আমায় অভিমানের বদলে আজ নেব তোমার মালা
আমায় অভিমানের বদলে আজ নেব তোমার মালা।
আজ নিশিশেষে শেষ করে দিই চোখের জলের পালা॥
আমার কঠিন হৃদয়টারে ফেলে দিলেম পথের ধারে,
তোমার চরণ দেবে তারে মধুর পরশ পাষাণ-গালা॥
ছিল আমার আঁধারখানি, তারে তুমিই নিলে টানি,
তোমার প্রেম এল যে আগুন হয়ে– করল তারে আলা।
সেই-যে আমার কাছে আমি ছিল সবার চেয়ে দামি
তারে উজাড় করে সাজিয়ে দিলেম তোমার বরণডালা॥
আমায় মুক্তি যদি দাও বাঁধন খুলে
আমায় মুক্তি যদি দাও বাঁধন খুলে
আমি তোমার বাঁধন নেব তুলে ॥
যে পথে ধাই নিরবধি সে পথ আমার ঘোচে যদি
যাব তোমার মাঝে পথের ভুলে ॥
যদি নেবাও ঘরের আলো
তোমার কালো আঁধার বাসব ভালো।
তীর যদি আর না যায় দেখা তোমার আমি হব একা
দিশাহারা সেই অকূলে ॥
আমায় বাঁধবে যদি কাজের ডোরে
আমায় বাঁধবে যদি কাজের ডোরে
কেন পাগল কর এমন ক’রে ?।
বাতাস আনে কেন জানি কোন্ গগনের গোপন বাণী,
পরানখানি দেয় যে ভ’রে ॥
সোনার আলো কেমনে হে, রক্তে নাচে সকল দেহে।
কারে পাঠাও ক্ষণে ক্ষণে আমার খোলা বাতায়নে,
সকল হৃদয় লয় যে হ’রে ॥
আমায় ভুলতে দিতে নাইকো তোমার ভয়
আমায় ভুলতে দিতে নাইকো তোমার ভয়
আমার ভোলার আছে অন্ত, তোমার প্রেমের তো নাই ক্ষয় ॥
দূরে গিয়ে বাড়াই যে ঘুর, সে দূর শুধু আমারি দূর–
তোমার কাছে দূর কভু দূর নয় ॥
আমার প্রাণের কুঁড়ি পাপড়ি নাহি খোলে,
তোমার বসন্তবায় নাই কি গো তাই বলে!
এই খেলাতে আমার সনে হার মানো যে ক্ষণে ক্ষণে–
হারের মাঝে আছে তোমার জয় ॥
আমায় দাও গো ব’লে
আমায় দাও গো ব’লে
সে কি তুমি আমায় দাও দোলা অশান্তিদোলে।
দেখতে না পাই পিছে থেকে আঘাত দিয়ে হৃদয়ে কে
ঢেউ যে তোলে ॥
মুখ দেখি নে তাই লাগে ভয়– জানি না যে, এ কিছু নয়।
মুছব আঁখি, উঠব হেসে– দোলা যে দেয় যখন এসে
ধরবে কোলে ॥
আমি তারেই জানি তারেই জানি আমায় যে জন আপন জানে
আমি তারেই জানি তারেই জানি আমায় যে জন আপন জানে–
তারি দানে দাবি আমার যার অধিকার আমার দানে॥
যে আমারে চিনতে পারে সেই চেনাতে চিনি তারে গো–
একই আলো চেনার পথে তার প্রাণে আর আমার প্রাণে॥
আপন মনের অন্ধকারে ঢাকল যারা
আমি তাদের মধ্যে আপনহারা।
ছুঁইয়ে দিল সোনার কাঠি, ঘুমের ঢাকা গেল কাটি গো–
নয়ন আমার ছুটেছে তার আলো-করা মুখের পানে॥
আমি তারেই খুঁজে বেড়াই যে রয় মনে আমার মনে
আমি তারেই খুঁজে বেড়াই যে রয় মনে আমার মনে।
সে আছে ব’লে
আমার আকাশ জুড়ে ফোটে তারা রাতে,
প্রাতে ফুল ফুটে রয় বনে আমার বনে॥
সে আছে ব’লে চোখের তারার আলোয়
এত রূপের খেলা রঙের মেলা অসীম সাদায় কালোয়।
সে মোর সঙ্গে থাকে ব’লে
আমার অঙ্গে অঙ্গে হরষ জাগায় দখিন-সমীরণে॥
তারি বাণী হঠাৎ উঠে পূরে
আন্মনা কোন্ তানের মাঝে আমার গানের সুরে।
দুখের দোলে হঠাৎ মোরে দোলায়,
কাজের মাঝে লুকিয়ে থেকে আমারে কাজ ভোলায়।
সে মোর চিরদিনের ব’লে
তারি পুলকে মোর পলকগুলি ভরে ক্ষণে ক্ষণে॥
আমি জ্বালব না মোর বাতায়নে প্রদীপ আনি
আমি জ্বালব না মোর বাতায়নে প্রদীপ আনি,
আমি শুনব বসে আঁধার-ভরা গভীর বাণী॥
আমার এ দেহ মন মিলায়ে যাক নিশীথরাতে,
আমার লুকিয়ে-ফোটা এই হৃদয়ের পুষ্পপাতে,
থাক্-না ঢাকা মোর বেদনার গন্ধখানি॥
আমার সকল হৃদয় উধাও হবে তারার মাঝে
যেখানে ওই আঁধারবীণায় আলো বাজে।
আমার সকল দিনের পথ খোঁজা এই হল সারা,
এখন দিক্-বিদিকের শেষে এসে দিশাহারা
কিসের আশায় বসে আছি অভয় মানি॥
আমি কান পেতে রই ও আমার আপন হৃদয়গহন-দ্বারে বারে বারে
আমি কান পেতে রই ও আমার আপন হৃদয়গহন-দ্বারে বারে বারে
কোন্ গোপনবাসীর কান্নাহাসির গোপন কথা শুনিবারে– বারে বারে॥
ভ্রমর সেথা হয় বিবাগী নিভৃত নীল পদ্ম লাগি রে,
কোন্ রাতের পাখি গায় একাকী সঙ্গীবিহীন অন্ধকারে বারে বারে॥
কে সে মোর কেই বা জানে, কিছু তার দেখি আভা।
কিছু পাই অনুমানে, কিছু তার বুঝি না বা।
মাঝে মাঝে তার বারতা আমার ভাষায় পায় কি কথা রে,
ও সে আমায় জানি পাঠায় বাণী গানের তানে লুকিয়ে তারে বারে বারে॥
আমি কারে ডাকি গো
আমি কারে ডাকি গো,
আমার বাঁধন দাও গো টুটে।
আমি হাত বাড়িয়ে আছি,
আমায় লও কেড়ে লও লুটে ॥
তুমি ডাকো এমনি ডাকে
যেন লজ্জাভয় না থাকে,
যেন সব ফেলে যাই, সব ঠেলে যাই,
যাই ধেয়ে যাই ছুটে ॥
আমি স্বপন দিয়ে বাঁধা–
কেবল ঘুমের ঘোরের বাধা,
সে যে জড়িয়ে আছে প্রাণের কাছে
মুদিয়ে আঁখিপুটে।
ওগো দিনের পর দিন
আমার কোথায় হল লীন,
কেবল ভাষাহারা অশ্রুধারায়
পরান কেঁদে উঠে ॥
আমি কী ব’লে করিব নিবেদন
আমি কী ব’লে করিব নিবেদন
আমার হৃদয় প্রাণ মন ॥
চিত্তে আসি দয়া করি নিজে লহো অপহরি,
করো তারে আপনারি ধন– আমার হৃদয় প্রাণ মন ॥
শুধু ধূলি, শুধু ছাই, মূল্য যার কিছু নাই,
মূল্য তারে করো সমর্পণ স্পর্শে তব পরশরতন!
তোমারি গৌরবে যবে আমার গৌরব হবে
সব তবে দিব বিসর্জন–
আমার হৃদয় প্রাণ মন ॥
আমি কেমন করিয়া জানাব আমার জুড়ালো হৃদয় জুড়ালো
আমি কেমন করিয়া জানাব আমার জুড়ালো হৃদয় জুড়ালো–
আমার জুড়ালো হৃদয় প্রভাতে।
আমি কেমন করিয়া জানাব আমার পরান কী নিধি কুড়ালো–
ডুবিয়া নিবিড় গভীর শোভাতে ॥
আজ গিয়েছি সবার মাঝারে, সেথায় দেখেছি আলোক-আসনে–
দেখেছি আমার হৃদয়রাজারে।
আমি দুয়েকটি কথা কয়েছি তা সনে সে নীরব সভা-মাঝারে–
দেখেছি চিরজনমের রাজারে ॥
এই বাতাস আমারে হৃদয়ে লয়েছে, আলোক আমার তনুতে
কেমনে মিলে গেছে মোর তনুতে–
তাই এ গগন-ভরা প্রভাত পশিল আমার অণুতে অণুতে।
আজ ত্রিভুবন-জোড়া কাহার বক্ষে দেহ মন মোর ফুরালো–
যেন রে নিঃশেষে আজি ফুরালো।
আজ যেখানে যা হেরি সকলেরই মাঝে জুড়ালো জীবন জুড়ালো–
আমার আদি ও অন্ত জুড়ালো ॥