তোমার হল শুরু আমার হল সারা
তোমার হল শুরু, আমার হল সারা–
তোমায় আমায় মিলে এমনি বহে ধারা ॥
তোমার জ্বলে বাতি তোমার ঘরে সাথি–
আমার তরে রাতি, আমার তরে তারা ॥
তোমার আছে ডাঙা, আমার আছে জল–
তোমার বসে থাকা, আমার চলাচল।
তোমার হাতে রয়, আমার হাতে ক্ষয়–
তোমার মনে ভয়, আমার ভয় হারা ॥
দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না
দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না–
সেই-যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।
কান্নাহাসির বাঁধন তারা সইল না–
সেই-যে আমার নানা রঙের দিনগুলি॥
আমার প্রাণের গানের ভাষা
শিখবে তারা ছিল আশা–
উড়ে গেল, সকল কথা কইল না–
সেই-যে আমার নানা রঙের দিনগুলি॥
স্বপন দেখি, যেন তারা কার আশে
ফেরে আমার ভাঙা খাঁচার চার পাশে–
সেই-যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।
এত বেদন হয় কি ফাঁকি।
ওরা কি সব ছায়ার পাখি।
আকাশ-পারে কিছুই কি গো বইল না–
সেই-যে আমার নানা রঙের দিনগুলি॥
দুই হাতে– কালের মন্দিরা
দুই হাতে–
কালের মন্দিরা যে সদাই বাজে ডাইনে বাঁয়ে দুই হাতে,
সুপ্তি ছুটে নৃত্য উঠে নিত্য নূতন সংঘাতে॥
বাজে ফুলে, বাজে কাঁটায়, আলোছায়ার জোয়ার-ভাঁটায়,
প্রাণের মাঝে ওই-যে বাজে দুঃখে সুখে শঙ্কাতে॥
তালে তালে সাঁঝ-সকালে রূপ-সাগরে ঢেউ লাগে।
সাদা-কালোর দ্বন্দ্বে যে ওই ছন্দে নানান রঙ জাগে।
এই তালে তোর গান বেঁধে নে– কান্নাহাসির তান সেধে নে,
ডাক দিল শোন্ মরণ বাঁচন নাচন-সভার ডঙ্কাতে॥
দুয়ার মোর পথপাশে
দুয়ার মোর পথপাশে, সদাই তারে খুলে রাখি।
কখন্ তোর রথ আসে ব্যাকুল হয়ে জাগে আঁখি॥
শ্রাবণে শুনি দূর মেঘে লাগায় গুরু গরো-গরো,
ফাগুনে শুনি বায়ুবেগে জাগায় মৃদু মরো-মরো–
আমার বুকে উঠে জেগে চমক তারি থাকি থাকি॥
সবাই দেখি যায় চলে পিছন-পানে নাহি চেয়ে
উতল রোলে কল্লোলে পথের গান গেয়ে গেয়ে।
শরৎ-মেঘ যায় ভেসে উধাও হয়ে কত দূরে
যেথায় সব পথ মেশে গোপন কোন্ সুরপুরে।
স্বপনে ওড়ে কোন্ দেশে উদাস মোর মনোপাখি॥
দূর রজনীর স্বপন লাগে
দূর রজনীর স্বপন লাগে আজ নূতনের হাসিতে,
দূর ফাগুনের বেদন জাগে আজ ফাগুনের বাঁশিতে॥
হায় রে সে কাল হায় রে কখন চলে যায় রে
আজ এ কালের মরীচিকায় নতুন মায়ায় ভাসিতে॥
যে মহাকাল দিন ফুরালে আমার কুসুম ঝরালো
সেই তোমারি তরুণ ভালে ফুলের মালা পরালো।
শুনিয়ে শেষের কথা সে কাঁদিয়ে ছিল হতাশে,
তোমার মাঝে নতুন সাজে শূন্য আবার ভরালো।
আমরা খেলা খেলেছিলেম, আমরাও গান গেয়েছি।
আমরাও পাল মেলেছিলেম, আমরা তরী বেয়েছি।
হারায় নি তা হারায় নি বৈতরণী পারায় নি–
নবীন চোখের চপল আলোয় সে কাল ফিরে পেয়েছি।
দূরদেশী সেই রাখাল ছেলে
দূরদেশী সেই রাখাল ছেলে
আমার বাটে বটের ছায়ায় সারা বেলা গেল খেলে॥
গাইল কী গান সেই তা জানে, সুর বাজে তার আমার প্রাণে–
বলো দেখি তোমরা কি তার কথার কিছু আভাস পেলে॥
আমি তারে শুধাই যবে ‘কী তোমারে দিব আনি’–
সে শুধু কয়, ‘আর কিছু নয়, তোমার গলার মালাখানি।’
দিই যদি তো কী দাম দেবে যায় বেলা সেই ভাব্না ভেবে–
ফিরে এসে দেখি ধুলায় বাঁশিটি তার গেছে ফেলে॥
দেখা না-দেখায় মেশা
দেখা না-দেখায় মেশা হে বিদ্যুৎলতা,
কাঁপাও ঝড়ের বুকে একি ব্যাকুলতা ॥
গগনে সে ঘুরে ঘুরে খোঁজে কাছে, খোঁজে দূরে–
সহসা কী হাসি হাস’; নাহি কহ কথা ॥
আঁধার ঘনায় শূন্যে, নাহি জানে নাম,
কী রুদ্র সন্ধানে সিন্ধু দুলিছে দুর্দাম।
অরণ্য হতাশপ্রাণে আকাশে ললাট হানে,
দিকে দিকে কেঁদে ফেরে কী দুঃসহ ব্যথা ॥
নমো যন্ত্র নমো– যন্ত্র
নমো যন্ত্র, নমো– যন্ত্র, নমো– যন্ত্র, নমো– যন্ত্র!
তুমি চক্রমুখরমন্দ্রিত, তুমি বজ্রবহ্নিবন্দিত,
তব বস্তুবিশ্ববক্ষোদংশ ধ্বংসবিকট দন্ত ॥
তব দীপ্ত-অগ্নি-শত-শতঘ্নী-বিঘ্নবিজয় পন্থ।
তব লৌহগলন শৈলদলন অচলচলন মন্ত্র ॥
কভু কাষ্ঠলোষ্ট্র-ইষ্টক দৃঢ় ঘনপিনদ্ধ কায়া,
কভু ভূতল-জল-অন্তরীক্ষ-লঙ্ঘন লঘু মায়া।
তব খনি-খনিত্র-নখ-বিদীর্ণ ক্ষিতি বিকীর্ণ-অন্ত্র।
তব পঞ্চভূতবন্ধনকর ইন্দ্রজালতন্ত্র ॥
না গো এই যে ধুলা আমার না
না গো, এই যে ধুলা আমার না এ।
তোমার ধুলার ধরার ‘পরে উড়িয়ে যাব সন্ধ্যাবায়ে॥
দিয়ে মাটি আগুন জ্বালি রচলে দেহ পূজার থালি–
শেষ আরতি সারা ক’রে ভেঙে যাব তোমার পায়ে॥
ফুল যা ছিল পূজার তরে
যেতে পথে ডালি হতে অনেক যে তার গেছে পড়ে।
কত প্রদীপ এই থালাতে সাজিয়েছিলে আপন হাতে–
কত যে তার নিবল হাওয়ায়, পৌঁছল না চরণছায়ে॥
নাই ভয় নাই ভয় নাই রে
নাই ভয়, নাই ভয়, নাই রে।
থাক্ পড়ে থাক্ ভয় বাইরে॥
জাগো, মৃত্যুঞ্জয়, চিত্তে থৈ থৈ নর্তননৃত্যে।
ওরে মন, বন্ধনছিন্ন
দাও তালি তাই তাই তাই রে॥
নাহয় তোমার যা হয়েছে তাই হল
নাহয় তোমার যা হয়েছে তাই হল।
আরো কিছু নাই হল, নাই হল, নাই হল॥
কেউ যা কভু দেয় না ফাঁকি সেইটুকু তোর থাক্-না বাকি,
পথেই না হয় ঠাঁই হল॥
চল্ রে সোজা বীণার তারে ঘা দিয়ে,
ডাইনে বাঁয়ে দৃষ্টি তোমার না দিয়ে।
হারিয়ে চলিস পিছনেরে, সামনে যা পাস কুড়িয়ে নে রে–
খেদ কী রে তোর যাই হল॥
নৃত্যের তালে তালে নটরাজ
নৃত্যের তালে তালে, নটরাজ, ঘুচাও ঘুচাও ঘুচাও সকল বন্ধ হে।
সুপ্তি ভাঙাও, চিত্তে জাগাও মুক্ত সুরের ছন্দ হে॥
তোমার চরণপবনপরশে সরস্বতীর মানসসরসে
যুগে যুগে কালে কালে সুরে সুরে তালে তালে
ঢেউ তুলে দাও, মাতিয়ে জাগাও অমলকমলগন্ধে হে॥
নমো নমো নমো–
তোমার নৃত্য অমিত বিত্ত ভরুক চিত্ত মম॥