যদি ভরিয়া লইবে কুম্ভ
যদি ভরিয়া লইবে কুম্ভ এসো ওগো, এসো মোর
হৃদয়নীরে।
তলতল ছলছলকাঁদিবে গভীর জল
ওই দুটি সুকোমল চরণ ঘিরে।
আজি বর্ষা গাঢ়তম, নিবিড়কুন্তলসম
মেঘ নামিয়াছে মম দুইটি তীরে।
ওই-যে শবদ চিনি, নূপুর রিনিকিঝিনি–
কে গো তুমি একাকিনী আসিছ ধীরে।
যদি ভরিয়া লইবে কুম্ভ এসো ওগো, এসো মোর
হৃদয়নীরে॥
যদি মরণ লভিতে চাও এসো তবে ঝাঁপ দাও
সলিলমাঝে।
স্নিগ্ধ শান্ত সুগভীর– নাহি তল, নাহি তীর,
মৃত্যুসম নীল নীর স্থির বিরাজে।
নাহি রাত্রিদিনমান– আদি অন্ত পরিমাণ,
সে অতলে গীতগান কিছু না বাজে।
যাও সব যাও ভুলে, নিখিলবন্ধন খুলে
ফেলে দিয়ে এসো কূলে সকল কাজে।
যদি ভরিয়া লইবে কুম্ভ এসো ওগো, এসো মোর
হৃদয়নীরে॥
যাই যাই ছেড়ে দাও
যাই যাই, ছেড়ে দাও–স্রোতের মুখে ভেসে যাই।
যা হবার তা হবে আমার, ভেসেছি তো ভেসে যাই॥
ছিল যত সহিবার সহেছি তো অনিবার–
এখন কিসের আশা আর। ভেসেছি তো ভেসে যাই॥
যারা বিহান-বেলায় গান এনেছিল আমার মনে
যারা বিহান-বেলায় গান এনেছিল আমার মনে
সাঁঝের বেলায় ছায়ায় তারা মিলায় ধীরে।
একা বসে আছি হেথায় যাতায়াতের পথের তীরে,
আজকে তারা এল আমার স্বপ্নলোকের দুয়ার ঘিরে।
সুরহারা সব ব্যথা যত একতারা তার খুঁজে ফিরে।
প্রহর-পরে প্রহর যে যায়, বসে বসে কেবল গণি
নীরব জপের মালার ধ্বনি অন্ধকারের শিরে শিরে॥
যেন কোন্ ভুলের ঘোরে
যেন কোন্ ভুলের ঘোরে চাঁদ চলে যায় সরে সরে।
পাড়ি দেয় কালো নদী, আয় রজনী, দেখবি যদি–
কেমনে তুই রাখবি ধ’রে, দূরের বাঁশি ডাকল ওরে।
প্রহরগুলি বিলিয়ে দিয়ে সর্বনাশের সাধন কী এ।
মগ্ন হয়ে রইবে বসে মরণ-ফুলের মধুকোষে–
নতুন হয়ে আবার তোরে মিলবে বুঝি সুধায় ভ’রে॥
রিমিকি ঝিমিকি ঝরে ভাদরের ধারা
রিমিকি ঝিমিকি ঝরে ভাদরের ধারা–
মন যে কেমন করে, হল দিশাহারা।
যেন কে গিয়েছে ডেকে,
রজনীতে সে কে দ্বারে দিল নাড়া–
রিমিকি ঝিমিকি ঝরে ভাদরের ধারা॥
বঁধু দয়া করো, আলোখানি ধরো হৃদয়ে।
আধো-জাগরিত তন্দ্রার ঘোরে আঁখি জলে যায় যে ভ’রে।
স্বপনের তলে ছায়াখানি দেখে মনে মনে ভাবি এসেছিল সে কে–
রিমিকি ঝিমিকি ঝরে ভাদরের ধারা॥
শুন নলিনী খোলো গো আঁখি
শুন নলিনী, খোলো গো আঁখি–
ঘুম এখনো ভাঙিল না কি!
দেখো, তোমারি দুয়ার-‘পরে
সখী, এসেছে তোমারি রবি॥
শুনি প্রভাতের গাথা মোর
দেখো ভেঙেছে ঘুমের ঘোর,
জগত উঠেছে নয়ন মেলিয়া নূতন জীবন লভি।
তবে তুমি কি সজনী জাগিবে নাকো,
আমি যে তোমারি কবি॥
প্রতিদিন আসি, প্রতিদিন হাসি,
প্রতিদিন গান গাহি–
প্রতিদিন প্রাতে শুনিয়া সে গান
ধীরে ধীরে উঠ চাহি।
আজিও এসেছি, চেয়ে দেখো দেখি
আর তো রজনী নাহি।
আজিও এসেছি, উঠ উঠ সখী,
আর তো রজনী নাহি।
সখী, শিশিরে মুখানি মাজি
সখী, লোহিত বসনে সাজি
দেখো বিমল সরসীর-আরশির ‘পরে অপরূপ রূপরাশি।
থেকে থেকে ধীরে হেলিয়া পড়িয়া
নিজ মুখছায়া আধেক হেরিয়া
ললিত অধরে উঠিবে ফুটিয়া শরমের মৃদু হাসি॥
শ্রাবণের বারিধারা ঝরিছে বিরামহারা
শ্রাবণের বারিধারা ঝরিছে বিরামহারা।
বিজন শূন্য-পানে চেয়ে থাকি একাকী।
দূর দিবসের তটে মনের আঁধার পটে
অতীতের অলিখিত লিপিখানি লেখা কি।
বিদ্যুৎ মেঘে মেঘেগোপন বহ্নিবেগে
বহি আনে বিস্মৃত বেদনার রেখা কি।
যে ফিরে মালতীবনে, সুরভিত সমীরণে
অন্তসাগরতীরে পাব তার দেখা কি॥
সকলই ফুরাইল যামিনী পোহাইল
সকলই ফুরাইল। যামিনী পোহাইল।
যে যেখানে সবে চলে গেল॥
রজনীতে হাসিখুশি, হরষপ্রমোদরাশি–
নিশিশেষে আকুলমনে চোখের জলে
সকলে বিদায় হল॥
সখা হে কী দিয়ে আমি তুষিব তোমায়
সখা হে, কী দিয়ে আমি তুষিব তোমায়।
জরজর হৃদয় আমার মর্মবেদনায়,
দিবানিশি অশ্রু ঝরিছে সেথায়॥
তোমার মুখে সুখের হাসি আমি ভালোবাসি–
অভাগিনীর কাছে পাছে সে হাসি লুকায়॥
সন্ন্যাসী ধ্যানে নিমগ্ন নগ্ন তোমার চিত্ত
সন্ন্যাসী,
ধ্যানে নিমগ্ন নগ্ন তোমার চিত্ত।
বাহিরে যে তব লীন হল সব বিত্ত॥
রসহীন তরু, নিষ্ঠুর মরু,
বাতাসে বাজিছে রুদ্র ডমরু,
ধরা-ভাণ্ডার রিক্ত॥
জাগো তপস্বী, বাহিরে নয়ন মেলো হে। জাগো!
স্থলে জলে ফুলে ফুলে পল্লবে
চপল চরণ ফেলো হে। জাগো!
জাগো গানে গানে নব নব তানে,
জাগাও উদাস হতাশ পরানে
উদার তোমার নৃত্য॥ জাগাও॥
সহে না যাতনা
সহে না যাতনা
দিবস গণিয়া গণিয়া বিরলে
নিশিদিন বসে আছি শুধু পথপানে চেয়ে–
সখা হে, এলে না।
সহে না যাতনা॥
দিন যায়, রাত যায়, সব যায়–
আমি বসে হায়!
দেহে বল নাই, চোখে ঘুম নাই–
শুকায়ে গিয়াছে আঁখিজল।
একে একে সব আশা ঝ’রে ঝ’রে প’ড়ে যায়–
সহে না যাতনা॥
সাধের কাননে মোর রোপণ করিয়াছিনু
সাধের কাননে মোর রোপণ করিয়াছিনু
একটি লতিকা, সখী, অতিশয় যতনে।
প্রতিদিন দেখিতাম কেমন সুন্দর ফুল
ফুটিয়াছে শত শত হাসি-হাসি আননে।
প্রতিদিন সযতনে ঢালা দিতাম জল,
প্রতিদিন কুল তুলে গাঁথতাম মালিকা।
সোনার লতাটি আহা বন করেছিল আলো–
সে লতা ছিঁড়িতে আছে নিরদয় বালিকা?
কেমন বনের মাঝে আছিল মনের সুখে
গাঁঠে গাঁঠে শিরে শিরে জড়াইয়া পাদপে।
প্রেমের সে আলিঙ্গনে স্নিগ্ধ রেখেছিল তারে
কোমল পল্লবদলে নিবারিয়া আতপে।
এতদিন ফুলে ফুলে ছিল ঢলোঢলো মুখ,
শুকায়ে গিয়াছে আজি সেই মোর লতিকা।
ছিন্ন অবশেষটুকু এখনো জড়ানো বুকে–
এ লতা ছিঁড়িতে আছে নিরদয় বালিকা?