ও কথা বোলো না তারে
ও কথা বোলো না তারে, কভু সে কপট না রে–
আমার কপাল-দোষে চপল সেজন।
অধীরহৃদয় বুঝি শান্তি নাহি পায় খুঁজি,
সদাই মনের মতো করে অন্বেষণ।
ভালো সে বাসিত যবে করে নি ছলনা।
মনে মনে জানিত সে সত্য বুঝি ভালোবাসে–
বুঝিতে পারেনি তাহা যৌবনকল্পনা।
হরষে হাসিত যবে হেরিয়া আমায়,
সে হাসি কি সত্য নয়। সে যদি কপট হয়
তবে সত্য বলে কিছু নাহি এ ধরায়।
ও কথা বোলো না তারে– কভু সে কপট না রে,
আমার কপাল-দোষে চপল সেজন।
প্রেমমরীচিকা হেরি ধায় সত্য মনে করি,
চিনিতে পারে নি সে যে আপনার মন॥
ও গান আর গাস্ নে
ও গান আর গাস্ নে, গাস্ নে, গাস্ নে।
যে দিন গিয়েছে সে আর ফিরিবে না–
তবে ও গান গাস্ নে॥
হৃদয়ে যে কথা লুকানো রয়েছে সে আর জাগাস নে॥
ও জলের রানী ঘাটে বাঁধা একশো ডিঙি
ও জলের রানী,
ঘাটে বাঁধা একশো ডিঙি–জোয়ার আসে থেমে,
বাতাস ওঠে দখিন-মুখে। ও জলের রানী,
ও তোর ঢেউয়ের নাচন নেচে দে–
ঢেউগুলো সব লুটিয়ে পড়ুক বাঁশির সুরে কালো-ফণী॥
ওই কথা বলো সখী
ওই কথা বলো সখী, বলো আর বার–
ভালোবাস মোরে তাহা বলো বার বার।
কতবার শুনিয়াছি, তবুও আবার যাচি–
ভালোবাস মোরে তাহা বলো গো আবার॥
ওকি সখা কেন মোরে কর তিরস্কার
ওকি সখা, কেন মোরে কর তিরস্কার!
একটু বসি বিরলে কাঁদিব যে মন খুলে
তাতেও কী আমি বলো করিনু তোমার।
মুছাতে এ অশ্রুবারি বলি নি তোমায়,
একটু আদরের তরে ধরি নি তো পায়–
তবে আর কেন, সখা, এমন বিরাগ-মাখা
ভ্রূকুটি এ ভগ্নবুকে হানো বার বার
জানি জানি এ কপাল ভেঙেছে যখন
অশ্রুবারি পারিবে না গলাতে ও মন–
পথের পথিকও যদি মোরে হেরি যায় কাঁদি
তবুও অটল রবে হৃদয় তোমার॥
ওকি সখা মুছ আঁখি
ওকি সখা, মুছ আঁখি। আমার তরেও কাঁদিবে কি!
কে আমি বা! আমি অভাগিনী– আমি মরে তাহে দুখ কিবা॥
পড়ে ছিনু চরণতলে– দলে গেছ, দেখ নি চেয়ে।
গেছ গেছ, ভালো ভালো– তাহে দুখ কিবা॥
ওকে কেন কাঁদালি
ওকে কেন কাঁদালি! ও যে কেঁদে চলে যায়–
ওর হাসিমুখ যে আর দেখা যাবে না॥
শূন্যপ্রাণে চলে গেল, নয়নেতে অশ্রুজল–
এ জনমে আর ফিরে চাবে না॥
দু দিনের এ বিদেশে কেন এল ভালোবেসে,
কেন নিয়ে গেল প্রাণে বেদনা।
হাসি খেলা ফুরালো রে, হাসিব আর কেমনে!
হাসিতে তার কান্নামুখ পড়ে যে মনে।
ডাক্ তারে একবার– কঠিন নহে প্রাণ তার!–
আর বুঝি তার সাড়া পাবে না॥
ওগো জলের রানী
ওগো জলের রানী,
ঢেউ দিয়ো না, দিয়ো না ঢেউ দিয়ো না গো–
আমি যে ভয় মানি।
কখন তুমি শান্তগভীর, কখন্ টলোমলো–
কখন্ আঁখি অধীর হাস্যমদির,কখন্ ছলোছলো–
কিছুই নাহি জানি।
যাও কোথা যাও, কোথা যাও যে চঞ্চলি।
লও গো ব্যাকুল বকুলবনের মুকুল-অঞ্জলি।
দখিন-হাওয়ায় বনে বনে জাগল মরোমরো–
বুকের ‘পরে পুলক-ভরে কাঁপুক থরোথরো
সুনীল আঁচলখানি।
হাওয়ার দুলালী,
নাচের তালে তালে শ্যামল কুলের মন ভুলালি!
ওগো অরুণ আলোর মানিক-মালা দোলাব ওই স্রোতে,
দেব হাতে গোপন রাতে আঁধার গগন হতে
তারার ছায়া আনি॥
ওরা অকারণে চঞ্চল
ওরা অকারণে চঞ্চল
ডালে ডালে দোলে বায়ুহিল্লোলে নবপল্লবদল॥
বাতাসে বাতাসে প্রাণভরা বাণী শুনিতে পেয়েছে কখন কী জানি,
মর্মরতানে দিকে দিকে আনে কৈশোরকোলাহল॥
ওরা কান পেতে শোনে গগনে গগনে মেঘে মেঘে কানাকানি,
বনে বনে জানাজানি।
ওরা প্রাণঝরনার উচ্ছলধার ঝরিয়া ঝরিয়া বহে অনিবার,
চিরতাপসিনী ধরণীর ওরা শ্যামশিখা হোমানল॥
ওরে বকুল পারুল ওরে শালপিয়ালের বন
ওরে বকুল পারুল, ওরে শালপিয়ালের বন,
কোন্খানে আজ পাই আমার মনের মতন ঠাঁই।
যেথায় আমার ফাগুন ভরে দেব দিয়ে আমার মন,
দিয়ে আমার সকল মন॥
সারা গগনতলে তুমুল রঙের কোলাহলে
তোদের মাতামাতির নেই যে বিরাম কোথাও অনুক্ষণ,
নেই একটি বিরল ক্ষণ
যেথায় আমার ফাগুন ভরে দেব দিয়ে আমার মন,
দিয়ে আমার সকল মন॥
ওরে বকুল পারুল, ওরে শালপিয়ালের বন,
আকাশ নিবিড় করে তোরা দাঁড়াস নে ভিড় করে
আমি চাই নে, চাই নে, চাই নে এমন গন্ধ রঙের
বিপুল আয়োজন। আমি চাই নে।
অকুল অবকাসে যেথায় স্বপ্নকমল ভাসে
এমন দে আমারে একটি আমার গগন-জোড়া কোণ,
আমার একটি অসীম কোণ
যেথায় আমার ফাগুন ভরে দেব দিয়ে আমার মন–
দিয়ে আমার সকল মন॥
কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া
কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া
তোমার চরণে দিব হৃদয় খুলিয়া
চরণে ধরিয়া তব কহিব প্রকাশি
গোপনে তোমারে, সখা, কত ভালোবাসি।
ভেবেছিনু কোথা তুমি স্বর্গের দেবতা,
কেমনে তোমারে কব প্রণয়ের কথা।
ভেবেছিনু মনে মনে দূরে দূরে থাকি
চিরজন্ম সঙ্গোপনে পূজিব একাকী–
কেহ জানিবে না মোর গভীর প্রণয়,
কেহ দেখিবে না মোর অশ্রুবারিচয়।
আপনি আজিকে যবে শুধাইছ আসি,
কেমনে প্রকাশি কব কত ভালোবাসি॥
কাছে ছিলে দূরে গেলে
কাছে ছিলে, দূরে গেলে–দূর হতে এসো কাছে।
ভুবন ভ্রমিলে তুমি–সে এখনো বসে আছে॥
ছিল না প্রেমের আলো, চিনিতে পারো নি ভালো–
এখন বিরহানলে প্রেমানল জ্বলিয়াছে।
জটিল হয়েছে জাল, প্রতিকূল হল কাল–
উন্মাদ তানে তানে কেটে গেছে তাল।
কে জানে তোমার বীণা সুরে ফিরে যাবে কি না–
নিঠুর বিধির টানে তার ছিঁড়ে যায় পাছে॥