ওর ভাব দেখে যে পায় হাসি
ওর ভাব দেখে যে পায় হাসি, হায় হায় রে।
মরণ-আয়োজনের মাঝে বসে আছেন কিসের কাজে
কোন্ প্রবীণ প্রাচীন প্রবাসী। হায় হায় রে।
এবার দেশে যাবার দিনে আপনাকে ও নিক-না চিনে,
সবাই মিলে সাজাও ওকে নবীন রূপের সন্ন্যাসী। হায় হায় রে।
এবার ওকে মজিয়ে দে রে হিসাব-ভুলের বিষম ফেরে।
কেড়ে নে ওর থলি-থালি, আয় রে নিয়ে ফুলের ডালি,
গোপন প্রাণের পাগ্লাকে ওর বাইরে দে আজ প্রকাশি। হায় হায় রে॥
ওরে প্রজাপতি মায়া দিয়ে কে
ওরে প্রজাপতি, মায়া দিয়ে কে যে পরশ করল তোরে
অস্তরবির তুলিখানি চুরি ক’রে॥
হাওয়ার বুকে যে চঞ্চলের গোপন বাসা
বনে বনে বয়ে বেড়াস তারি ভাষা,
অপ্সরীদের দোলের খেলার ফুলের রেণু
পাঠায় কে তোর পাখায় ভ’রে॥
যে গুণী তার কীর্তিনাশার বিপুল নেশায়
চিকন রেখার লিখন মেলে শূন্যে মেশায়,
সুর বাঁধে আর সুর যে হারায় পলে পলে–
গান গেয়ে যে চলে তারা দলে দলে–
তার হারা সুর নাচের নেশায়
ডানাতে তোর পড়ল ঝরে॥
ওরে শিকল তোমায় কোলে করে দিয়েছি ঝঙ্কার
ওরে শিকল, তোমায় কোলে করে দিয়েছি ঝঙ্কার।
তুমি আনন্দে ভাই রেখেছিলে ভেঙে অহঙ্কার।
তোমায় নিয়ে ক’রে খেলা সুখে দুঃখে কাটল বেলা–
অঙ্গ বেড়ি দিলে বেড়ী বিনা দামের অলঙ্কার॥
তোমার ‘পরে করি নে রোষ, দোষ থাকে তো আমারি দোষ–
ভয় যদি রয় আপন মনে তোমায় দেখি ভয়ঙ্কর।
অন্ধকারে সারা রাতি ছিলে আমার সাথের সাথি,
সেই দয়াটি স্মরি তোমায় করি নমস্কার॥
ওরে সাবধানী পথিক
ওরে সাবধানী পথিক, বারেক পথ ভুলে মরো ফিরে।
খোলা আঁখি-দুটো অন্ধ করে দে আকুল আঁখির নীরে॥
সে ভোলা পথের প্রান্তে রয়েছে হারানো হিয়ার কুঞ্জ,
ঝ’রে প’ড়ে আছে কাঁটা-তরুতলে রক্তকুসুমপুঞ্জ–
সেথা দুই বেলা ভাঙা-গড়া-খেলা অকূলসিন্ধুতীরে॥
অনেক দিনের সঞ্চয় তোর আগুলি আছিস বসে,
ঝড়ের রাতের ফুলের মতন ঝরুক পড়ুক খসে।
আয় রে এবার সব-হারাবার জয়মালা পরো শিরে।
ওরে ওরে ওরে আমার মন মেতেছে
ওরে ওরে ওরে, আমার মন মেতেছে,
তারে আজ থামায় কে রে।
সে যে আকাশ-পানে হাত পেতেছে,
তারে আজ নামায় কে রে।
ওরে ওরে ওরে, আমার মন মেতেছে, আমারে থামায় কে রে॥
ওরে ভাই, নাচ্ রে ও ভাই, নাচ্ রে–
আজ ছাড়া পেয়ে বাঁচ্ রে–
লাজ ভয় ঘুচিয়ে দে রে।
তোরে আজ থামায় কে রে॥
ওরে মাঝি ওরে আমার মানবজন্মতরীর মাঝি
ওরে মাঝি, ওরে আমার মানবজন্মতরীর মাঝি,
শুনতে কি পাস দূরের থেকে পারের বাঁশি উঠছে বাজি॥
তরী কি তোর দিনের শেষে ঠেকবে এবার ঘাটে এসে।
সেথায় সন্ধ্যা-অন্ধকারে দেয় কি দেখা প্রদীপরাজি॥
যেন আমার লাগে মনে মন্দ-মধুর এই পবনে
সিন্ধুপারের হাসিটি কার আঁধার বেয়ে আসছে আজি।
আসার বেলায় কুসুমগুলি কিছু এনেছিলেম তুলি,
যেগুলি তার নবীন আছে এই বেলা নে সাজিয়ে সাজি॥
ওরে যেতে হবে আর দেরি নাই
ওরে, যেতে হবে, আর দেরি নাই।
পিছিয়ে পড়ে রবি কত, সঙ্গীরা যে গেল সবাই॥
আয় রে ভবের খেলা সেরে, আঁধার করে এসেছে রে,
পিছন ফিরে বারে বারে কাহার পানে চাহিস রে ভাই॥
খেলতে এল ভবের নাটে নতুন লোকে নতুন খেলা।
হেথা হতে আয় রে সরে, নইলে তোরে মারবে ঢেলা।
নামিয়ে দে রে প্রাণের বোঝা, আরেক দেশে চল্ রে সোজা–
সেথা নতুন করে বাঁধবি বাসা,
নতুন খেলা খেলবি সে ঠাঁই॥
কঠিন লোহা কঠিন ঘুমে ছিল অচেতন
কঠিন লোহা কঠিন ঘুমে ছিল অচেতন, ও তার ঘুম ভাঙাইনু রে।
লক্ষ যুগের অন্ধকারে ছিল সঙ্গোপন, ওগো, তায় জাগাইনু রে॥
পোষ মেনেছে হাতের তলে যা বলাই সে তেমনি বলে–
দীর্ঘ দিনের মৌন তাহার আজ ভাগাইনু রে॥
অচল ছিল, সচল হয়ে ছুটেছে ওই জগৎ-জয়ে–
নির্ভয়ে আজ দুই হাতে তার রাশ বাগাইনু রে॥
কমলবনের মধুপরাজি
কমলবনের মধুপরাজি, এসো হে কমলভবনে।
কী সুধাগন্ধ এসেছে আজি নববসন্তপবনে॥
অমল চরণ ঘেরিয়া পুলকে শত শতদল ফুটিল,
বারতা তাহারি দ্যুলোকে ভূলোকে ছুটিল ভুবনে ভুবনে॥
গ্রহে তারকায় কিরণে কিরণে বাজিয়া উঠিছে রাগিণী
গীতগুঞ্জন কূজনকাকলি আকুলি উঠিছে শ্রবণে।
সাগর গাহিছে কল্লোলগাথা, বায়ু বাজাইছে শঙ্খ–
সামগান উঠে বনপল্লবে, মঙ্গলগীত জীবনে॥
কাঁটাবনবিহারিণী সুর-কানা দেবী
কাঁটাবনবিহারিণী সুর-কানা দেবী
তাঁরি পদ সেবি, করি তাঁহারই ভজনা
বদ্কণ্ঠলোকবাসী আমরা কজনা ॥
আমাদের বৈঠক বৈরাগীপুরে রাগ-রাগিণীর বহু দূরে,
গত জনমের সাধনেই বিদ্যা এনেছি সাথে এই গো
নিঃসুর-রসাতল-তলায় মজনা ॥
সতেরো পুরুষ গেছে, ভাঙা তম্বুরা
রয়েছে মর্চে ধরি বেসুর-বিধুরা।
বেতার সেতার দুটো, তবলাটা ফাটা-ফুটো,
সুরদলনীর করি এ নিয়ে যজনা–
আমরা কল্পনা ॥
কী পাই নি তারি হিসাব মিলাতে
কী পাই নি তারি হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজি।
আজ হৃদয়ের ছায়াতে আলোতে বাঁশরি উঠেছে বাজি॥
ভালোবেসেছিনু এই ধরণীরে সেই স্মৃতি মনে আসে ফিরে ফিরে,
কত বসন্তে দখিনসমীরে ভরেছে আমারি সাজি॥
নয়নের জল গভীর গহনে আছে হৃদয়ের স্তরে,
বেদনার রসে গোপনে গোপনে সাধনা সফল করে।
মাঝে মাঝে বটে ছিঁড়েছিল তার, তাই নিয়ে কেবা করে হাহাকার–
সুর তবু লেগেছিল বারে-বার মনে পড়ে তাই আজি॥
কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি
কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।
মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে কালো মেঘের কালো হরিণ-চোখ।
ঘোমটা মাথায় ছিল না তার মোটে, মুক্তবেণী পিঠের ‘পরে লোটে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।
ঘন মেঘে আঁধার হল দেখে ডাকতেছিল শ্যামল দুটি গাই,
শ্যামা মেয়ে ব্যস্ত ব্যাকুল পদে কুটির হতে ত্রস্ত এল তাই।
আকাশ-পানে হানি যুগল ভুরু শুনলে বারেক মেঘের গুরুগুরু।
কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।
পূবে বাতাস এল হঠাৎ ধেয়ে, ধানের ক্ষেতে খেলিয়ে গেল ঢেউ।
আলের ধারে দাঁড়িয়েছিলেম একা, মাঠের মাঝে আর ছিল না কেউ।
আমার পানে দেখলে কি না চেয়ে আমি জানি আর জানে সেই মেয়ে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।
এমনি করে কালো কাজল মেঘ জ্যৈষ্ঠ মাসে আসে ঈশান কোণে।
এমনি করে কালো কোমল ছায়া আষাঢ় মাসে নামে তমাল-বনে।
এমনি করে শ্রাবণ-রজনীতে হঠাৎ খুশি ঘনিয়ে আসে চিতে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।
কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, আর যা বলে বলুক অন্য লোক।
দেখেছিলেম ময়নাপাড়ার মাঠে কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।
মাথার ‘পরে দেয় নি তুলে বাস, লজ্জা পাবার পায় নি অবকাশ।
কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ॥