নৃত্যে তোমার মুক্তির রূপ, নৃত্যে তোমার মায়া,
বিশ্বতনুতে অণুতে অণুতে কাঁপে নৃত্যের ছায়া।
তোমার বিশ্ব-নাচের দোলায় দোলায় বাঁধন পরায় বাঁধন খোলায়
যুগে যুগে কালে কালে সুরে সুরে তালে তালে,
অন্ত কে তার সন্ধান পায় ভাবিতে লাগায় ধন্দ হে॥
নমো নমো নমো–
তোমার নৃত্য অমিত বিত্ত ভরুক চিত্ত মম॥
নৃত্যের বশে সুন্দর হল বিদ্রোহী পরমাণু,
পদযুগ ঘিরে জ্যোতিমঞ্জীরে বাজিল চন্দ্র ভানু।
তব নৃত্যের প্রাণবেদনায় বিবশ বিশ্ব জাগে চেতনায়
যুগে যুগে কালে কালে সুরে সুরে তালে তালে,
সুখে দুখে হয় তরঙ্গময় তোমার পরমানন্দ হে॥
নমো নমো নমো–
তোমার নৃত্য অমিত বিত্ত ভরুক চিত্ত মম॥
মোর সংসারে তাণ্ডব তব কম্পিত জটাজালে।
লোকে লোকে ঘুরে এসেছি তোমার নাচের ঘূর্ণিতালে।
ওগো সন্ন্যাসী, ওগো সুন্দর, ওগো শঙ্কর, হে ভয়ঙ্কর,
যুগে যুগে কালে কালে সুরে সুরে তালে তালে,
জীবন-মরণ-নাচের ডমরু বাজাও জলদমন্দ্র হে॥
নমো নমো নমো–
তোমার নৃত্য অমিত বিত্ত ভরুক চিত্ত মম॥
পরবাসী চলে এসো ঘরে
পরবাসী, চলে এসো ঘরে
অনুকূল সমীরণ-ভরে॥
ওই দেখো কতবার হল খেয়া-পারাবার,
সারিগান উঠিল অম্বরে॥
আকাশে আকাশে আয়োজন,
বাতাসে বাতাসে আমন্ত্রণ।
মন যে দিল না সাড়া, তাই তুমি গৃহছাড়া
নির্বাসিত বাহিরে অন্তরে॥
পাখি বলে চাঁপা আমারে কও
পাখি বলে, ‘চাঁপা, আমারে কও,
কেন তুমি হেন নীরবে রও।
প্রাণ ভরে আমি গাহি যে গান
সারা প্রভাতেরই সুরের দান,
সে কি তুমি তব হৃদয়ে লও।
কেন তুমি তবে নীরবে রও।’
চাঁপা শুনে বলে, ‘হায় গো হায়,
যে আমারই পাওয়া শুনিতে পায়
নহ নহ পাখি, সে তুমি নও।’
পাখি বলে, ‘চাঁপা আমারে কও,
কেন তুমি হেন গোপনে রও।
ফাগুনের প্রাতে উতলা বায়
উড়ে যেতে সে যে ডাকিয়া যায়,
সে কি তুমি তব হৃদয়ে লও।
কেন তুমি তবে গোপনে রও।’
চাঁপা শুনে বলে, ‘হায় গো হায়,
যে আমারই ওড়া দেখিতে পায়
নহ নহ পাখি, সে তুমি নও।’
পাগল যে তুই কণ্ঠ ভরে
পাগল যে তুই, কণ্ঠ ভরে
জানিয়ে দে তাই সাহস করে॥
দেয় যদি তোর দুয়ার নাড়া
থাকিস কোণে, দিস নে সাড়া–
বলুক সবাই ‘সৃষ্টিছাড়া’, বলুক সবাই ‘কী কাজ তোরে’॥
বল্ রে ‘আমি কেহই না গো,
কিছুই নহি, যে হই-না’।
শুনে বনে উঠবে হাসি,
দিকে দিকে বাজবে বাঁশি–
বলবে বাতাস ‘ভালোবাসি’, বাঁধবে আকাশ অলখ ডোরে॥
পায়ে পড়ি শোনো ভাই গাইয়ে
পায়ে পড়ি শোনো ভাই গাইয়ে,
মোদের পাড়ার থোড়া দূর দিয়ে যাইয়ে॥
হেথা সা রে গা মা -গুলি সদাই করে চুলোচুলি,
কড়ি কোমল কোথা গেছে তলাইয়ে॥
হেথা আছে তাল-কাটা বাজিয়ে–
বাধাবে সে কাজিয়ে।
চৌতালে ধামারে
কে কোথায় ঘা মারে–
তেরে-কেটে মেরে-কেটে ধাঁ-ধাঁ-ধাঁইয়ে॥
প্রলয়-নাচন নাচলে যখন আপন ভুলে
প্রলয়-নাচন নাচলে যখন আপন ভুলে
হে নটরাজ, জটার বাঁধন পড়ল খুলে॥
জাহ্নবী তাই মুক্তধারায় উন্মাদিনী দিশা হারায়,
সঙ্গীতে তার তরঙ্গদল উঠল দুলে॥
রবির আলো সাড়া দিল আকাশ-পারে।
শুনিয়ে দিল অভয়বাণী ঘর-ছাড়ারে।
আপন স্রোতে আপনি মাতে, সাথি হল আপন-সাথে,
সব-হারা সে সব পেল তার কূলে কূলে॥
প্রাঙ্গণে মোর শিরীষশাখায় ফাগুন মাসে
প্রাঙ্গণে মোর শিরীষশাখায় ফাগুন মাসে
কী উচ্ছ্বাসে
ক্লান্তিবিহীন ফুল ফোটানোর খেলা।
ক্ষান্তকূজন শান্তবিজন সন্ধ্যাবেলা
প্রত্যহ সেই ফুল্ল শিরীষ প্রশ্ন শুধায় আমায় দেখি
‘এসেছে কি– এসেছে কি।’
আর বছরেই এমনি দিনেই ফাগুন মাসে
কী উচ্ছ্বাসে
নাচের মাতন লাগল শিরীষ-ডালে
স্বর্গপুরের কোন্ নূপুরের তালে।
প্রত্যহ সেই চঞ্চল প্রাণ শুধিয়েছিল, ‘শুনাও দেখি
আসে নি কি– আসে নি কি।’
আবার কখন এমনি দিনেই ফাগুন মাসে
কী আশ্বাসে
ডালগুলি তার রইবে শ্রবণ পেতে
অলখ জনের চরণ-শব্দে মেতে।
প্রত্যহ তার মর্মরস্বর বলবে আমায় কী বিশ্বাসে,
‘সে কি আসে– সে কি আসে।’
প্রশ্ন জানাই পুষ্পবিভোর ফাগুন মাসে
কী আশ্বাসে,
‘হায় গো, আমার ভাগ্য-রাতের তারা,
নিমেষ-গণন হয় নি কি মোর সারা।’
প্রত্যহ বয় প্রাঙ্গণময় বনের বাতাস এলোমেলো–
‘সে কি এল– সে কি এল।’
ফিরে ফিরে আমায় মিছে ডাকো
ফিরে ফিরে আমায় মিছে ডাকো স্বামী–
সময় হল বিদায় নেব আমি॥
অপমানে যার সাজায় চিতা
সে যে বাহির হয়ে এল অগ্নিজিতা।
রাজাসনের কঠিন অসম্মানে
ধরা দিবে না সে যে মুক্তিকামী॥
আমায় মাটি নেবে আঁচল পেতে
বিশ্বজনের চোখের আড়ালেতে,
তুমি থাকো সোনার সীতার অনুগামী॥
ফুরোলো ফুরোলো এবার পরীক্ষার এই পালা
ফুরোলো ফুরোলো এবার পরীক্ষার এই পালা–
পার হয়েছি আমি অগ্নিদহন-জ্বালা ॥
মা গো মা, মা গো মা, এবার তুমি জাগো মা–
তোমার কোলে উজাড় করে দেব অপমানের ডালা ॥
তোমার শ্যামল আঁচলখানি আমার অঙ্গে দাও, মা, আনি–
আমার বুকের থেকে লও খসিয়ে নিঠুর কাঁটার মালা ॥
বাজে গুরু গুরু শঙ্কার ডঙ্কা
বাজে গুরু গুরু শঙ্কার ডঙ্কা,
ঝঞ্ঝা ঘনায় দূরে ভীষণ নীরবে।
কত রব সুখস্বপ্নের ঘোরে আপনা ভুলে–
সহসা জাগিতে হবে রে॥
ভাঙো বাঁধ ভেঙে দাও
ভাঙো বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও।
বন্দী প্রাণ মন হোক উধাও॥
শুকনো গাঙে আসুক
জীবনের বন্যার উদ্দাম কৌতুক–
ভাঙনের জয়গান গাও।
জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক,
যাক ভেসে যাক, যাক ভেসে যাক।
আমরা শুনেছি ওই মাভৈঃ মাভৈঃ মাভৈঃ
কোন্ নূতনেরই ডাক।
ভয় করি না অজানারে,
রুদ্ধ তাহারি দ্বারে দুর্দাড় বেগে ধাও॥