রয় যে কাঙাল শূন্য হাতে
রয় যে কাঙাল শূন্য হাতে, দিনের শেষে
দেয় সে দেখা নিশীথরাতে স্বপনবেশে॥
আলোয় যারে মলিনমুখে মৌন দেখি
আঁধার হলে আঁখিতে তার দীপ্তি একি–
বরণমালা কে যে দোলায় তাহার কেশে॥
দিনের বীণায় যে ক্ষীণ তারে ছিল হেলা
ঝঙ্কারিয়া ওঠে যে তাই রাতের বেলা।
তন্দ্রাহারা অন্ধকারের বিপুল গানে
মন্দ্রি ওঠে সারা আকাশ কী আহ্বানে–
তারার আলোয় কে চেয়ে রয় নির্নিমেষে॥
শুধু যাওয়া আসা শুধু স্রোতে ভাসা
শুধু যাওয়া আসা, শুধু স্রোতে ভাসা,
শুধু আলো-আঁধারে কাঁদা-হাসা ॥
শুধু দেখা পাওয়া, শুধু ছুঁয়ে যাওয়া,
শুধু দূরে যেতে যেতে কেঁদে চাওয়া,
শুধু নব দুরাশায় আগে চ’লে যায়–
পিছে ফেলে যায় মিছে আশা ॥
অশেষ বাসনা লয়ে ভাঙা বল,
প্রাণপণ কাজে পায় ভাঙা ফল,
ভাঙা তরী ধ’রে ভাসে পারাবারে,
ভাব কেঁদে মরে– ভাঙা ভাষা।
হৃদয়ে হৃদয়ে আধো পরিচয়,
আধখানি কথা সাঙ্গ নাহি হয়,
লাজে ভয়ে ত্রাসে আধো-বিশ্বাসে
শুধু আধখানি ভালোবাসা ॥
সকাল-বেলার কুঁড়ি আমার বিকালে যায় টুটে
সকাল-বেলার কুঁড়ি আমার বিকালে যায় টুটে,
মাঝখানে হায় হয় নি দেখা উঠল যখন ফুটে॥
ঝরা ফুলের পাপড়িগুলি ধুলো থেকে আনিস তুলি,
যখন সময় ছিল দিল ফাঁকি–
এখন আন্ কুড়ায়ে দিনের শেষে অসময়ের ছিন্ন বাকি।
কৃষ্ণরাতের চাঁদের কণা আঁধারকে দেয় যে সান্ত্বনা
তাই নিয়ে মোর মিটুক আশা– স্বপন গেছে ছুটে॥
সন্ন্যাসী যে জাগিল ওই
সন্ন্যাসী যে জাগিল ওই, জাগিল ওই, জাগিল!
হাস্য-ভরা দখিন-বায়ে অঙ্গ হতে দিল উড়ায়ে
শ্মশানচিতাভস্মরাশি– ভাগিল কোথা ভাগিল।
মানসলোকে শুভ্র আলো চূর্ণ হয়ে রঙ জাগালো,
মদির রাগ লাগিল তারে– হৃদয়ে তার লাগিল॥
আয় রে তোরা, আয় রে তোরা, আয় রে–
রঙের ধারা ওই-যে বহে যায় রে॥
রঙের ঝড় উচ্ছ্বসিল গগনে,
রঙের ঢেউ রসের স্রোতে মাতিয়া ওঠে সঘনে–
ডাকিল বান আজি সে কোন্ কোটালে।
নাকাড়া বাজে কানাড়া বাজে বাঁশিতে–
কান্নাধারা মিলিয়া গেছে হাসিতে–
প্রাণের মাঝে ফোয়ারা তার ছোটালে।
এসেছে হাওয়া বাণীতে দোল-দোলানো, এসেছে পথ-ভোলানো–
এসেছে ডাক ঘরের দ্বার-খোলানো ॥
আয় রে তোরা, আয় রে তোরা, আয় রে–
রঙের ধারা ওই-যে বহে যায় রে॥
উদয়রবি যে রাঙা রঙ রাঙায়ে পূর্বাচলের দিয়েছে ঘুম ভাঙায়ে
অস্তরবি সে রাঙা রসে রসিল–
চিরপ্রাণের বিজয়বাণী ঘোষিল।
অরুণবীণা যে সুর দিল রণিয়া সন্ধ্যাকাশে সে সুর উঠে ঘনিয়া
নীরব নিশীথিনীর বুকে নিখিল ধ্বনি ধ্বনিয়া।
আয় রে তোরা, আয় রে তোরা, আয় রে–
বাঁধন-হারা রঙের ধারা ওই-যে বহে যায় রে॥
সব কাজে হাত লাগাই মোরা
সব কাজে হাত লাগাই মোরা সব কাজেই।
বাধা বাঁধন নেই গো নেই॥
দেখি খুঁজি বুঝি, কেবল ভাঙি গড়ি যুঝি,
মোরা সব দেশেতেই বেড়াই ঘুরে সব সাজেই॥
পারি নাইবা পারি, নাহয় জিতি কিম্বা হারি–
যদি অমনিতে হাল ছাড়ি মরি সেই লাজেই।
আপন হাতের জোরে আমরা তুলি সৃজন ক’রে,
আমরা প্রাণ দিয়ে ঘর বাঁধি, থাকি তার মাঝেই॥
সারা বরষ দেখি নে
সারা বরষ দেখি নে, মা, মা তুই আমার কেমন ধারা?
নয়নতারা হারিয়ে আমার অন্ধ হল নয়নতারা॥
এলি কি পাষাণী ওরে। দেখব তোরে আঁখি ভরে–
কিছুতেই থামে না যে মা, পোড়া এ নয়নের ধারা॥
সুন্দরের বন্ধন নিষ্ঠুরের হাতে
সুন্দরের বন্ধন নিষ্ঠুরের হাতে ঘুচাবে কে।
নিঃসহায়ের অশ্রুবারি পীড়িতের চক্ষে মুছাবে কে,
আর্তের ক্রন্দনে হেরো ব্যথিত বসুন্ধরা,
অন্যায়ের আক্রমণে বিষবাণে জর্জরা–
প্রবলের উৎপীড়নে
কে বাঁচাব দুর্বলেরে।
অপমানিতেরে কার দয়া বক্ষে লবে ডেকে॥
সে কোন্ বনের হরিণ
সে কোন্ বনের হরিণ ছিল আমার মনে।
কে তারে বাঁধল অকারণে॥
গতিরাগের সে ছিল গান, আলোছায়ার সে ছিল প্রাণ,
আকাশকে সে চমকে দিত বনে
মেঘলা দিনের আকুলতা বাজিয়ে যেত পায়ে
তমাল ছায়ে-ছায়ে।
ফাল্গুনে সে পিয়ালতলায় কে জানিত কোথায় পলায়
দখিন-হাওয়ার চঞ্চলতার সনে॥
সে কোন্ পাগল যায়
সে কোন্ পাগল যায় যায় পথে তোর, যায় চলে ওই-একলা রাতে–
তারে ডাকিস নে ডাকিস নে তোর আঙিনাতে॥
সুদূর দেশের বাণী ও যে যায় যায় বলে, হায়, কে তা বোঝে–
কী সুর বাজায় একতারাতে॥
কাল সকালে রইবে না রইবে না তো,
বৃথাই কেন আসন পাতো।
বাঁধন-ছেঁড়ার মহোৎসবে
গান যে ওরে গাইতে হবে
নবীন আলোর বন্দনাতে॥
স্বপন-পারের ডাক শুনেছি
স্বপন-পারের ডাক শুনেছি, জেগে তাই তো ভাবি–
কেউ কখনো খুঁজে কি পায় স্বপ্নলোকের চাবি॥
নয় তো সেথায় যাবার তরে, নয় কিছু তো পাবার তরে,
নাই কিছু তার দাবি–
বিশ্ব হতে হারিয়ে গেছে স্বপ্নলোকের চাবি॥
চাওয়া-পাওয়ার বুকের ভিতর না-পাওয়া ফুল ফোটে,
দিশাহারা গন্ধে তারি আকাশ ভরে ওঠে।
খুঁজে যারে বেড়াই গানে, প্রাণের গভীর অতল-পানে
যে জন গেছে নাবি,
সেই নিয়েছে চুরি করে স্বপ্নলোকের চাবি॥
হাটের ধুলা সয় না যে আর
হাটের ধুলা সয় না যে আর, কাতর করে প্রাণ।
তোমার সুরসুরধুনীর ধারায় করাও আমায় ম্লান॥
জাগাক তারি মৃদঙ্গরোল, রক্তে তুলুক তরঙ্গদোল,
অঙ্গ হতে ফেলুক ধুয়ে সকল অসম্মান–
সব কোলাহল দিক্ ডুবায়ে তাহার কলতান॥
সুন্দর হে, তোমার ফুলে গেঁথেছিলেম মালা–
সেই কথা আজ মনে করাও, ভুলাও সকল জ্বালা।
তোমার গানের পদ্মবনে আবার ডাকো নিমন্ত্রণে–
তারি গোপন সুধাকণা আবার করাও পান,
তারি রেণুর তিলকলেখা আমায় করো দান॥