আমরা খুঁজি খেলার সাথি
আমরা খুঁজি খেলার সাথি–
ভোর না হতে জাগাই তাদের ঘুমায় যারা সারা রাতি॥
আমরা ডাকি পাখির গলায়, আমরা নাচি বকুলতলায়,
মন ভোলাবার মন্ত্র জানি, হাওয়াতে ফাঁদ আমরা পাতি।
মরণকে তো মানি নে রে,
কালের ফাঁসি ফাঁসিয়ে দিয়ে লুঠ-করা ধন নিই যে কেড়ে।
আমরা তোমার মনোচোরা, ছাড়ব না গো তোমায় মোরা–
চলেছ কোন্ আঁধারপানে সেথাও জ্বলে মোদের বাতি॥
আমরা লক্ষ্মীছাড়ার দল
আমরা লক্ষ্মীছাড়ার দল ভবের পদ্মপত্রে জল
সদা করছি টলোমল
মোদের আসা-যাওয়া শূন্য হাওয়া, নাইকো ফলাফল॥
নাহি জানি করণ-কারণ, নাহি জানি ধরণ-ধারণ॥
নাহি মানি শাসন-বারণ গো–
আমরা আপন রোখে মনের ঝোঁকে ছিঁড়েছি শিকল॥
লক্ষ্মী, তোমার বাহনগুলি ধনে পুত্রে উঠুন ফুলি,
লুঠুন তোমার চরণধূলি গো–
আমরা স্কন্ধে লয়ে কাঁথা ঝুলি ফিরব ধরাতল।
তোমার বন্দরেতে বাঁধা ঘাটে বোঝাই-করা সোনার পাটে
অনেক রত্ন অনেক হাটে গো–
আমরা নোঙর-ছেঁড়া ভাঙা তরী ভেসেছি কেবল॥
আমরা এবার খুঁজে দেখি অকূলেতে কূল মেলে কি,
দ্বীপ আছে কি ভবসাগরে।
যদি সুখ না জোটে দেখব ডুবে কোথায় রসাতল।
আমরা জুটে সারা বেলা করব হতভাগার মেলা,
গাব গান খেলব খেলা গো–
কণ্ঠে যদি গান না আসে করব কোলাহল॥
আমাকে যে বাঁধবে ধরে
আমাকে যে বাঁধবে ধরে এই হবে যার সাধন,
সে কি অমনি হবে।
আপনাকে সে বাঁধা দিয়ে আমায় দেবে বাঁধন,
সে কি অমনি হবে॥
আমাকে যে দুঃখ দিয়ে আনবে আপন বশে,
সে কি অমনি হবে।
তার আগে তার পাষাণ হিয়া গলবে করুণ রসে,
সে কি অমনি হবে।
আমাকে যে কাঁদাবে তার ভাগ্যে আছে কাঁদন,
সে কি অমনি হবে॥
আমাদের ভয় কাহারে
আমাদের ভয় কাহারে।
বুড়ো বুড়ো চোর ডাকাতে কী আমাদের করতে পারে।
আমাদের রাস্তা সোজা, নাইকো গলি– নাইকো ঝুলি, নাইকো থলি–
ওরা আর যা কাড়ে কাড়ুক, মোদের পাগলামি কেউ কাড়বে না রে॥
আমরা চাই নে আরাম, চাই নে বিরাম,
চাই নে যে ফল, চাই নে রে নাম–
মোরা ওঠায় পড়ায় সমান নাচি,
সমান খেলি জিতে হারে ॥
আমাদের পাকবে না চুল গো
আমাদের পাকবে না চুল গো — মোদের পাকবে না চুল।
আমাদের ঝরবে না ফুল গো — মোদের ঝরবে না ফুল।
আমরা ঠেকব না তো কোনো শেষে, ফুরোয় না পথ কোনো দেশে রে,
আমাদের ঘুচবে না ভুল গো — মোদের ঘুচবে না ভুল।
আমরা নয়ন মুদে করব না ধ্যান করব না ধ্যান।
নিজের মনের কোণে খুঁজব না জ্ঞান খুঁজব না জ্ঞান।
আমরা ভেসে চলি স্রোতে স্রোতে সাগর-পানে শিখর হতে রে,
আমাদের মিলবে না কূল গো– মোদের মিলবে না কূল॥
আমাদের শান্তিনিকেতন আমাদের
আমাদের শান্তিনিকেতন আমাদের সব হতে আপন।
তার আকাশ-ভরা কোলে মোদের দোলে হৃদয় দোলে,
মোরা বারে বারে দেখি তারে নিত্যই নূতন॥
মোদের তরুমূলের মেলা, মোদের খোলা মাঠের খেলা,
মোদের নীল গগনের সোহাগ-মাখা সকাল-সন্ধ্যাবেলা।
মোদের শালের ছায়াবীথি বাজায় বনের কলগীতি,
সদাই পাতার নাচে মেতে আছে আম্লকী-কানন॥
আমরা যেথায় মরি ঘুরে সে যে যায় না কভু দূরে,
মোদের মনের মাঝে প্রেমের সেতার বাঁধা যে তার সুরে।
মোদের প্রাণের সঙ্গে প্রাণে সে যে মিলিয়েছে এক তানে,
মোদের ভাইয়ের সঙ্গে ভাইকে সে যে করেছে এক-মন॥
আমার অন্ধপ্রদীপ শূন্য-পানে চেয়ে আছে
আমার অন্ধপ্রদীপ শূন্য-পানে চেয়ে আছে,
সে যে লজ্জা জানায় ব্যর্থ রাতের তারার কাছে॥
ললাটে তার পড়ুক লিখা
তোমার লিখন ওগো শিখা–
বিজয়টিকা দাও গো এঁকে এই সে যাচে॥
হায় কাহার পথে বাহির হলে বিরহিণী!
তোমার আলোক-ঋণে করো তুমি আমায় ঋণী।
তোমার রাতে আমার রাতে
এক আলোকের সূত্রে গাঁথে
এমন ভাগ্য হায় গো আমার হারায় পাছে॥
আমার ঘুর লেগেছে– তাধিন্ তাধিন্
আমার ঘুর লেগেছে– তাধিন্ তাধিন্।
তোমার পিছন পিছন নেচে নেচে ঘুর লেগেছে তাধিন্ তাধিন্।
তোমার তালে আমার চরণ চলে, শুনতে না পাই কে কী বলে–
তাধিন্ তাধিন্।
তোমার গানে আমার প্রাণে যে কোন্ পাগল ছিল সেই জেগেছে–
তাধিন্ তাধিন্।
আমার লাজের বাঁধন সাজের বাঁধন খ’সে গেল ভজন সাধন–
তাধিন্ তাধিন্।
বিষম নাচের বেগে দোলা লেগে ভাবনা যত সব ভেগেছে–
তাধিন্ তাধিন্॥
আমার নাইবা হল পারে যাওয়া
আমার নাইবা হল পারে যাওয়া।
যে হাওয়াতে চলত তরী অঙ্গেতে সেই লাগাই হাওয়া ॥
নেই যদি বা জমল পাড়ি ঘাট আছে তো বসতে পারি।
আমার আশার তরী ডুবল যদি দেখব তোদের তরী-বাওয়া ॥
হাতের কাছে কোলের কাছে যা আছে সেই অনেক আছে।
আমার সারা দিনের এই কি রে কাজ– ওপার-পানে কেঁদে চাওয়া।
কম কিছু মোর থাকে হেথা পুরিয়ে নেব প্রাণ দিয়ে তা।
আমার সেইখানেতেই কল্পলতা যেখানে মোর দাবি-দাওয়া ॥
আমার জীর্ণ পাতা যাবার বেলায় বারে বারে
আমার জীর্ণ পাতা যাবার বেলায় বারে বারে
ডাক দিয়ে যায় নতুন পাতার দ্বারে দ্বারে।
তাই তো আমার এই জীবনের বনচ্ছায়ে
ফাগুন আসে ফিরে ফিরে দখিন বায়ে,
নতুন সুরে গান উড়ে যায় আকাশ পারে,
নতুন রঙে ফুল ফোটে তাই ভারে ভারে॥
ওগো আমার নিত্য নূতন দাঁড়াও হেসে
চলব তোমার নিমন্ত্রণে নবীন বেশে।
দিনের শেষে নিবল যখন পথের আলো,
সাগরতীরে যাত্রা আমার যেই ফুরাল,
তোমার বাঁশি বাজে সাঁঝের অন্ধকারে–
শূন্যে আমার উঠল তারা সারে সারে॥