এসো গো নূতন জীবন
এসো গো নূতন জীবন।
এসো গো কঠোর নিঠুর নীরব, এসো গো ভীষণ শোভন॥
এসো অপ্রিয় বিরস তিক্ত, এসো গো অশ্রুসলিলসিক্ত,
এসো গো ভূষণবিহীন রিক্ত, এসো গো চিত্তপাবন॥
থাক্ বীণাবেণু, মালতীমালিকা পূর্ণিমানিশি, মায়াকুহেলিকা–
এসো গো প্রখর হোমানলশিখা হৃদয়শোণিতপ্রাশন।
এসো গো পরমদুঃখনিলয়, আশা-অঙ্কুর করহ বিলয়–
এসো সংগ্রাম, এসো মহাজয়, এসো গো মরণসাধন॥
ও কি এল, ও কি এল না
ও কি এল, ও কি এল না, বোঝা গেল না–
ও কি মায়া কি স্বপনছায়া, ও কি ছলনা ॥
ধরা কি পড়ে ও রূপেরই ডোরে,
গানেরই তানে কি বাঁধিবে ওরে–
ও যে চিরবিরহেরই সাধনা ॥
ওর বাঁশিতে করুণ কী সুর লাগে
বিরহমিলনমিলিত রাগে।
সুখে কি দুখে ও পাওয়া না-পাওয়া,
হৃদয়বনে ও উদাসী হাওয়া,
বুঝি শুধু ও পরমকামনা ॥
ও জোনাকী, কী সুখে ওই ডানা দুটি মেলেছ
ও জোনাকী, কী সুখে ওই ডানা দুটি মেলেছ।
আঁধার সাঁঝে বনের মাঝে উল্লাসে প্রাণ ঢেলেছ॥
তুমি নও তো সূর্য, নও তো চন্দ্র, তোমার তাই ব’লে কি কম আনন্দ।
তুমি আপন জীবন পূর্ণ ক’রে আপন আলো জ্বেলেছ॥
তোমার যা আছে তা তোমার আছে, তুমি নও গো ঋণী কারো কাছে,
তোমার অন্তরে যে শক্তি আছে তারি আদেশ পেলেছ।
তুমি আঁধার-বাঁধন ছাড়িয়ে ওঠ, তুমি ছোটো হয়ে নও গো ছোটো,
জগতে যেথায় যত আলো সবায় আপন ক’রে ফেলেছ॥
ও ভাই কানাই কারে জানাই দুঃসহ মোর দুঃখ
ও ভাই কানাই, কারে জানাই দুঃসহ মোর দুঃখ।
তিনটে-চারটে পাস করেছি, নই নিতান্ত মুক্খ॥
তুচ্ছ সা-রে-গা-মা’য় আমায় গলদ্ঘর্ম ঘামায়।
বুদ্ধি আমার যেমনি হোক কান দুটো নয় সূক্ষ্ম–
এই বড়ো মোর দুঃখ কানাই রে,
এই বড়ো মোর দুঃখ॥
বান্ধবীকে গান শোনাতে ডাকতে হয় সতীশকে,
হৃদয়খানা ঘুরে মরে গ্রামোফোনের ডিস্কে।
কণ্ঠখানার জোর আছে তাই লুকিয়ে গাইতে ভরসা না পাই–
স্বয়ং প্রিয়া বলেন, ‘তোমার গলা বড়োই রুক্ষ’
এই বড়ো মোর দুঃখ কানাই রে,
এই বড়ো মোর দুঃখ॥
ওই সাগরের ঢেউয়ে ঢেউয়ে বাজল ভেরী
ওই সাগরের ঢেউয়ে ঢেউয়ে বাজল ভেরী, বাজল ভেরী।
কখন্ আমার খুলবে দুয়ার– নাইকো দেরি, নাইকো দেরি॥
তোমার তো নয় ঘরের মেলা, কোণের খেলা গো–
তোমার সঙ্গে বিষম রঙ্গে জগৎ জুড়ে ফেরাফেরি॥
মরণ তোমার পারের তরী, কাঁদন তোমার পালের হাওয়া–
তোমার বীণা বাজায় প্রাণে বেরিয়ে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া।
ভাঙল যাহা পড়ল ধুলায় যাক্-না চুলায় গো–
ভরল যা তাই দেখ্-না, রে ভাই, বাতাস ঘেরি, আকাশ ঘেরি॥
ওগো তোমরা সবাই ভালো
ওগো, তোমরা সবাই ভালো–
যার অদৃষ্টে যেমনি জুটেছে, সেই আমাদের ভালো–
আমাদের এই আঁধার ঘরে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালো ॥
কেউ বা অতি জ্বলো-জ্বলো, কেউ বা ম্লান’ ছলো-ছলো,
কেউ বা কিছু দহন করে, কেউ বা স্নিগ্ধ আলো ॥
নূতন প্রেমে নূতন বধূ আগাগোড়া কেবল মধু,
পুরাতনে অম্ল-মধুর একটুকু ঝাঁঝালো।
বাক্য যখন বিদায় করে চক্ষু এসে পায়ে ধরে,
রাগের সঙ্গে অনুরাগে সমান ভাগে ঢালো ॥
আমরা তৃষ্ঞা, তোমরা সুধা– তোমরা তৃপ্তি, আমরা ক্ষুধা–
তোমার কথা বলতে কবির কথা ফুরালো।
যে মূর্তি নয়নে জাগে সবই আমার ভালো লাগে–
কেউ বা দিব্যি গৌরবরন, কেউ বা দিব্যি কালো ॥
ওগো ভাগ্যদেবী পিতামহী
ওগো ভাগ্যদেবী পিতামহী, মিটল আমার আশ–
এখন তবে আজ্ঞা করো, বিদায় হবে দাস।
জীবনের এই বাসরবাতি পোহায় বুঝি, নেবে বাতি–
বধূর দেখা নাইকো, শুধু প্রচুর পরিহাস।
এখন থেমে গেল বাঁশি, শুকিয়ে এল পুষ্পরাশি,
উঠল তোমার অট্টহাসি কাঁপায়ে আকাশ।
ছিলেন যাঁরা আমায় ঘিরে গেছেন যে যার ঘরে ফিরে,
আছ বৃদ্ধা ঠাকুরানী মুখে টানি বাস॥
ওগো তোরা কে যাবি পারে
ওগো, তোরা কে যাবি পারে।
আমি তরী নিয়ে বসে আছি নদীকিনারে॥
ও পারেতে উপবনে
কত খেলা কত জনে,
এ পারেতে ধু ধু মরু বারি বিনা রে॥
এই বেলা বেলা আছে, আয় কে যাবি।
মিছে কেন কাটে কাল কত কী ভাবি।
সূর্য পাটে যাবে নেমে,
সুবাতাস যাবে থেমে,
খেয়া বন্ধ হয়ে যাবে সন্ধ্যা-আঁধারে॥
ওগো নদী আপন বেগে পাগল-পারা
ওগো নদী, আপন বেগে পাগল-পারা,
আমি স্তব্ধ চাঁপার তরু গন্ধভরে তন্দ্রাহারা॥
আমি সদা অচল থাকি, গভীর চলা গোপন রাখি,
আমার চলা নবীন পাতায়, আমার চলা ফুলের ধারা॥
ওগো নদী, চলার বেগে পাগল-পারা,
পথে পথে বাহির হয়ে আপন-হারা–
আমার চলা যায় না বলা– আলোর পানে প্রাণের চলা–
আকাশ বোঝে আনন্দ তার, বোঝে নিশার নীরব তারা॥
ওগো পুরবাসী আমি দ্বারে দাঁড়ায়ে
ওগো পুরবাসী,
আমি দ্বারে দাঁড়ায়ে আছি উপবাসী॥
হেরিতেছি সুখমেলা, ঘরে ঘরে কত খেলা,
শুনিতেছি সারা বেলা সুমধুর বাঁশি॥
চাহি না অনেক ধন, রব না অধিক ক্ষণ,
যেথা হতে আসিয়াছি সেথা যাব ভাসি–
তোমরা আনন্দে রবে নব নব উৎসবে,
কিছু ম্লান নাহি হবে গৃহভরা হাসি॥
ওঠো রে মলিনমুখ, চলো এইবার
ওঠো রে মলিনমুখ, চলো এইবার।
এসো রে তৃষিত-বুক, রাখো হাহাকার॥
হেরো ওই গেল বেলা, ভাঙিল ভাঙিল মেলা–
গেল সবে ছাড়ি খেলা ঘরে যে যাহার॥
হে ভিখারি, কারে তুমি শুনাইছ সুর–
রজনী আঁধার হল, পথ অতি দূর।
ক্ষুধিত তৃষিত প্রাণে আর কাজ নাহি গানে–
এখন বেসুর তানে বাজিছে সেতার॥