ভালোমানুষ নই রে মোরা
ভালোমানুষ নই রে মোরা ভালোমানুষ নই–
গুণের মধ্যে ওই আমাদের, গুণের মধ্যে ওই॥
দেশে দেশে নিন্দে রটে, পদে পদে বিপদ ঘটে–
পুঁথির কথা কই নে মোরা, উল্টো কথা কই॥
জন্ম মোদের ত্র্যহস্পর্শে, সকল-অনাসৃষ্টি।
ছুটি নিলেন বৃহস্পতি, রইল শনির দৃষ্টি।
অযাত্রাতে নৌকো ভাসা, রাখি নে, ভাই, ফলের আশা–
আমাদের আর নাই যে গতি ভেসেই চলা বই॥
মধুর মধুর ধ্বনি বাজে
মধুর মধুর ধ্বনি বাজে
হৃদয়কমলবনমাঝে॥
নিভৃতবাসিনী বীণাপাণি অমৃতমুরতিমতী বাণী
হিরণকিরণ ছবিখানি– পরানের কোথা সে বিরাজে॥
মধুঋতু জাগে দিবানিশি পিককুহরিত দিশি দিশি।
মানসমধুপ পদতলে মুরছি পড়িছে পরিমলে।
এসো দেবী, এসো এ আলোকে, একবার তোরে হেরি চোখে–
গোপনে থেকো না মনোলোকে ছায়াময় মায়াময় সাজে॥
মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে
মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।
তারি সঙ্গে কী মৃদঙ্গে সদা বাজে
তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ॥
হাসিকান্না হীরাপান্না দোলে ভালে,
কাঁপে ছন্দে ভালোমন্দ তালে তালে,
নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু পাছে পাছে,
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।
কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী আনন্দ
দিবারাত্রি নাচে মুক্তি নাচে বন্ধ–
সে তরঙ্গে ছুটি রঙ্গে পাছে পাছে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ॥
মাটির বুকের মাঝে বন্দী যে জল
মাটির বুকের মাঝে বন্দী যে জল মিলিয়ে থাকে
মাটি পায় না, পায় না, মাটি পায় না তাকে॥
কবে কাটিয়ে বাঁধন পালিয়ে যখন যায় সে দূরে
আকাশপুরে গো,
তখন কাজল মেঘের সজল ছায়া শূন্যে আঁকে,
সুদূর শূন্যে আঁকে–
মাটি পায় না, পায় না, মাটি পায় না তাকে॥
শেষে বজ্র তারে বাজায় ব্যথা বহ্নিজ্বালায়,
ঝঞ্ঝা তারে দিগ্বিদিকে কাঁদিয়ে চালায়।
তখন কাছের ধন যে দূরের থেকে কাছে আসে
বুকের পাশে গো,
তখন চোখের জলে নামে সে যে চোখের জলের ডাকে,
আকুল চোখের জলের ডাকে–
মাটি পায় রে, পায় রে, মাটি পায় রে তাকে॥
মাটির প্রদীপখানি আছে মাটির ঘরের কোলে
মাটির প্রদীপখানি আছে মাটির ঘরের কোলে,
সন্ধ্যাতারা তাকায় তারি আলো দেখবে ব’লে॥
সেই আলোটি নিমেষহত প্রিয়ার ব্যাকুল চাওয়ার মতো,
সেই আলোটি মায়ের প্রাণের ভয়ের মতো দোলে॥
সেই আলোটি নেবে জ্বলে শ্যামল ধরার হৃদয়তলে,
সেই আলোটি চপল হাওয়ায় ব্যথায় কাঁপে পলে পলে।
নামল সন্ধ্যাতারার বাণী আকাশ হতে আশিস আনি,
অমরশিখা আকুল হল মর্তশিখায় উঠতে জ্ব’লে॥
মেঘেরা চলে চলে যায়
মেঘেরা চলে চলে যায়, চাঁদেরে ডাকে ‘আয়, আয়’।
ঘুমঘোরে বলে চাঁদ ‘কোথায় কোথায়’॥
না জানি কোথা চলিয়াছে, কী জানি কী যে সেথা আছে,
আকাশের মাঝে চাঁদ চারি দিকে চায়॥
সুদূরে, অতি অতিদূরে, বুঝি রে কোন্ সুরপুরে
তারাগুলি ঘিরে ব’সে বাঁশরি বাজায়।
মেয়েরা তাই হেসে হেসে আকাশে চলে ভেসে ভেসে,
লুকিয়ে চাঁদের হাসি চুরি করে যায়॥
মোদের যেমন খেলা তেমনি যে কাজ
মোদের যেমন খেলা তেমনি যে কাজ জানিস নে কি ভাই।
তাই কাজকে কভু আমরা না ডরাই॥
খেলা মোদের লড়াই করা, খেলা মোদের বাঁচা মরা,
খেলা ছাড়া কিছুই কোথাও নাই॥
খেলতে খেলতে ফুটেছে ফুল, খেলতে খেলতে ফল যে ফলে,
খেলারই ঢেউ জলে স্থলে।
ভয়ের ভীষণ রক্তরাগে খেলার আগুন যখন লাগে
ভাঙাচোরা জ্ব’লে যে হয় ছাই॥
মোদের কিছু নাই রে নাই
মোদের কিছু নাই রে নাই, আমরা ঘরে বাইরে গাই–
তাইরে নাইরে নাইরে না। না না না।
যতই দিবস যায় রে যায় গাই রে সুখে হায় রে হায়–
তাইরে নাইরে নাইরে না। না না না।
যারা সোনার চোরাবালির ‘পরে পাকা ঘরের-ভিত্তি গড়ে
তাদের সামনে মোরা গান গেয়ে যাই– তাইরে নাইরে নাইরে না।
না না না॥
যখন থেকে থেকে গাঁঠের পানে গাঁঠকাটারা দৃষ্টি হানে
তখন শূন্যঝুলি দেখায়ে গাই– তাইরে নাইরে নাইরে না। না না না॥
যখন দ্বারে আসে মরণবুড়ি মুখে তাহার বাজাই তুড়ি,
তখন তান দিয়ে গান জুড়ি রে ভাই– তাইরে নাইরে নাইরে না। না না না।
এ যে বসন্তরাজ এসেছে আজ, বাইরে তাহার উজ্জ্বল সাজ,
ওরে, অন্তরে তার বৈরাগী গায়– তাইরে নাইরে নাইরে না। না না না।
সে যে উৎসবদিন চুকিয়ে দিয়ে, ঝরিয়ে দিয়ে, শুকিয়ে দিয়ে,
দুই রিক্ত হাতে তাল দিয়ে গায়– তাইরে নাইরে নাইরে না।
না না না॥
মোরা সত্যের ‘পরে মন আজি করিব সমর্পণ
মোরা সত্যের ‘পরে মন আজি করিব সমর্পণ।
জয় জয় সত্যের জয়।
মোরা বুঝিব সত্য, পূজিব সত্য, খুঁজিব সত্যধন।
জয় জয় সত্যের জয়।
যদি দুঃখে দহিতে হয় তবু মিথ্যাচিন্তা নয়।
যদি দৈন্য বহিতে হয় তবু মিথ্যাকর্ম নয়।
যদি দণ্ড সহিতে হয় তবু মিথ্যাবাক্য নয়।
জয় জয় সত্যের জয়॥
মোরা মঙ্গলকাজে প্রাণ আজি করিব সকলে দান।
জয় জয় মঙ্গলময়।
মোরা লভিব পুণ্য, শোভিব পুণ্যে, গাহিব পুণ্যগান।
জয় জয় মঙ্গলময়।
যদি দুঃখে দহিতে হয় তবু অশুভচিন্তা নয়।
যদি দৈন্য বহিতে হয় তবু অশুভকর্ম নয়।
যদি দণ্ড সহিতে হয় তবু অশুভবাক্য নয়।
জয় জয় মঙ্গলময়॥
যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে
যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,
আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে,
চুকিয়ে দেব বেচা কেনা,
মিটিয়ে দেব গো, মিটিয়ে দেব লেনা দেনা,
বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে–
তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে।