কার হাতে যে ধরা দেব হায়
কার হাতে যে ধরা দেব হায়
তাই ভাবতে আমার বেলা যায়।
ডান দিকেতে তাকাই যখন বাঁয়ের লাগি কাঁদে রে মন–
বাঁয়ের দিকে ফিরলে তখন দখিন ডাকে ‘আয় রে আয়’॥
কালো মেঘের ঘটা ঘটনায় রে
কালো মেঘের ঘটা ঘটনায় রে আঁধার গগনে,
ঝরে ধারা ঝরোঝরো গহন বনে।
এত দিনে বাঁধন টুটে কুঁড়ি তোমার উঠল ফুটে
বাদল-বেলার বরিষনে
ওগো, এবার তুমি জাগো জাগো–
যেন এই বেলাটি হারায় না গো।
অশ্রুভরা কোন্ বাতাসে গন্ধে যে তার ব্যথা আসে–
আর কি গো সে রয় গোপনে॥
কী ধ্বনি বাজে গহনচেতনামাঝে
কী ধ্বনি বাজে
গহনচেতনামাঝে!
কী আনন্দে উচ্ছ্বসিল
মম তনুবীণা গহনচেতনামাঝে।
মনপ্রাণহরা সুধা-ঝরা
পরশে ভাবনা উদাসীনা॥
কী বেদনা মোর জানো সে কি তুমি জানো
কী বেদনা মোর জানো সে কি তুমি জানো
ওগো মিতা, মোর অনেক দূরের মিতা।
আজি এ নিবিড়তিমির যামিনী বিদ্যুতসচকিতা॥
বাদাল-বাতাস ব্যেপে হৃদয় উঠিছে কেঁপে
ওগো সে কি তুমি জানো।
উৎসুক এই দুখজাগরণ এ কি হবে হায় বৃথা॥
ওগো মিতা, মোর অনেক দূরের মিতা,
আমার ভবনদ্বারে রোপণ করিলে যারে
সজল হাওয়ার করুণ পরশে সে মালতী বিকশিতা॥
ওগো সে কি তুমি জানো।
তুমি যার সুর দিয়েছিলে বাঁধি
মোর কোলে আজ উঠিছে সে কাঁদি ওগো সে কি জানো–
সেই-যে তোমার বীণা সে কি বিস্মৃতা॥
কে যেতেছিস আয় রে হেথা
কে যেতেছিস, আয় রে হেথা– হৃদয়খানি যা-না দিয়ে।
বিম্বাধরের হাসি দেব, সুখ দেব, মধুমাখা দুঃখ দেব,
হরিণ-আঁখির অশ্রু দেব অভিমানে মাখাইয়া॥
অচেতন করব হিয়ে বিষে-মাখা সুধা দিয়ে,
নয়নের কালো আলো মরমে বরষিয়ে॥
হাসির ঘায়ে কাঁদাইব, অশ্রু দিয়ে হাসাইব,
মৃণালবাহু দিয়ে সাধের বাঁধন বেঁধে দেব।
চোখে চোখে রেখে দেব–
দেব না হৃদয় শুধু, আর সকলই যা-না নিয়ে॥
কেন গো সে মোরে যেন করে না বিশ্বাস
কেন গো সে মোরে যেন করে না বিশ্বাস।
কেন গো বিষণ্ন আঁখি আমি যবে কাছে থাকি,
কেন উঠে মাঝে মাঝে আকুল নিশ্বাস।
আদর করিতে মোরে চায় কতবার,
সহসা কী ভেবে যেন ফেরে সে আবার।
নত করি দুনয়নে কী যেন বুঝায় মনে,
মন সে কিছুতে যেন পায় না আশ্বাস।
আমি যবে ব্যগ্র হয়ে ধরি তার পাণি
সে কেন চমকি উঠি লয় তাহা টানি।
আমি কাছে গেলে হায় সে কেন গো সরে যায় —
মলিন হইয়া আসে অধর সহাস॥
কেমনে শুধিব বলো তোমার এ ঋণ
কেমনে শুধিব বলো তোমার এ ঋণ।
এ দয়া তোমার, মনে রবে চিরদিন।
যবে এ হৃদয়মাঝে ছিল না জীবন,
মনে হ’ত ধরা যেন মরুর মতন,
সে হৃদে ঢালিয়ে তব প্রেমবারিধার
নূতন জীবন যেন করিলে সঞ্চার।
একদিন এ হৃদয়ে বাজিত প্রেমের গান,
কবিতায় কবিতায় পূর্ণ যেন ছিল প্রাণ–
দিনে দিনে সুখগান থেমে গেল এ হৃদয়ে,
নিশীথশ্মশানসম আছিল নীরব হয়ে–
সহসা উঠেছে বাজি তব করপরশনে,
পুরানো সকল ভাব জাগিয়া উঠেছে মনে,
বিরাজিছে এ হৃদয়ে যেন নব-ঊষাকাল,
শূন্য হৃদয়ের যত ঘুচেছে আঁধারজাল।
কেমনে শুধিব বলো তোমার এ ঋণ।
এ দয়া তোমার, মনে রবে চিরদিন॥
খুলে দে তরণী খুলে দে তোরা
খুলে দে তরণী, খুলে দে তোরা, স্রোত বহে যায় যে।
মন্দ মন্দ অঙ্গেভঙ্গে নাচিছে তরঙ্গ রঙ্গে–এই বেলা খুলে দে॥
ভাঙিয়ে ফেলেছি হাল, বাতাসে পুরেছে পাল,
স্রোতোমুখে প্রাণ মন যাক ভেসে যাক–
যে যাবি আমার সাথে এই বেলা আয় রে॥
গন্ধরেখার পন্থে তোমার শূন্যে গতি
গন্ধরেখার পন্থে তোমার শূন্যে গতি,
লেখন রে মোর, ছন্দ-ডানার প্রজাপতি–
স্বপ্নবনের ছায়ায় আলোয় বেড়াস দুলি
পরান-কণা বিন্দুসুরার নেশার ঘোরে॥
চৈত্র হাওয়ায় যে চঞ্চলের ক্ষণিক বাসা
পাতায় পাতায় করিস প্রচার তাহার ভাষা–
অপ্সরীদের দোলের দিনের আবির-ধূলি
কৌতুকে ভোর পাঠায় কে তোর পাখায় ভ’রে॥
তোর মাঝে মন কীর্তি আপন নিষ্কাতরেই করল হেলা।
তার সে চিকন রঙের লিখন ক্ষণেকতরেই খেয়াল খেলা।
সুর বাঁধে আর সুর সে হারায় দণ্ডে পলে,
গান বহে যায় লুপ্ত সুরের ছায়ার তলে,
পশ্চাতে আর চায় না তাহার চপল তুলি–
রয় না বাঁধা আপন ছবির রাখীর ভোরে॥
গা সখী গাইলি যদি আবার সে গান
গা সখী, গাইলি যদি, আবার সে গান।
কতদিন শুনি নাই ও পুরানো তান॥
কখনো কখনো যবে নীরব নিশীথে
একেলা রয়েছি বসি চিন্তামগ্নে চিতে–
চমকি উঠিত প্রাণ–কে যেন গায় সে গান,
দুই-একটি কথা তার পেতেছি শুনিতে।
হা হা সখী, সেদিনের সব কথাগুলি
প্রাণের ভিতরে যেন উঠিছে আকুলি।
যেদিন মরিব, সখী, গাস্ ওই গান–
শুনিতে শুনিতে যেন যায় এই প্রাণ॥
গিয়াছে সে দিন যে দিন হৃদয়
গিয়াছে সে দিন যে দিন হৃদয় রূপেরই মোহনে আছিল মাতি,
প্রাণের স্বপন আছিল যখন– ‘প্রেম’ ‘প্রেম’ শুধু দিবস-রাতি।
শান্তিময়ী আশা ফুটেছে এখন হৃদয়-আকাশপটে,
জীবন আমার কোমল বিভায় বিমল হয়েছে বটে,
বালককালের প্রেমের স্বপন মধুর যেমন উজল যেমন
তেমন কিছুই আসিবে না —
তেমন কিছুই আসিবে না॥
সে দেবীপ্রতিমা নারিব ভুলিতে প্রথম প্রণয় আঁকিল যাহা,
স্মৃতিমরু মোর শ্যামল করিয়া এখনো হৃদয়ে বিরাজে তাহা।
সে প্রতিমা সেই পরিমলসম পলকে যা লয় পায়,
প্রভাতকালের স্বপন যেমন পলকে মিশায়ে যায়
অলসপ্রবাহ জীবনে আমার সে কিরণ কভু ভাসিবে না আর —
সে কিরণ কভু ভাসিবে না —
সে কিরণ কভু ভাসিবে না॥