আমি জেনে শুনে তবু ভুলে আছি
আমি জেনে শুনে তবু ভুলে আছি, দিবস কাটে বৃথায় হে–
আমি যেতে চাই তব পথপানে, কত বাধা পায় পায় হে ॥
চারি দিকে হেরো ঘিরিছে কারা, শত বাঁধনে জড়ায় হে–
আমি ছাড়াতে চাহি, ছাড়ে না কেন গো ডুবায়ে রাখে মায়ায় হে ॥
দাও ভেঙে দাও এ ভবের সুখ, কাজ নেই এ খেলায় হে।
আমি ভুলে থাকি যত অবোধের মতো বেলা বহে তত যায় হে ॥
হানো তব বাজ হৃদয়গহনে, দুখানল জ্বালো তায় হে–
নয়নের জলে ভাসায়ে আমারে সে জল দাও মুছায়ে হে ॥
শূন্য করে দাও হৃদয় আমার, আসন পাতো সেথায় হে–
তুমি এসো এসো, নাথ হয়ে বোসো, ভুলো না আর আমায় হে
আমি মারের সাগর পাড়ি দেব বিষম ঝড়ের বায়ে
আমি মারের সাগর পাড়ি দেব বিষম ঝড়ের বায়ে
আমার ভয়ভাঙা এই নায়ে ॥
মাভৈঃ বাণীর ভরসা নিয়ে ছেঁড়া পালে বুক ফুলিয়ে
তোমার ওই পারেতেই যাবে তরী ছায়াবটের ছায়ে ॥
পথ আমারে সেই দেখাবে যে আমারে চায়–
আমি অভয় মনে ছাড়ব তরী, এই শুধু মোর দায়।
দিন ফুরালে, জানি জানি, পৌঁছে ঘাটে দেব আনি
আমার দুঃখদিনের রক্তকমল তোমার করুণ পায়ে ॥
আমি যখন ছিলেম অন্ধ
আমি যখন ছিলেম অন্ধ
সুখের খেলায় বেলা গেছে, পাই নি তো আনন্দ॥
খেলাঘরের দেয়াল গেঁথে খেয়াল নিয়ে ছিলেম মেতে,
ভিত ভেঙে যেই এল ঘরে ঘুচল আমার বন্ধ।
সুখের খেলা আর রোচে না, পেয়েছি আনন্দ॥
ভীষণ আমার, রুদ্র আমার, নিদ্রা গেল ক্ষুদ্র আমার–
উগ্র ব্যথায় নূতন ক’রে বাঁধলে আমার ছন্দ।
যে দিন তুমি অগ্নিবেশে সব-কিছু মোর নিলে এসে
সে দিন আমি পূর্ণ হলেম ঘুচল আমার দ্বন্দ্ব।
দুঃখসুখের পারে তোমায় পেয়েছি আনন্দ॥
আমি হৃদয়েতে পথ কেটেছি
আমি হৃদয়েতে পথ কেটেছি, সেথায় চরণ পড়ে,
তোমার সেথায় চরণ পড়ে।
তাই তো আমার সকল পরান কাঁপছে ব্যথার ভরে গো,
কাঁপছে থরোথরে ॥
ব্যথাপথের পথিক তুমি, চরণ চলে ব্যথা চুমি–
কাঁদন দিয়ে সাধন আমার চিরদিনের তরে গো,
চিরজীবন ধ’রে ॥
নয়নজলের বন্যা দেখে ভয় করি নে আর,
আমি ভয় করি নে আর।
মরণ-টানে টেনে আমায় করিয়ে দেবে পার,
আমি তরব পারাবার।
ঝড়ের হাওয়া আকুল গানে বইছে আজি তোমার পানে–
ডুবিয়ে তরী ঝাঁপিয়ে পড়ি ঠেকব চরণ-‘পরে,
আমি বাঁচব চরণ ধরে ॥
আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই
আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই, বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে।
এ কৃপা কঠোর সঞ্চিত মোর জীবন ভ’রে ॥
না চাহিতে মোরে যা করেছ দান– আকাশ আলোক তনু মন প্রাণ,
দিনে দিনে তুমি নিতেছ আমায় সে মহা দানেরই যোগ্য ক’রে
অতি-ইচ্ছার সঙ্কট হতে বাঁচায়ে মোরে ॥
আমি কখনো বা ভুলি কখনো বা চলি তোমার পথের লক্ষ্য ধরে;
তুমি নিষ্ঠুর সম্মুখ হতে যাও যে সরে।
এ যে তব দয়া, জানি জানি হায়, নিতে চাও ব’লে ফিরাও আমায়–
পূর্ণ করিয়া লবে এ জীবন তব মিলনেরই যোগ্য ক’রে
আধা-ইচ্ছার সঙ্কট হতে বাঁচায়ে মোরে ॥
আমি আছি তোমার সভার দুয়ার-দেশে
আমি আছি তোমার সভার দুয়ার-দেশে,
সময় হলেই বিদায় নেব কেঁদে হেসে॥
মালায় গেঁথে যে ফুলগুলি দিয়েছিলে মাথায় তুলি
পাপড়ি তাহার পড়বে ঝরে দিনের শেষে॥
উচ্চ আসন না যদি রয় নামব নীচে,
ছোটো ছোটো গানগুলি এই ছড়িয়ে পিছে।
কিছু তো তার রইবে বাকি তোমার পথের ধুলা ঢাকি,
সবগুলি কি সন্ধ্যা-হাওয়ায় যাবে ভেসে ?।
আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম গান
আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম গান
তার বদলে আমি চাই নে কোনো দান॥
ভুলবে সে গান যদি নাহয় যেয়ো ভুলে
উঠবে যখন তারা সন্ধ্যাসাগরকুলে,
তোমার সভায় যবে করব অবসান
এই ক’দিনের শুধু এই ক’টি মোর তান॥
তোমার গান যে কত শুনিয়েছিলে মোরে
সেই কথাটি তুমি ভুলবে কেমন করে?
সেই কথাটি, কবি, পড়বে তোমার মনে
বর্ষামুখর রাতে, ফাগুন-সমীরণে—
এইটুকু মোর শুধু রইল অভিমান
ভুলতে সে কি পার ভুলিয়েছ মোর প্রাণ॥
আমি দীন, অতি দীন
আমি দীন, অতি দীন–
কেমনে শুধিব, নাথ হে, তব করুণাঋণ ॥
তব স্নেহ শত ধারে ডুবাইছে সংসারে,
তাপিত হৃদিমাঝে ঝরিছে নিশিদিন ॥
হৃদয়ে যা আছে দিব তব কাছে,
তোমারি এ প্রেম দিব তোমারে–
চিরদিন তব কাজে রহিব জগতমাঝে,
জীবন করেছি তোমার চরণতলে লীন ॥
আমি যখন তাঁর দুয়ারে ভিক্ষা নিতে যাই
আমি যখন তাঁর দুয়ারে ভিক্ষা নিতে যাই তখন যাহা পাই
সে যে আমি হারাই বারে বারে ॥
তিনি যখন ভিক্ষা নিতে আসেন আমার দ্বারে
বন্ধ তালা ভেঙে দেখি আপন-মাঝে গোপন রতনভার,
হারায় না সে আর ॥
প্রভাত আসে তাঁহার কাছে আলোক ভিক্ষা নিতে,
সে আলো তার লুটায় ধরণীতে।
তিনি যখন সন্ধ্যা-কাছে দাঁড়ান ঊর্ধ্বকরে, তখন স্তরে স্তরে
ফুটে ওঠে অন্ধকারের আপন প্রাণের ধন–
মুকুটে তাঁর পরেন সে রতন ॥
আমি সংসারে মন দিয়েছিনু
আমি সংসারে মন দিয়েছিনু, তুমি আপনি সে মন নিয়েছ।
আমি সুখ ব’লে দুখ চেয়েছিনু, তুমি দুখ ব’লে সুখ দিয়েছ ॥
হৃদয় যাহার শতখানে ছিল শত স্বার্থের সাধনে
তাহারে কেমনে কুড়ায়ে আনিলে, বাঁধিলে ভক্তিবাঁধনে ॥
সুখ সুখ করে দ্বারে দ্বারে মোরে কত দিকে কত খোঁজালে,
তুমি যে আমার কত আপনার এবার সে কথা বোঝালে–
করুণা তোমার কোন্ পথ দিয়ে কোথা নিয়ে যায় কাহারে–
সহসা দেখিনু নয়ন মেলিয়ে,
এনেছ তোমারি দুয়ারে ॥