের হাওয়া,
সেই হাওয়াতে হৃদয় আমার নুইয়ে দাও ॥
আলোয় আলোকময় করে হে এলে আলোর আলো
আলোয় আলোকময় করে হে এলে আলোর আলো।
আমার নয়ন হতে আঁধার মিলালো মিলালো ॥
সকল আকাশ সকল ধরা আনন্দে হাসিতে ভরা,
যে দিক-পানে নয়ন মেলি ভালো সবই ভালো ॥
তোমার আলো গাছের পাতায় নাচিয়ে তোলে প্রাণ।
তোমার আলো পাখির বাসায় জাগিয়ে তোলে গান।
তোমার আলো ভালোবেসে পড়েছে মোর গায়ে এসে,
হৃদয়ে মোর নির্মল হাত বুলালো বুলালো ॥
আসা-যাওয়ার মাঝখানে
আসা-যাওয়ার মাঝখানে
একলা আছ চেয়ে কাহার পথ-পানে ॥
আকাশে ওই কালোয় সোনায় শ্রাবণমেঘের কোণায় কোণায়
আঁধার-আলোয় কোন্ খেলা যে কে জানে
আসা-যাওয়ার মাঝখানে ॥
শুকনো পাতা ধুলায় ঝরে, নবীন পাতায় শাখা ভরে।
মাঝে তুমি আপন-হারা, পায়ের কাছে জলের ধারা
যায় চলে ওই অশ্রু-ভরা কোন্ গানে
আসা-যাওয়ার মাঝখানে ॥