গেল গেল নিয়ে গেল এ প্রণয়স্রোতে
গেল গেল নিয়ে গেল এ প্রণয়স্রোতে
‘যাব না’ ‘যাব না’ করি ভাসায়ে দিলাম তরী–
উপায় না দেখি আর এ তরঙ্গ হতে॥
দাঁড়াতে পাই নে স্থান, ফিরিতে না পারে প্রাণ–
বায়ুবেগে চলিয়াছি সাগরের পথে॥
জানিনু না, শুনিনু না, কিছু না ভাবিনু–
অন্ধ হয়ে একেবারে তাহে ঝাঁপ দিনু।
এত দূর ভেসে এসে ভ্রম যে বুঝেছি শেষে–
এখন ফিরিতে কেন হয় গো বাসনা।
আগেভাগে, অভাগিনী, কেন ভাবিলি না।
এখন যে দিকে চাই কূলের উদ্দেশ নাই–
সম্মুখে আসিছে রাত্রি, আঁধার করিছে ঘোর।
স্রোত প্রতিকূলে যেতে বল যে নাই এ চিতে,
শ্রান্ত ক্লান্ত অবসন্ন হয়েছে হৃদয় মোর॥
গোলাপ ফুল ফুটিয়ে আছে
গোলাপ ফুল ফুটিয়ে আছে, মধুপ, হোথা যাস নে —
ফুলের মুধু লুটিতে গিয়ে কাঁটার ঘা খাস নে॥
হেথায় বেলা, হোথায় চাঁপা শেফালি হোথা ফুটিয়ে
ওদের কাছে মনের ব্যথা বল্ রে মুখ ফুটিয়ে॥
ভ্রমর কহে, “হেথায় বেলা হোথায় আছে নলিনী —
ওদের কাছে বলিব নাকো আজিও যাহা বলি নি।
মরমে যাহা গোপন আছে গোলাপে তাহা বলিব–
বলিতে যদি জ্বলিতে হয় কাঁটারই ঘায়ে জ্বলিব।’
চরণরেখা তব যে পথে দিলে লেখি
চরণরেখা তব যে পথে দিলে লেখি
চিহ্ন আজি তারি আপনি ঘুচালে কি॥
ছিল তো শেফালিকা তোমারি-লিপি-লিখা,
তারে যে তৃণতলে আজিকে লীন দেখি॥
কাশের শিখা যত কাঁপিছে থরথরি,
মলিন মালতী যে পড়িছে ঝরি ঝরি।
তোমার যে আলোকে অমৃত দিত চোখে
স্মরণ তারো কি গো মরণে যাবে ঠেকি॥
চরাচর সকলই মিছে মায়া ছলনা
চরাচর সকলই মিছে মায়া, ছলনা।
কিছুতেই বুলি নে আর– আর না রে–
মিছে ধূলিরাশি লয়ে কী হবে।
সকলই আমি জেনেছি, সবই শূন্য–শূন্য-শূন্য ছায়া–
সবই ছলনা॥
দিনরাত যার লাগি সুখ দুখ না করিনু জ্ঞান,
পরান ম সকলই দিয়েছি, তা হতে রে কিবা পেনু।
কিছু না–সবই ছলনা॥
চলে যাবি এই যদি তোর মনে থাকে
চলে যাবি এই যদি তোর মনে থাকে
ডাকব না, ফিরে ডাকব না–
ডাকি নে তো সকালবেলার শুকতারাকে।
হঠাৎ ঘুমের মাঝখানে কি
বাজবে মনে স্বপন দেখি
‘হয়তো ফেলে এলেম কাকে’–
আপনি চলে আসবি তখন আপন ডাকে॥
জলে-ডোবা চিকন শ্যামল কচি ধানের পাশে পাশে
জলে-ডোবা চিকন শ্যামল কচি ধানের পাশে পাশে
ভরা নদীর ধারে ধারে হাঁসগুলি আজ সারে সারে
দুলে দুলে ওই-যে ভাসে।
অমনি করেই বনের শিরে মৃদু হাওয়ায় ধীরে ধীরে
দিক্রেখাটির তীরে তীরে মেঘ ভেসে যায় নীল আকাশে।
অমনি করেই অলস মনে একলা আমার তরীর কোণে
মনের কথা সারা সকাল যায় ভেসে আজ অকারণে।
অমনি করেই কেন জানি দূর মাধুরীর আভাস আনি
ভাসে কাহার ছায়াখানি আমার বুকের দীর্ঘশ্বাসে॥
জানি জানি এসেছ এ পথে মনের ভুলে
জানি জানি এসেছ এ পথে মনের ভুলে।
তাই হোক তবে তাই হোক–এসো তুমি, দিনু দ্বার খুলে॥
এসেছ তুমি যে বিনা আভরণে, মুখর নূপুর বাজে না চরণে–
তাই হোক ওগো, তাই হোক।
মোর আঙিনায় মালতী ঝরিয়া পড়ে যায়–
তব শিথিল কবরীতে নিয়ো নিয়ো তুলে॥
কোনো আয়োজন নাই একেবারে, সুর বাঁধা হয় নি যে বীণার তারে–
তাই হোক ওগো, তাই হোক।
ঝরো ঝরো বারি ঝরে বনমাঝে আমারই মনের সুর ওই বাজে–
বেণুশাখা-আন্দোলনে আমারই উতলা মন দুলে॥
জীবনে এ কি প্রথম বসন্ত এল
জীবনে এ কি প্রথম বসন্ত এল, এল! এল রে!
নবীন বাসনায় চঞ্চল যৌবন নবীন জীবন পেল।
এল, এল।
বাহির হতে চায় মন, চায়, চায় রে–
করে কাহার অন্বেষণ।
ফাগুন-হাওয়ার দোল দিয়ে যায় হিল্লোল–
চিতসাগর উদ্বেল। এল, এল।
দখিনবায়ু ছুটিয়াছে, বুঝি খোঁজে কোন্ ফুল ফুটিয়াছে–
খোঁজে বনে বনে– খোঁজে আমার মনে।
নিশিদিন আছে মন জাগিকার পদপরশন-লাগি–
তারি তরে মর্মের কাছে শতদলদল মেলিয়াছে
আমার মন॥
ঝাঁকড়া চুলের মেয়ের কথা কাউকে বলি নি
ঝাঁকড়া চুলের মেয়ের কথা কাউকে বলি নি,
কোন্ দেশে যে চলে গেছে সে চঞ্চলিনী।
সঙ্গী ছিল কুকুর কালু, বেশ কিছু তার আলুথালু
আপনা-‘পরে অনাদরে ধুলায় মলিনী॥
হুটোপাটি ঝগড়াঝাঁটি ছিল নিষ্কারণেই।
দিঘির জলে গাছের ডালে গতি ক্ষণে-ক্ষণেই।
পাগলামি তার কানায় কানায় খেয়াল দিয়ে খেলা বানায়,
উচ্চহাসে কলভাষে কল’কলিনী॥
দেখা হলে যখন-তখন বিনা অপরাধে
মুখভঙ্গী করত আমায় অপমানের ছাঁদে।
শাসন করতে যেমন ছুটি হঠাৎ দেখি ধুলায় লুটি
কাজল আঁখি চোখের জলে ছল’ছলিনী॥
আমার সঙ্গে পঞ্চাশ বার জন্মশোধের আড়ি,
কথায় কথায় নিত্যকালের মতন ছাড়াছাড়ি।
ডাকলে তারে ‘পুঁট্লি’ ব’লে সাড়া দিত মর্জি হলে,
ঝগড়া-দিনের নাম ছিল তার স্বর্ণনলিনী॥
তরুণ প্রাতের অরুণ আকাশ শিশির-ছলোছলো
তরুণ প্রাতের অরুণ আকাশ শিশির-ছলোছলো,
নদীর ধারের ঝাউগুলি ওই রৌদ্রে ঝলোমলো।
এমনি নিবিড় ক’রে এরা দাঁড়ায় হৃদয় ভ’রে–
তাই তো আমি জানি বিপুল বিশ্বভুবনখানি
অকুল-মানস-সাগর-জলে কমল টলোমলো।
তাই তো আমি জানি– আমি বাণীর সাথে বাণী,
আমি গানের সাথে গান, আমি প্রাণের সাথে প্রাণ,
আমি অন্ধকারের হৃদয়-ফাটা আলোক জ্বলোজ্বলো॥
তারে দেহো গো আনি
তারে দেহো গো আনি।
ওই রে পুরায় বুঝি অন্তিম যামিনী॥
একটি শুনিব কথা, একটি শুনাব ব্যথা–
শেষবার দেখে নেব সেই মধুমুখানি॥
ওই কোলে জীবনের শেষ সাধ মিটিবে,
ওই কোলে জীবনের শেষ স্বপ্ন ছুটিবে।
জনমে পুরে নি যাহা আজ কি পুরিবে তাহা।
জীবনের সব সাধ ফুরাবে এখনি?