আমার যাবার সময় হল
আমার যাবার সময় হল, আমায় কেন রাখিস ধরে।
চোখের জলের বাঁধন দিয়ে বাঁধিস নে আর মায়াডোরে॥
ফুরিয়েছে জীবনের ছুটি, ফিরিয়ে নে তোর নয়ন দুটি–
নাম ধরে আর ডাকিস নে ভাই, যেতে হবে ত্বরা করে॥
আমারে বাঁধবি তোরা
আমারে বাঁধবি তোরা সেই বাঁধন কি তোদের আছে।
আমি যে বন্দী হতে সন্ধি করি সবার কাছে॥
সন্ধ্যা আকাশ বিনা ডোরে বাঁধল মোরে গো,
নিশিদিন বন্ধহারা নদীর ধারা আমায় যাচে।
যে কুসুম আপনি ফোটে, আপনি ঝরে, রয় না ঘরে গো–
তারা যে সঙ্গী আমার, বন্ধু আমার, চায় না পাছে॥
আমারে ধরবি ব’লে মিথ্যে সাধা।
আমি যে নিজের কাছে নিজের গানের সুরে বাঁধা।
আপনি যাহার প্রাণ দুলিল, মন ভুলিল গো–
সে মানুষ আগুন-ভরা, পড়লে ধরা সে কি বাঁচে।
সে যে ভাই, হাওয়ার সখা, ঢেউয়ের সাথি, দিবারাতি গো
কেবলই এড়িয়ে চলার ছন্দে তাহার রক্ত নাচে॥
আমারে ডাক দিল কে ভিতর পানে
আমারে ডাক দিল কে ভিতর পানে–
ওরা যে ডাকতে জানে॥
আশ্বিনে ওই শিউলিশাখে
মৌমাছিরে যেমন ডাকে
প্রভাতে সৌরভের গানে॥
ঘরছাড়া আজ ঘর পেল যে, আপন মনে রইল ম’জে।
হাওয়ায় হাওয়ায় কেমন ক’রে খবর যে তার পৌঁছল রে
ঘর-ছাড়া ওই মেঘের কানে॥
আমায় ক্ষমো হে ক্ষমো
আমায় ক্ষমো হে ক্ষমো, নমো হে নমো, তোমায় স্মরি, হে নিরুপম,
নৃত্যরস চিত্ত মম উছল হয়ে বাজে॥
আমার সকল দেহের আকুল রবে মন্ত্রহারা তোমার স্তবে
ডাইনে বামে ছন্দ নামে নবজনমের মাঝে।
বন্দনা মোর ভঙ্গিতে আজ সঙ্গীতে বিরাজে॥
একি পরম ব্যথায় পরান কাঁপায়, কাঁপন বক্ষে লাগে।
শান্তিসাগরে ঢেউ খেলে যায়, সুন্দর তায় জাগে।
আমার সব চেতনা সব বেদনা রচিল এ যে কী আরাধনা–
তোমার পায়ে মোর সাধনা মরে না যেন লাজে।
বন্দনা মোর ভঙ্গিতে আজ সঙ্গীতে বিরাজে॥
কানন হতে তুলি নি ফুল, মেলে নি মোরে ফল।
কলস মম শূন্যসম, ভরি নি তীর্থজল।
আমার তনু তনুতে বাঁধনহারা হৃদয় ঢালে অধরা ধারা–
তোমার চরণে হোক তা সারা পূজার পুণ্য কাজে।
বন্দনা মোর ভঙ্গিতে আজ সঙ্গীতে বিরাজে॥
আমি একলা চলেছি এ ভবে
আমি একলা চলেছি এ ভবে,
আমায় পথের সন্ধান কে কবে।
ভয় নেই, ভয় নেই–
যাও আপন মনেই
যেমন একলা মধুপ ধেয়ে যায়
কেবল ফুলের সৌরভে॥
আমি শ্রাবণ-আকাশে ওই দিয়েছি পাতি
(আমি) শ্রাবণ-আকাশে ওই দিয়েছি পাতি
মম জল-ছলোছলো আঁখি মেঘে মেঘে॥
(আমার বেদনা ব্যাপিয়া যায় গো বেণুবনমর্মরে মর্মরে॥)
বিরহদিগন্ত পারায়ে সারা রাতি
অনিমেষে আছে জেগে মেঘে মেঘে॥
(বিরহের পরপারে খুঁজিছে আকুল আঁখি
মিলনপ্রতিমাখানি– খুঁজিছে।)
যে গিয়েছে দেখার বাহিরে
আছে তারি উদ্দেশে চাহি রে।
(সে যে চোখে মোর জল রেখে গেছে চোখের সীমানা পারায়ে।)
স্বপ্নে উড়িছে তারি কেশরাশি
পুরব-পবন-বেগে মেঘে মেঘে॥
(কেশের পরশ তার পাই রে
পুরব-পবন-বেগে মেঘে মেঘে।)
শ্যামল তমালবনে
যে পথে সে চলে গিয়েছিল বিদায়গোধূলিখনে
বেদনা জড়ায়ে আছে তারি ঘাসে–
(তার না-বলা কথার বেদনা বাজে গো–
চলার পথে পথে বাজে গো।)
কাঁপে নিশ্বাসে–
সেই বারে বারে ফিরে ফিরে চাওয়া
ছায়ায় রয়েছে লেগে মেঘে মেঘে॥
আমি কেবলই স্বপন করেছি বপন বাতাসে
আমি কেবলই স্বপন করেছি বপন বাতাসে–
তাই আকাশকুসুম করিনু চয়ন হতাশে॥
ছায়ার মতন মিলায় ধরণী, কূল নাহি পায় আশায় তরণী,
মানসপ্রতিমা ভাসিয়া বেড়ায় আকাশে॥
কিছু বাঁধা পড়িল না কেবলই বাসনা-বাঁধনে।
কেহ নাহি দিল ধরা শুধু এ সুদূর-সাধনে।
আপনার মনে বসিয়া একেলা অনলশিখায় কী করিনু খেলা,
দিনশেষে দেখি ছাই হল সব হুতাশে॥
আমি তোমারি মাটির কন্যা
আমি তোমারি মাটির কন্যা, জননী বসুন্ধরা–
তবে আমার মানবজন্ম কেন বঞ্চিত করা ॥
পবিত্র জানি যে তুমি পবিত্র জন্মভূমি,
মানবকন্যা আমি যে ধন্যা প্রাণের পুণ্যে ভরা ॥
কোন্ স্বর্গের তরে ওরা তোমায় তুচ্ছ করে
রহি তোমার বক্ষোপরে।
আমি যে তোমারি আছি নিতান্ত কাছাকাছি,
তোমার মোহিনীশক্তি দাও আমারে হৃদয়প্রাণহরা ॥
আমি ফিরব না রে
আমি ফিরব না রে, ফিরব না আর, ফিরব না রে–
এমন হাওয়ার মুখে ভাসল তরী,
কূলে ভিড়ব না আর, ভিড়ব না রে॥
ছড়িয়ে গেছে সুতো ছিঁড়ে, তাই খুঁটে আজ মরব কি রে–
এখন ভাঙা ঘরের কুড়িয়ে খুঁটি
বেড়া ঘিরব না আর, ঘিরব না রে॥
ঘাটের রশি গেছে কেটে, কাঁদব কি তাই বক্ষ ফেটে–
এখন পালের রশি ধরব কষি,
এ রশি ছিঁড়ব না আর ছিঁড়ব না রে!
আমি সন্ধ্যাদীপের শিখা
আমি সন্ধ্যাদীপের শিখা,
অন্ধকারের ললাট-মাঝে পরানু রাজটিকা ॥
তার স্বপনে মোর আলোর পরশ জাগিয়ে দিল গোপন হরষ,
অন্তরে তার রইল আমার প্রথম প্রেমের লিখা ॥
আমার নির্জন উৎসবে
অম্বরতল হয় নি উতল পাখির কলরবে।
যখন তরুণ রবির চরণ লেগে নিখিল ভুবন উঠবে জেগে
তখন আমি মিলিয়ে যাব ক্ষণিক মরীচিকা ॥
আমি সব নিতে চাই
আমি সব নিতে চাই, সব নিতে ধাই রে।
আমি আপনাকে, ভাই, মেলব যে বাইরে॥
পালে আমার লাগল হাওয়া, হবে আমার সাগর-যাওয়া,
ঘাটে তরী নাই বাঁধা নাই রে॥
সুখে দুখে বুকের মাঝে পথের বাঁশি কেবল বাজে,
সকল কাজে শুনি যে তাই রে।
পাগ্লামি আজ লাগল পাখায়, পাখি কি আর থাকবে শাখায়।
দিকে দিকে সাড়া যে পাই রে॥