ফুলটি ঝরে গেছে রে
ফুলটি ঝরে গেছে রে।
বুঝি সে উষার আলো উষার দেশে চলে গেছে॥
শুধু সে পাখিটি মুদিয়া আঁখিটি
সারাদিন একলা বসে গান গাহিতেছে॥
প্রতিদিন দেখত যারে আর তো তারে দেখতে না পায়–
তবু সে নিত্যি আসে গাছের শাখে, সেইখেনেতেই বসে থাকে,
সারা দিন সেই গানটি গায় সন্ধ্যা হলে কোথায় চলে যায়॥
বঁধু মিছে রাগ কোরো না
বঁধু, মিছে রাগ কোরো না, কোরো না।
মম মন বুঝে দেখো মনে মনে–মনে রেখো, কোরো করুণা॥
পাছে আপনারে রাখিতে না পারি
তাই কাছে কাছে থাকি আপনারি–
মুখ হেসে যাই, মনে কেঁদে চাই–সে আমার নহে ছলনা॥
দিনেকের দেখা, তিলেকের সুখ,
ক্ষণেকের তরে শুধু হাসিমুখ–
পলকের পরে থাকে বুক ভ’রে চিরজনমের বেদনা।
তারি মাঝে কেন এত সাধাসাধি,
অবুধ আঁধারে কেন মরি কাঁদি–
দূর হতে এসে ফিরে যাই শেষে বহিয়া বিফল বাসনা॥
বলি ও আমার গোলাপ-বালা
বলি, ও আমার গোলাপ-বালা, বলি, ও আমার গোলাপ-বালা —
তোলো মুখানি, তোলো মুখানি–কুসুমকুঞ্জ করো আলা
বলি, কিসের শরম এত! সখী, কিসের শরম এত!
সখী, পাতার মাঝারে লুকায়ে মুখানি কিসের শরম এত।
বালা, ঘুমায়ে পড়েছে ধরা। সখী, ঘুমায় চন্দ্রতারা।
প্রিয়ে, ঘুমায় দিক্বালারা সবে — ঘুমায় জগৎ যত।
বলিতে মনের কথা, সখী, এমন সময় কোথা।
প্রিয়ে, তোলো মুখানি, আছে গো আমার প্রাণের কথা কত।
আমি এমন সুধীর স্বরে, সখী, কহিব তোমার কানে —
প্রিয়ে, স্বপনের মতো সে কথা আসিয়ে পশিবে তোমার প্রাণে।
তবে মুখানি তুলিয়ে চাও, সুধীরে মুখানি তুলিয়ে চাও।
সখী, একটি চুম্বন দাও– গোপনে একটি চুম্বন দাও॥
বলি গো সজনী যেয়ো না যেয়ো না
বলি গো সজনী, যেয়ো না, যেয়ো না–
তার কাছে আর যেয়ো না, যেয়ো না।
সুখে সে রয়েছে, সুখে সে থাকুক–
মোর কথা তারে বোলো না, বোলো না॥
আমায় যখন ভালো সে না বাসে
পায়ে ধরিলেও বাসিবে না সে।
কাজ কী, কাজ কী, কাজ কী সজনী–
মোর তরে তারে দিয়ো না বেদনা॥
বারে বারে ফিরে ফিরে তোমার পানে
বারে বারে ফিরে ফিরে তোমার পানে
দিবারাতি ঢেউয়ের মতো চিত্ত বাহু হানে,
মন্দ্রধ্বনি জেগে ওঠে উল্লোল তুফানে।
রাগরাগিণী উঠে আবর্তিয়া তরঙ্গে নর্তিয়া
গহন হতে উচ্ছলিত স্রোতে।
ভৈরবী রামকেলি পূরবী কেদারা উচ্ছ্বসি যায় খেলি,
ফেনিয়ে ওঠে জয়জয়ন্তী বাগেশ্রী কানাড়া গানে গানে॥
তোমায় আমার ভেসে
গানের বেগে যাব নিরুদ্দেশে।
তালী-তমালী-বনরাজি-নীলা বেলাভূমিতলে ছন্দের লীলা–
যাত্রাপথে পালের হাওয়ায় হাওয়ায়
তালে তালে তালে তানে॥
বিধি ডাগর আঁখি যদি দিয়েছিল
বিধি ডাগর আঁখি যদি দিয়েছিল
সে কি আমারি পানে ভুলে পড়িবে না॥
দুটি অতুল পদতলে রাতুল শতদল
জানি না কী লাগিয়া পরশে ধরাতল,
মাটির ‘পরে তার করুণা মাটি হল–সে পদ মোর পথে চলিবে না?
তব কণ্ঠ ‘পরে হয়ে দিশাহারা
বিধি অনেক ঢেলেছিল মধুধারা।
যদি ও মুখ মনোরম শ্রবণে রাখি মম
নীরবে অতি ধীরে ভ্রমরগীতিসম
দু কথা বল যদি ‘প্রিয়’ বা ‘প্রিয়তম’, তাহে তো কণা মধু ফুরাবে না।
হাসিতে সুধানদী উছলে নিরবধি,
নয়নে ভরি উঠেঅমৃতমহোদধি–
এত সুধা কেন সৃজিল বিধি, যদিআমারি তৃষাটুকু পুরাবে না॥
বুঝি এল বুঝি এল ওরে প্রাণ
বুঝি এল, বুঝি এল ওরে প্রাণ।
এবার ধর্ এবার ধর্ দেখি তোর গান॥
ঘাসে ঘাসে খবর ছোটে, ধরা বুঝি শিউরে ওঠে–
দিগন্তে ওই স্তব্ধ আকাশ পেতে আছে কান॥
বৃথা গেয়েছি বহু গান
বৃথা গেয়েছি বহু গান
কোথা সঁপেছি মন প্রাম!
তুমি তো ঘুমে নিমগন, আমি জাগিয়া অনুখন।
আলসে তুমি অচেতন, আমারে দহে অপমান।–
বৃথা গেয়েছি বহু গান।
যাত্রী সবে তরী খুলে গেল সুদূর উপকূলে,
মহাসাগরতটমূলে ধূ ধূ করিছে এ শ্মশান।–
কাহার পানে চাহ কবি, একাকী বসি ম্লানছবি।
অস্তাচলে গেল রবি, হইল দিবা অবসান।–
বৃথা গেয়েছি বহু গান॥
বড়ো বিস্ময় লাগে হেরি তোমারে
বড়ো বিস্ময় লাগে হেরি তোমারে।
কোথা হতে এলে তুমি হৃদিমাঝারে॥
ওই মুখ ওই হাসি কেন এত ভালোবাসি,
কেন গো নীরবে ভাসি অশ্রুধারে॥
তোমারে হেরিয়া যেনজাগে স্মরণে
তুমি চিরপুরাতন চিরজীবনে।
তুমি না দাঁড়ালে আসি হৃদয়ে বাজে না বাঁশি–
যত আলো যত হাসি ডুবে আঁধারে॥
ভয় নেই রে তোদের নেই রে ভয়
ভয় নেই রে তোদের নেই রে ভয়,
যা চলে সব অভয়-মনে–আকাশে ওই উঠেছে শুকতারা।
দখিন হাওয়ায় পাল তুলে দে, পাল তুলে দে–
সেই হাওয়াতে উড়ছে আমার মন।
ওই শুকতারাতে রেখে দিলেন দৃষ্টি আমার–
ভয় কিছু নেই, ভয় কিছু নেই॥
মন হতে প্রেম যেতেছে শুকায়ে
মন হতে প্রেম যেতেছে শুকায়ে, জীবন হতেছে শেষ।
শিথিল কপোল, মলিন নয়ন, তুষারধবল কেশ।
পাশেতে আমার নীরবে পড়িয়া অযতনে বীণাখানি —
বাজাবার বল নাহিক এ হাতে, জড়িমাজড়িত বাণী।
গীতিময়ী মোর সহচরী বীণা, হইল বিদায় নিতে।
আর কি পারিবি ঢালিবারে তুই অমৃত আমার চিতে।
তবু একবার, আর একবার, ত্যজিবার আগে প্রাণ
মরিতে মরিতে গাইয়া লইব সাধের সে-সব গান।
দুলিবে আমার সমাধি-উপরে তরুগণ শাখা তুলি —
বনদেবতারা গাহিবে তখন মরণের গানগুলি॥
মনে হল পেরিয়ে এলেম অসীম পথ
মনে হল পেরিয়ে এলেম অসীম পথ আসিতে তোমার দ্বারে
মরুতীর হতে সুধাশ্যামল পারে।
পথ হতে গেঁথে এনেছি সিক্তযূথীর মালা,
সকরুণ নিবেদনের গন্ধ ঢালা–
লজ্জা দিয়ো না তারে।
সজল মেঘের ছায়া ঘনায় বনে বনে,
পথহারার বেদন বাজে সমীরণে।
দূরের থেকে দেখেছিলেন বাতায়নের তলে
তোমার প্রদীপ জ্বলে–
আমার আঁখি ব্যাকুল পাখি ঝড়ের অন্ধকারে॥