আমি চঞ্চল হে
আমি চঞ্চল হে,
আমি সুদূরের পিয়াসি।
দিন চলে যায়, আমি আনমনে তারি আশা চেয়ে থাকি বাতায়নে–
ওগো, প্রাণে মনে আমি যে তাহার পরশ পাবার প্রয়াসী॥
ওগো সুদূর, বিপুল সুদূর, তুমি যে বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি–
মোর ডানা নাই, আছি এক ঠাঁই সে কথা যে যাই পাশরি॥
আমি উন্মনা হে,
হে সুদূর, আমি উদাসী॥
রৌদ্র-মাখানো অলস বেলায় তরুমর্মরে ছায়ার খেলায়
কী মুরতি তব নীল আকাশে নয়নে উঠে গো আভাসি।
হে সুদূর, আমি উদাসী।
ওগো সুদূর, বিপুল সুদূর, তুমি যে বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি–
কক্ষে আমার রুদ্ধ দুয়ার সে কথা যে যাই পাশরি॥
আমিই শুধু রইনু বাকি
আমিই শুধু রইনু বাকি।
যা ছিল তা গেল চলে, রইল যা তা কেবল ফাঁকি॥
আমার ব’লে ছিল যারা আর তো তারা দেয় না সাড়া–
কোথায় তারা, কোথায় তারা, কেঁদে কেঁদে কারে ডাকি॥
বল্ দেখি মা শুধাই তোরে– আমার কিছু রাখলি নে রে,
আমি কেবল আমায় নিয়ে কোন্ প্রাণেতে বেঁচে থাকি॥
আলো আমার আলো ওগো আলো ভুবন-ভরা
আলো আমার, আলো ওগো, আলো ভুবন-ভরা।
আলো নয়ন-ধোওয়া আমার, আলো হৃদয়-হরা॥
নাচে আলো নাচে, ও ভাই, আমার প্রাণের কাছে–
বাজে আলো বাজে, ও ভাই হৃদয়বীণার মাঝে–
জাগে আকাশ, ছোটে বাতাস, হাসে সকল ধরা॥
আলোর স্রোতে পাল তুলেছে হাজার প্রজাপতি।
আলোর ঢেউয়ে উঠল নেচে মল্লিকা মালতী।
মেঘে মেঘে সোনা, ও ভাই, যায় না মানিক গোনা–
পাতায় পাতায় হাসি, ও ভাই, পুলক রাশি রাশি–
সুরনদীর কূল ডুবেছে সুধা-নিঝর-ঝরা॥
আলোক-চোরা লুকিয়ে এল ওই
আলোক-চোরা লুকিয়ে এল ওই–
তিমিরজয়ী বীর, তোরা আজ কই।
এই কুয়াশা-জয়ের দীক্ষা কাহার কাছে লই॥
মলিন হল শুভ্র বরন, অরুণ-সোনা করল হরণ,
লজ্জা পেয়ে নীরব হল উষা জ্যোতির্ময়ী॥
সুপ্তিসাগরতীরে বেয়ে সে এসেছে মুখ ঢেকে,
অঙ্গে কালি মেখে।
রবির রশ্মি কই গো তোরা, কোথায় আঁধার-ছেদন ছোরা,
উদয়শৈলশৃঙ্গ হতে বল্ “মাভৈঃ মাভৈঃ’॥
আয় আয় রে পাগল
আয় আয় রে পাগল, ভুলবি রে চল্ আপনাকে,
তোর একটুখানির আপনাকে॥
তুই ফিরিস নে আর এই চাকাটার ঘুরপাকে॥
কোন্ হঠাৎ হাওয়ার ঢেউ উঠে
তোর ঘরের আগল যায় টুটে,
ওরে সুযোগ ধরিস, বেরিয়ে পড়িস সেই ফাঁকে–
তোর দুয়ার-ভাঙার সেই ফাঁকে॥
নানান গোলে তুফান তোলে চার দিকে–
তুই বুঝিস নে, মন, ফিরবি কখন কার দিকে।
তোর আপন বুকের মাঝখানে
কী যে বাজায় কে যে সেই জানে–
ওরে পথের খবর মিলবে রে তোর সেই ডাকে–
তোর আপন বুকের সেই ডাকে॥
এ শুধু অলস মায়া
এ শুধু অলস মায়া, এ শুধু মেঘের খেলা,
এ শুধু মনের সাধ বাতাসেতে বিসর্জন।
এ শুধু আপনমনে মালা গেঁথে ছিঁড়ে ফেলা,
নিমেষের হাসিকান্না গান গেয়ে সমাপন।
শ্যামল পল্লবপাতে রবিকরে সারা বেলা
আপনারই ছায়া লয়ে খেলা করে ফুলগুলি–
এও সেই ছায়াখেলা বসন্তের সমীরণে।
কুহকের দেশে যেন সাধ ক’রে পথ ভুলি
হেথা হোথা ঘুরি ফিরি সারা দিন আনমনে।
কারে যেন দেব’ ব’লে কোথা যেন ফুল তুলি–
সন্ধ্যায় মলিন ফুল উড়ে যায় বনে বনে।
এ খেলা খেলিবে, হায়, খেলার সাথি কে আছে।
ভুলে ভুলে গান গাই– কে শোনে, কে নাই শোনে–
যদি কিছু মনে পড়ে, যদি কেহ আসে কাছে॥
এই তো ভালো লেগেছিল আলোর নাচন
এই তো ভালো লেগেছিল আলোর নাচন পাতায় পাতায়।
শালের বনে খ্যাপা হাওয়া, এই তো আমার মনকে মাতায়।
রাঙা মাটির রাস্তা বেয়ে হাটের পথিক চলে ধেয়ে,
ছোটো মেয়ে ধুলায় বসে খেলার ডালি একলা সাজায়–
সামনে চেয়ে এই যা দেখি চোখে আমার বীণা বাজায়॥
আমার এ যে বাঁশের বাঁশি, মাঠের সুরে আমার সাধন।
আমার মনকে বেঁধেছে রে এই ধরণীর মাটির বাঁধন।
নীল আকাশের আলোর ধারা পান করেছে নতুন যারা
সেই ছেলেদের চোখের চাওয়া নিয়েছি মোর দু চোখ পুরে–
আমার বীণায় সুর বেঁধেছি ওদের কচি গলার সুরে॥
দূরে যাবার খেয়াল হলে সবাই মোরে ঘিরে থামায়–
গাঁয়ের আকাশ সজনে ফুলের হাতছানিতে ডাকে আমায়।
ফুরায় নি, ভাই, কাছের সুধা, নাই যে রে তাই দূরের ক্ষুধা–
এই-যে এ-সব ছোটোখাটো পাই নি এদের কূলকিনারা।
তুচ্ছ দিনের গানের পালা আজও আমার হয় নি সারা ॥
লাগল ভালো, মন ভোলালো, এই কথাটাই গেয়ে বেড়াই–
দিনে রাতে সময় কোথা, কাজের কথা তাই তো এড়াই।
মজেছে মন, মজল আঁখি– মিথ্যে আমায় ডাকাডাকি–
ওদের আছে অনেক আশা, ওরা করুক অনেক জড়ো–
আমি কেবল গেয়ে বেড়াই, চাই নে হতে আরো বড়ো ॥
এবার যমের দুয়োর খোলা পেয়ে ছুটেছে সব ছেলেমেয়ে
এবার যমের দুয়োর খোলা পেয়ে ছুটেছে সব ছেলেমেয়ে।
হরিবোল হরি বোল হরিবোল॥
রাজ্য জুড়ে মস্ত খেলা, মরণ-বাঁচন-অবহেলা–
ও ভাই, সবাই মিলে প্রাণটা দিলে সুখ আছে কি মরার চেয়ে।
হরিবোল হরি বোল হরিবোল॥
বেজেছে ঢোল, বেজেছে ঢাক, ঘরে ঘরে পড়েছে ডাক,
এখন কাজকর্ম চুলোতে যাক– কেজো লোক সব আয় রে ধেয়ে।
হরিবোল হরি বোল হরিবোল॥
রাজা প্রজা হবে জড়ো থাকবে না আর ছোটো বড়ো–
একই স্রোতের মুখে ভাসবে সুখে বৈতরণীর নদী বেয়ে।
হরিবোল হরি বোল হরিবোল॥
এমনি ক’রেই যায় যদি দিন যাক না
এমনি ক’রেই যায় যদি দিন যাক না।
মন উড়েছে উড়ুক-না রে মেলে দিয়ে গানের পাখ্না ॥
আজকে আমার প্রাণ ফোয়ারার সুর ছুটেছে,
দেহের বাঁধ টুটেছে–
মাথার ‘পরে খুলে গেছে আকাশের ওই সুনীল ঢাক্না ॥
ধরণী আজ মেলেছে তার হৃদয়খানি,
সে যেন রে কাহার বাণী।
কঠিন মাটি মনকে আজি দেয় না বাধা।
সে কোন্ সুরে সাধা–
বিশ্ব বলে মনের কথা, কাজ প’ড়ে আজ থাকে থাক্-না॥।