যখন জমবে ধুলা তানপুরাটার তারগুলায়,
কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায়, আহা,
ফুলের বাগান ঘন ঘাসের পরবে সজ্জা বনবাসের,
শ্যাওলা এসে ঘিরবে দিঘির ধারগুলায়–
তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে।
তখন এমনি করেই বাজবে বাঁশি এই নাটে,
কাটবে দিন কাটবে,
কাটবে গো দিন আজও যেমন দিন কাটে, আহা,
ঘাটে ঘাটে খেয়ার তরী এমনি সে দিন উঠবে ভরি–
চরবে গোরু খেলবে রাখাল ওই মাঠে।
তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে।
তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি।
সকল খেলায় করবে খেলা এই আমি– আহা,
নতুন নামে ডাকবে মোরে, বাঁধবে নতুন বাহু-ডোরে,
আসব যাব চিরদিনের সেই আমি।
তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে॥
যাবই আমি যাবই ওগো
যাবই আমি যাবই ওগো, বাণিজ্যেতে যাবই।
লক্ষ্ণীরে হারাবই যদি, অলক্ষ্ণীরে পাবই।
সাজিয়ে নিয়ে জাহাজখানি বসিয়ে হাজার দাঁড়ি
কোন্ পুরীতে যাব দিয়ে কোন্ সাগরে পাড়ি।
কোন্ তারকা লক্ষ্য করি কূল-কিনারা পরিহরি
কোন্ দিকে যে বাইব তরী বিরাট কালো নীরে–
মরব না আর ব্যর্থ আশায় সোনার বালুর তীরে॥
নীলের কোলে শ্যামল সে দ্বীপ প্রবাল দিয়ে ঘেরা।
শৈলচূড়ায় নীড় বেঁধেছে সাগরবিহঙ্গেরা।
নারিকেলের শাখে শাখে ঝোড়ো হাওয়া কেবল ডাকে,
ঘন বনের ফাঁকে ফাঁকে বইছে নগনদী।
সাত রাজার ধন মানিক পাব সেথায় নামি যদি॥
হেরো সাগর উঠে তরঙ্গিয়া, বাতাস বহে বেগে।
সূর্য যেথায় অস্তে নামে ঝিলিক মারে মেঘে।
দক্ষিণে চাই, উত্তরে চাই– ফেনায় ফেনা, আর কিছু নাই–
যদি কোথাও কূল নাহি পাই তল পাব তো তবু–
ভিটার কোণে হতাশমনে রবই না আর কভু॥
অকূল-মাঝে ভাসিয়ে তরী যাচ্ছি অজানায়
আমি শুধু একলা নেয়ে আমার শূন্য নায়।
নব নব পবন-ভরে যাব দ্বীপে দ্বীপান্তরে,
নেব তরী পূর্ণ ক’রে অপূর্ব ধন যত।
ভিখারি মন ফিরবে যখন ফিরবে রাজার মতো॥
যাহা পাও তাই লও
যাহা পাও তাই লও, হাসিমুখে ফিরে যাও।
কারে চাও, কেন চাও– তোমার আশা কে পূরাতে পারে॥
সবে চায়, কেবা পায় সংসার চ’লে যায়–
যে বা হাসে, যে বা কাঁদে, যে বা প’ড়ে থাকে দ্বারে॥
যুদ্ধ যখন বাধিল অচলে চঞ্চলে
যুদ্ধ যখন বাধিল অচলে চঞ্চলে
ঝঙ্কারধ্বনি রণিল কঠিন শৃঙ্খলে,
বন্ধমোচন ছন্দে তখন নেমে এলে নির্ঝরিণী–
তোমারে চিনি, তোমারে চিনি॥
সিন্ধুমিলনসঙ্গীতে
মাতিয়া উঠেছ পাষাণশাসন লঙ্ঘিতে
অধীর ছন্দে ওগো মহাবিদ্রোহিণী–
তোমারে চিনি, তোমারে চিনি॥
হে নিঃশঙ্কিতা,
আত্ম-হারানো রুদ্রতালের নূপুরঝঙ্কৃতা,
মৃত্যুতোরণতরণ-চরণ-চারিণী
চিরদিন অভিসারিণী,
তোমারে চিনি॥
যে আমি ওই ভেসে চলে
যে আমি ওই ভেসে চলে কালের ঢেউয়ে আকাশতলে
ওরই পানে দেখছি আমি চেয়ে।
ধুলার সাথে, জলের সাথে, ফুলের সাথে, ফলের সাথে,
সবার সাথে চলছে ও যে ধেয়ে॥
ও যে সদাই বাইরে আছে, দুঃখে সুখে নিত্য নাচে–
ঢেউ দিয়ে যায়, দোলে যে ঢেউ খেয়ে।
একটু ক্ষয়ে ক্ষতি লাগে, একটু ঘায়ে ক্ষত জাগে–
ওরই পানে দেখছি আমি চেয়ে॥
যে আমি যায় কেঁদে হেসে তাল দিতেছে মৃদঙ্গে সে,
অন্য আমি উঠতেছি গান গেয়ে।
ও যে সচল ছবির মতো, আমি নীরব কবির মতো–
ওরই পানে দেখছি আমি চেয়ে।
এই-যে আমি ঐ আমি নই, আপন-মাঝে আপনি যে রই,
যাই নে ভেসে মরণধারা বেয়ে–
মুক্ত আমি তৃপ্ত আমি, শান্ত আমি, দীপ্ত আমি,
ওরই পানে দেখছি আমি চেয়ে॥
যে কাঁদনে হিয়া কাঁদিছে
যে কাঁদনে হিয়া কাঁদিছে সে কাঁদনে সেও কাঁদিল।
যে বাঁধনে মোরে বাঁধিছে সে বাঁধনে তারে বাঁধিল॥
পথে পথে তারে খুঁজিনু, মনে মনে তারে পূজিনু,
সে পূজার মাঝে লুকায়ে আমারেও সে যে সাধিল॥
এসেছিল মন হরিতে মহাপারাবার পারায়ে।
ফিরিল না আর তরীতে, আপনারে গেল হারায়ে।
তারি আপনারই মাধুরী আপনারে করে চাতুরী,
ধরিবে কি ধরা দিবে সে কী ভাবিয়া ফাঁদ ফাঁদিল॥
যে কেবল পালিয়ে বেড়ায়
যে কেবল পালিয়ে বেড়ায়, দৃষ্টি এড়ায়, ডাক দিয়ে যায় ইঙ্গিতে,
সে কি আজ দিল ধরা গন্ধে-ভরা বসন্তের এই সঙ্গীতে॥
ও কি তার উত্তরীয় অশোকশাখায় উঠল দুলি।
আজ কি পলাশবনে ওই সে বুলায় রঙের তুলি।
ও কি তার চরণ পড়ে তালে তালে মল্লিকার ওই ভঙ্গীতে॥
না গো না, দেয় নি ধরা, হাসির ভরা দীর্ঘশ্বাসে যায় ভেসে।
মিছে এই হেলা-দোলায় মনকে ভোলায়, ঢেউ দিয়ে যায় স্বপ্নে সে।
সে বুঝি লুকিয়ে আসে বিচ্ছেদেরই রিক্ত রাতে,
নয়নের আড়ালে তার নিত্য-জাগার আসন পাতে–
ধেয়ানের বর্ণছটায় ব্যথার রঙে মনকে সে রয় রঙ্গিতে॥
রাঙিয়ে দিয়ে যাও
রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো এবার যাবার আগে–
তোমার আপন রাগে, তোমার গোপন রাগে,
তোমার তরুণ হাসির অরুণ রাগে
অশ্রুজলের করুণ রাগে॥
রঙ যেন মোর মর্মে লাগে, আমার সকল কর্মে লাগে,
সন্ধ্যাদীপের আগায় লাগে, গভীর রাতের জাগায় লাগে॥
যাবার আগে যাও গো আমায় জাগিয়ে দিয়ে,
রক্তে তোমার চরণ-দোলা লাগিয়ে দিয়ে।
আঁধার নিশার বক্ষে যেমন তারা জাগে,
পাষাণগুহার কক্ষে নিঝর-ধারা জাগে,
মেঘের বুকে যেমন মেঘের মন্দ্র জাগে,
বিশ্ব-নাচের কেন্দ্রে যেমন ছন্দ জাগে,
তেমনি আমায় দোল দিয়ে যাও যাবার পথে আগিয়ে দিয়ে,
কাঁদন-বাঁধন ভাগিয়ে দিয়ে॥