কেন যে মন ভোলে আমার
কেন যে মন ভোলে আমার মন জানে না।
তারে মানা করে কে, আমার মন মানে না ॥
কেউ বোঝে না তারে, সে যে বোঝে না আপ্নারে।
সবাই লজ্জা দিয়ে যায়, সে তো কানে আনে না ॥
তার খেয়া গেল পারে, সে যে রইল নদীর ধারে।
কাজ ক’রে সব সারা ওই এগিয়ে গেল কারা,
আন্মনা মন সে দিক-পানে দৃষ্টি হানে না ॥
কোথায় ফিরিস পরম শেষের অন্বেষণে
কোথায় ফিরিস পরম শেষের অন্বেষণে।
অশেষ হয়ে সেই তো আছে এই ভুবনে॥
তারি বাণী দু হাত বাড়ায় শিশুর বেশে,
আধো ভাষায় ডাকে তোমার বুকে এসে,
তারি ছোঁওয়া লেগেছে ওই কুসুমবনে॥
কোথায় ফিরিস ঘরের লোকের অন্বেষণে–
পর হয়ে সে দেয় যে দেখা ক্ষণে ক্ষণে।
তার বাসা-যে সকল ঘরের বাহির-দ্বারে,
তার আলো যে সকল পথের ধারে ধারে,
তাহারি রূপ গোপন রূপে জনে জনে॥
কোন্ সুদূর হতে আমার মনোমাঝে
কোন্ সুদূর হতে আমার মনোমাঝে
বাণীর ধারা বহে– আমার প্রাণে প্রাণে।
আমি কখন্ শুনি, কখন্ শুনি না যে,
কখন্ কী যে কহে– আমার কানে কানে॥
আমার ঘুমে আমার কোলাহলে
আমার আঁখি-জলে তাহারি সুর,
তাহারি সুর জীবন-গুহাতলে
গোপন গানে রহে– আমার কানে কানে॥
কোন্ ঘন গহন বিজন তীরে তীরে
তাহার ভাঙা গড়া– ছায়ার তলে তলে।
আমি জানি না কোন্ দক্ষিণসমীরে
তাহার ওঠা পড়া– ঢেউয়ের ছলোছলে।
এই ধরণীরে গগন-পারের ছাঁদে সে যে তারার সাথে বাঁধে,
সুখের সাথে দুখ মিলায়ে কাঁদে
‘এ নহে এই নহে– নহে নহে, এ নহে এই নহে’–
কাঁদে কানে কানে॥
খরবায়ু বয় বেগে চারি দিক ছায় মেঘে
খরবায়ু বয় বেগে, চারি দিক ছায় মেঘে,
ওগো নেয়ে, নাওখানি বাইয়ো।
তুমি কষে ধরো হাল, আমি তুলে বাঁধি পাল–
হাঁই মারো, মারো টান হাঁইয়ো॥
শৃঙ্খলে বারবার ঝন্ঝন্ ঝঙ্কার, নয় এ তো তরণীর ক্রন্দন শঙ্কার–
বন্ধন দুর্বার সহ্য না হয় আর, টলমল করে আজ তাই ও।
হাঁই মারো, মারো টান হাঁইয়ো॥
গণি গণি দিন খন চঞ্চল করি মন
বোলো না, ‘যাই কি নাহি যাই রে’।
সংশয়পারাবার অন্তরে হবে পার,
উদ্বেগে তাকায়ো না বাইরে।
যদি মাতে মহাকাল, উদ্দাম জটাজাল ঝড়ে হয় লুণ্ঠিত, ঢেউ উঠে উত্তাল,
হোয়ো নাকো কুণ্ঠিত, তালে তার দিয়ো তাল– জয়-জয় জয়গান গাইয়ো।
হাঁই মারো, মারো টান হাঁইয়ো॥
খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি আমার মনের ভিতরে
খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি আমার মনের ভিতরে।
কত রাত তাই তো জেগেছি বলব কী তোরে॥
প্রভাতে পথিক ডেকে যায়, অবসর পাই নে আমি হায়–
বাহিরের খেলায় ডাকে সে, যাব কী ক’রে॥
যা আমার সবার হেলাফেলা যাচ্ছে ছড়াছড়ি
পুরোনো ভাঙা দিনের ঢেলা, তাই দিয়ে ঘর গড়ি।
যে আমার নতুন খেলার জন তারি এই খেলার সিংহাসন,
ভাঙারে জোড়া দেবে সে কিসের মন্তরে॥
গগনে গগনে ধায় হাঁকি
গগনে গগনে ধায় হাঁকি
বিদ্যুতবাণী বজ্রবাহিনী বৈশাখী,
স্পর্ধাবেগের ছন্দ জাগায় বনস্পতির শাখাতে॥
শূন্যমদের নেশায় মাতাল ধায় পাখি,
অলখ পথের ছন্দ উড়ায় মুক্তবেগের পাখাতে॥
অন্তরতল মন্থন করে ছন্দে
সাদা কালোর দ্বন্দ্বে,
কভু ভালো কভু মন্দে,
কভু সোজা কভু বাঁকাতে।
ছন্দ নাচিল হোমবহ্নির তরঙ্গে,
মুক্তিরণের যোদ্ধৃবীরের ভ্রুভঙ্গে,
ছন্দ ছুটিল প্রলয়পথের রুদ্ররথের চাকাতে॥
গোপন প্রাণে একলা মানুষ যে
গোপন প্রাণে একলা মানুষ যে
তারে কাজের পাকে জড়িয়ে রাখিস নে॥
তার একলা ঘরের ধেয়ান হতে উঠুক-না গান নানা স্রোতে,
তার আপন সুরের ভুবন-মাঝে তারে থাকতে দে॥
তোর প্রাণের মাঝে একলা মানুষ যে
তারে দশের ভিড়ে ভিড়িয়ে রাখিস নে।
কোন্ আরেক একা ওরে খোঁজে, সেই তো ওরই দরদ বোঝে–
যেন পথ খুঁজে পায়, কাজের ফাঁকে ফিরে না যায় সে॥
গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ
গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ আমার মন ভুলায় রে।
ওরে কার পানে মন হাত বাড়িয়ে লুটিয়ে যায় ধুলায় রে॥
ও যে আমায় ঘরের বাহির করে, পায়ে-পায়ে পায়ে ধরে–
ও যে কেড়ে আমায় নিয়ে যায় রে যায় রে কোন্ চুলায় রে।
ও যে কোন্ বাঁকে কী ধন দেখাবে, কোন্খানে কী দায় ঠেকাবে–
কোথায় গিয়ে শেষ মেলে যে ভেবেই না কুলায় রে॥
চাহিয়া দেখো রসের স্রোতে রঙের খেলাখানি
চাহিয়া দেখো রসের স্রোতে রঙের খেলাখানি।
চেয়ো না চেয়ো না তারে নিকটে নিতে টানি॥
রাখিতে চাহ, বাঁধিতে চাহ যাঁরে,
আঁধারে তাহা মিলায় মিলায় বারে বারে–
বাজিল যাহা প্রাণের বীণা-তারে
সে তো কেবলই গান কেবলই বাণী॥
পরশ তার নাহি রে মেলে, নাহি রে পরিমাণ–
দেবসভায় যে সুধা করে পান।
নদীর স্রোতে, ফুলের বনে বনে,
মাধুরী-মাখা হাসিতে আঁখিকোণে,
সে সুধাটুকু পিয়ো আপন-মনে–
মুক্তরূপে নিয়ো তাহারে জানি॥
চোখ যে ওদের ছুটে চলে গো
চোখ যে ওদের ছুটে চলে গো —
ধনের বাটে, মানের বাটে, রূপের হাটে, দলে দলে গো॥
দেখবে ব’লে করেছে পণ, দেখবে কারে জানে না মন–
প্রেমের দেখা দেখে যখন চোখ ভেসে যায় চোখের জলে গো॥
আমায় তোরা ডাকিস না রে–
আমি যাব খেয়ার ঘাটে অরূপ-রসের পারাবারে।
উদাস হাওয়া লাগে পালে, পারের পানে যাবার কালে
চোখদুটোরে ডুবিয়ে যাব অকূল সুধা-সাগর তলে গো॥
ছিল যে পরানের অন্ধকারে
ছিল যে পরানের অন্ধকারে
এল সে ভুবনের আলোক-পারে॥
স্বপনবাধা টুটি বাহিরে এল ছুটি,
অবাক্ আঁখি দুটি হেরিল তারে॥
মালাটি গেঁথেছিনু অশ্রুধারে,
তারে যে বেঁধেছিনু সে মায়াহারে।
নীরব বেদনায় পূজিনু যারে হায়
নিখিল তারি গায় বন্দনা রে॥