তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা
তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা তুমি আমার নিভৃত সাধনা,
মম বিজনগগনবিহারী।
আমি আমার মনের মাধুরী মিশায়ে তোমারে করেছি রচনা–
তুমি আমারি, তুমি আমারি, মম বিজনজীবনবিহারী॥
মম হৃদয়রক্তরাগে তব চরণ দিয়েছি রাঙিয়া,
মম সন্ধ্যাগগনবিহারী।
তব অধর এঁকেছি সুধাবিষে মিশে মম সুখদুখ ভাঙিয়া–
তুমি আমারি, তুমি আমারি, মম বিজনস্বপনবিহারী॥
মম মোহের স্বপনলেখা তব নয়নে দিয়েছি পরায়ে।
মম মুগ্ধনয়নবিহারী।
মম সঙ্গীত তব অঙ্গে অঙ্গে দিয়েছি জড়ায়ে জড়ায়ে–
তুমি আমারি, তুমি আমারি, মম মোহনমরণবিহারী॥
তুমি তো সেই যাবেই চ’লে
তুমি তো সেই যাবেই চ’লে, কিছু তো না রবে বাকি–
আমায় ব্যথা দিয়ে গেলে জেগে রবে সেই কথা কি॥
তুমি পথিক আপন-মনে
এলে আমার কুসুমবনে,
চরণপাতে যা দাও দ’লে সে-সব আমি দেব ঢাকি॥
বেলা যাবে আঁধার হবে, একা ব’সে হৃদয় ভ’রে
আমার বেদনখানি আমি রেখে দেব মধুর ক’রে।
বিদায়-বাঁশির করুণ রবে
সাঁঝের গগন মগন হবে,
চোখের জলে দুখের শোভা নবীন ক’রে দেব রাখি॥
তোরা বসে গাঁথিস মালা
তোরা বসে গাঁথিস মালা, তারা গলায় পরে।
কখন যে শুকায়ে যায়, ফেলে দেয় রে অনাদরে॥
তোরা সুধা করিস দান, তারা শুধু করে পান,
সুধায় অরুচি হলে ফিরেও তো নাহি চায় —
হৃদয়ের পাত্রখানি ভেঙে দিয়ে চলে যায়!!
তোরা কেবল হাসি দিবি, তারা কেবল বসে আছে —
চোখের জল দেখিলে তারা আর তো রবে না কাছে।
প্রাণের ব্যথা প্রাণে রেখে প্রাণের আগুন প্রাণে ঢেকে
পরান ভেঙে মধু দিবি অশ্রুছাঁকা হাসি হেসে —
বুক ফেটে, কথা না বলে শুকায়ে পড়িবি শেষে॥
দাঁড়াও মাথা খাও যেও না সখা
দাঁড়াও, মাথা খাও, যেও না সখা।
শুধু সখা, ফিরে চাও, অধিক কিছু নয়–
কতদিন পরে আজি পেয়েছি দেখা॥
আর তো চাহি নে কিছু, কিছু না, কিছু না–
শুধু ওই মুখখানি জন্মশোধ দেখিব।
তাও কি হবে না গো, সখা গো!
শুধু একবার ফিরে চাও॥
দুজনে দেখা হল মধুযামিনী রে
দুজনে দেখা হল মধুযামিনী রে–
কেন কথা কহিল না, চলিয়া গেল ধীরে॥
নিকুঞ্জে দখিনাবায় করিছে হায়-হায়,
লতাপাতা দুলে দুলে ডাকিছে ফিরে ফিরে॥
দুজনের আঁখিবারি গোপনে গেল বয়ে,
দুজনের প্রাণের কথা প্রাণেতে গেল রয়ে।
আর তো হল না দেখা, জগতে দোঁহে একা–
চিরদিন ছাড়াছাড়ি যমুনাতীরে॥
দেখায়ে দে কোথা আছে একটু বিরল
দেখায়ে দে কোথা আছে একটু বিরল।
এই ম্রিয়মাণ মুখে তোমাদের এত সুখে
বলো দেখি কোন্ প্রাণে ঢালিব গরল।
কিনা করিয়াছি তব বাড়াতে আমোদ–
কত কষ্টে করেছিনু অশ্রুবারি রোধ।
কিন্তু পারি নে যে সখা– যাতনা থাকে না ঢাকা,
মর্ম হতে উচ্ছ্বসিয়া উঠে অশ্রুজল।
ব্যথায় পাইয়া ব্যথা যদি গো শুধাতে কথা
অনেক নিভিত তবু এ হৃদি-অনল।
কেবল উপেক্ষা সহি বলো গো কেমনে রহি।
কেমনে বাহিরে মুখে হাসিব কেবল॥
নির্জন রাতে নিঃশব্দ চরণপাতে কেন এলে
নির্জন রাতে নিঃশব্দ চরণপাতে কেন এলে।
দুয়ারে মম স্বপ্নের ধন-সম এ যে দেখি–
তব কণ্ঠের মালা এ কি গেছ ফেলে।
জাগালে না শিয়রে দীপ জ্বেলে–
এলে ধীরে ধীরে নিদ্রার তীরে তীরে,
চামেলির ইঙ্গিত আসে যে বাতাসে লজ্জিত গন্ধ মেলে॥
বিদায়ের যাত্রাকালে পুষ্প-ঝরা বকুলের ডালে
দক্ষিণপবনের প্রাণে
রেখে গেলে বল নি যে কথা কানে কানে–
বিরহাবারতা অরুণ-আভার আভাসে রাঙায়ে গেলে॥
পাখি তোর সুর ভুলিস নে
পাখি, তোর সুর ভুলিস নে–
আমার প্রভাত হবে বৃথাজানিস কি তা।
অরুণ-আলোর করুণ পরশ গাছে গাছে লাগে,
কাঁপনে তার তোরই যে সুর জাগে–
তুই ভোরের আলোর মিতা জানিস কি তা।
আমার জাগরণের মাঝে
রাগিণী তোর মধুর বাজে জানিস কি তা।
আমার রাতের স্বপনতলে প্রভাতী তোর কী যে বলে
নবীন প্রাণের গীতা
জানিস কি তা॥
পাগলিনী তোর লাগি
পাগলিনী, তোর লাগি কী আমি করিব বল্।
কোথায় রাখিব তোরে খুঁজে না পাই ভূমণ্ডল
আদরের ধন তুমি, আদরে রাখিব আমি–
আদরিণী, তোর লাগি পেতেছি এ বক্ষস্থল।
আয় তোরে বুকে রাখি– তুমি দেখো, আমি দেখি–
শ্বাসে শ্বাস মিশাইব, আঁখিজলে আঁখিজল।
পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়
পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়।
ও সেই চোখে দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়।
আয় আর একটিবার আয় রে সখা, প্রাণের মাঝে আয়।
মোরা সুখের দুখের কথা কব, প্রাণ জুড়াবে তায়।
মোরা ভোরের বেলা ফুল তুলেছি, দুলেছি দোলায়–
বাজিয়ে বাঁশি গান গেয়েছি বকুলের তলায়।
হায় মাঝে হল ছাড়াছাড়ি, গেলেম কে কোথায়–
আবার দেখা যদি হল, সখা, প্রাণের মাঝে আয়॥
প্রেম এসেছিল নিঃশব্দচরণে
প্রেম এসেছিল নিঃশব্দচরণে।
তাই স্বপ্ন মনে হল তারে–
দিই নি তাহারে আসন।
বিদায় নিল যবে, শব্দ পেয়ে গেনু ধেয়ে।
সে তখন স্বপ্ন কায়াবিহীন
নিশীথতিমিরে বিলীন–
দূরপথে দীপশিখা রক্তিম মরীচিকা॥
ফিরায়ো না মুখখানি
ফিরায়ো না মুখখানি,
ফিরায়ো না মুখখানি রানী ওগো রানী॥
ভ্রূভঙ্গতরঙ্গ কেন আজি সুনয়নী!
হাসিরাশি গেছে ভাসি, কোন্ দুখে সুধামুখে নাহি বাণী।
আমারে মগন করো তোমার মধুর করপরশে
সুধাসরসে।
প্রাণ মন পুরিয়া দাও নিবিড় হরষে।
হেরো শশীসুশোভন, সজনী,
সুন্দর রজনী।
তৃষিতমধুপসম কাতর হৃদয় মম–
কোন্ প্রাণে আজি ফিরাবে তারে পাষাণী॥