জাগ’ আলসশয়নবিলগ্ন
জাগ’ আলসশয়নবিলগ্ন।
জাগ’ তামসগহননিমগ্ন॥
ধৌত করুক করুণারুণবৃষ্টি সুপ্তিজড়িত যত আবিল দৃষ্টি,
জাগ’ দুঃখভারনত উদ্যমভগ্ন॥
জ্যোতিসম্পদ তরি দিক চিত্ত ধনপ্রলোভননাশন বিত্ত,
জাগ’ পুণ্যবসন পর’ লজ্জিত নগ্ন॥
জীবন আমার চলছে যেমন তেমনি ভাবে
জীবন আমার চলছে যেমন তেমনি ভাবে
সহজ কঠিন দ্বন্দ্বে ছন্দে চলে যাবে॥
চলার পথে দিনে রাতে দেখা হবে সবার সাথে–
তাদের আমি চাব, তারা আমায় চাবে॥
জীবন আমার পলে পলে এমনি ভাবে
দুঃখসুখের রঙে রঙে রঙিয়ে যাবে॥
রঙের খেলার সেই সভাতে খেলে যে জন সবার সাথে
তারে আমি চাব, সেও আমায় চাবে॥
তরী আমার হঠাৎ ডুবে যায়
তরী আমার হঠাৎ ডুবে যায়
কোন্খানে রে কোন্ পাষাণের ঘায়॥
নবীন তরী নতুন চলে, দিই নি পাড়ি অগাধ জলে–
বাহি তারে খেলার ছলে কিনার-কিনারায়॥
ভেসেছিলেম স্রোতের ভরে, একা ছিলেম কর্ণ ধ’রে–
লেগেছিল পালের ‘পরে মধুর মৃদু বায়।
সুখে ছিলেম আপন-মনে, মেঘ ছিল না গগনকোণে–
লাগবে তরী কুসুমবনে ছিলেম সেই আশায়॥
তরীতে পা দিই নি আমি
তরীতে পা দিই নি আমি, পারের পানে যাই নি গো।
ঘাটেই বসে কাটাই বেলা, আর কিছু তো চাই নি গো ॥
তোরা যাবি রাজার পুরে অনেক দূরে,
তোদের রথের চাকার সুরে
আমার সাড়া পাই নি গো ॥
আমার এ যে গভীর জলে খেয়া বাওয়া,
হয়তো কখন্ নিসুত রাতে উঠবে হাওয়া।
আসবে মাঝি ও পার হতে উজান স্রোতে,
সেই আশাতেই চেয়ে আছি– তরী আমার বাই নি গো ॥
তিমিরময় নিবিড় নিশা
তিমিরময় নিবিড় নিশা নাহি রে নাহি দিশা–
একেলা ঘনঘোর পথে, পান্থ, কোথা যাও॥
বিপদ দুখ নাহি জানো, বাধা কিছু না মানো,
অন্ধকার হতেছ পার– কাহার সাড়া পাও॥
দীপ হৃদয়ে জ্বলে, নিবে না সে বায়ুবলে–
মহানন্দে নিরন্তর একি গান গাও।
সমুখে অভয় তব, পশ্চাতে অভয়রব–
অন্তরে বাহিরে কাহার মুখে চাও॥
তুমি উষার সোনার বিন্দু প্রাণের সিন্ধুকূলে
তুমি উষার সোনার বিন্দু প্রাণের সিন্ধুকূলে,
শরৎ-প্রাতের প্রথম শিশির প্রথম শিউলিফুলে॥
আকাশপারের ইন্দ্রধনু ধরার পারে নোওয়া,
নন্দনেরই নন্দিনী গো চন্দ্রলেখায় ছোঁওয়া,
প্রতিপদে চাঁদের স্বপন শুভ্র মেঘে ছোঁওয়া–
স্বর্গলোকের গোপন কথা মর্তে এলে ভুলে॥
তুমি কবির ধেয়ান-ছবি পূর্বজনম-স্মৃতি,
তুমি আমার কুড়িয়ে পাওয়া হারিয়ে-যাওয়া গীতি।
যে কথাটি যায় না বলা কইলে চুপে চুপে,
তুমি আমার মুক্তি হয়ে এলে বাঁধনরূপে–
অমল আলোর কমলবনে ডাকলে দুয়ার খুলে।
তুমি কি কেবলই ছবি
তুমি কি কেবলই ছবি, শুধু পটে লিখা।
ওই-যে সুদূর নীহারিকা
যারা করে আছে ভিড় আকাশের নীড়,
ওই যারা দিনরাত্রি
আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী গ্রহ তারা রবি,
তুমি কি তাদের মতো সত্য নও।
হায় ছবি, তুমি শুধু ছবি॥
নয়নসমুখে তুমি নাই,
নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই– আজি তাই
শ্যামলে শ্যামল তুমি, নীলিমায় নীল।
আমার নিখিল তোমাতে পেয়েছে তার অন্তরের মিল।
নাহি জানি, কেহ নাহি জানে–
তব সুর বাজে মোর গানে,
কবির অন্তরে তুমি কবি–
নও ছবি, নও ছবি, নও শুধু ছবি॥
তোমরা হাসিয়া বহিয়া চলিয়া যাও
তোমরা হাসিয়া বহিয়া চলিয়া যাও কুলুকুলুকল নদীর স্রোতের মতো।
আমরা তীরেতে দাঁড়ায়ে চাহিয়া থাকি, মরমে গুমরি মরিছে কামনা কত।
আপনা-আপনি কানাকানি কর সুখে, কৌতুকছটা উছলিছে চোখে মুখে,
কমলচরণ পড়িছে ধরণী-মাঝে, কনকপুর রিনিকি ঝিনিকি বাজে॥
অঙ্গে অঙ্গ বাঁধিছ রঙ্গপাশে, বাহুতে বাহুতে জড়িত ললিত লতা।
ইঙ্গিতরসে ধ্বনিয়া উঠিছে হাসি, নয়নে নয়নে বহিছে গোপন কথা।
আঁখি নত করি একেলা গাঁথিছ ফুল, মুকুর লইয়া যতনে বাঁধিছ চুল।
গোপন হৃদয়ে আপনি করিছ খেলা–
কী কথা ভাবিছ, কেমনে কাটিছে বেলা ॥
আমরা বৃহৎ অবোধ ঝড়ের মতো আপন আবেগে ছুটিয়া চলিয়া আসি,
বিপুল আঁধারে অসীম আকাশ ছেয়ে টুটিবারে চাহি আপন হৃদয়রাশি।
তোমরা বিজুলি হাসিতে হাসিতে চাও, আঁধার ছেদিয়া মরম বিঁধিয়া দাও–
গগনের গায়ে আগুনের রেখা আঁকি চকিত চরণে চলে যাও দিয়ে ফাঁকি॥
অযতনে বিধি গড়েছে মোদের দেহ, নয়ন অধর দেয় নি ভাষায় ভরে–
মোহনমধুর মন্ত্র জানি নে মোরা, আপনা প্রকাশ করিব কেমন ক’রে।
তোমরা কোথায় আমরা কোথায় আছি,
কোনো সুলগনে হব না কি কাছাকাছি–
তোমরা হাসিয়া বহিয়া চলিয়া যাবে, আমরা দাঁড়ায়ে রহিব এমনি ভাবে॥
তোমাদের দান যশের ডালায়
তোমাদের দান যশের ডালায় সব-শেষ সঞ্চয় আমার–
নিতে মনে লাগে ভয়॥
এই রূপলোকে কবে এসেছিনু রাতে,
গেঁথেছিনু মালা ঝ’রে-পড়া পারিজাতে,
আঁধারে অন্ধ– এ যে গাঁথা তারি হাতে–
কী দিল এ পরিচয়॥
এরে পরাবে কি কলালক্ষ্মীর গলে
সাতনরী হারে যেথায় মানিক জ্বলে।
একদা কখন অমরার উৎসবে
ম্লান ফুলদল খসিয়া পড়িবে কবে,
এ আদর যদি লজ্জার পরাভবে
সে দিন মলিন হয়॥
তোমার আসন শূন্য আজি
তোমার আসন শূন্য আজি, হে বীর পূর্ণ করো,
ঐ যে দেখি বসুন্ধরা কাঁপল থরোথরো।
বাজল তূর্য আকাশপথে– সূর্য আসেন অগ্নিরথে আকাশপথে,
এই প্রভাতে দখিন হাতে বিজয়খড়্গ ধরো।
ধর্ম তোমার সহায়, তোমার সহায় বিশ্ববাণী।
অমর বীর্য সহায় তোমার, সহায় বজ্রপাণি।
দুর্গম পথ সগৌরবে তোমার চরণচিহ্ন লবে সগৌরবে–
চিত্তে অভয় বর্ম, তোমার বক্ষে তাহাই পরো॥