আমার হারিয়ে যাওয়া দিন
আমার হারিয়ে যাওয়া দিন
আর কি খুঁজে পাব তারে
বাদল-দিনের আকাশ-পারে–
ছায়ায় হল লীন।
কোন্ করুণ মুখের ছবি
পুবেন হাওয়ায় মেলে দিল
সজল ভৈরবী।
এই গহন বনচ্ছায়
অনেক কালের স্তব্ধবাণী
কাহার অপেক্ষায়
আছে বচনহীন॥
আমি স্বপনে রয়েছি ভোর
আমি স্বপনে রয়েছি ভোর, সখী, আমারে জাগায়ো না।
আমার সাধের পাখি যারে নয়নে নয়নে রাখি
তারি স্বপনে রয়েছি ভোর, আমার স্বপন ভাঙায়ো না।
কাল ফুটিবে রবির হাসি, কাল ছুটিবে তিমিররাশি–
কাল আসিবে আমার পাখি, ধীরে বসিবে আমার পাশ।
ধীরে গাহিবে সুখের গান, ধীরে ডাকিবে আমার নাম।
ধীরে বয়ান তুলিয়া নয়ান খুলিয়া হাসিব সুখের হাস।
আমার কপোল ভ’রে শিশির পড়িবে ঝ’রে–
নয়নেতে জল, অধরেতে হাসি, মরমে রহিব ম’রে!
তাহারি স্বপনে আজি মজিয়া রয়েছি আঁখি–
কখন আসিবে প্রাতে আমার সাধের পাখি
কখন জাগাবে মোরে আমার নামটি ডাকি॥
আয় তোরা আয় আয় গো
আয় তোরা আয় আয় গো–
গাবার বেলা যায় পাছে তোর যায় গো।
শিশিরকণা ঘাসে ঘাসে শুকিয়ে আসে,
নীড়ের পাখি নীল আকাশে চায় গো।
সুর দিয়ে যে সুর ধরা যায়, গান দিয়ে পাই গান,
প্রাণ দিয়ে পাই প্রাণ–তোর আপন বাঁশি আন্,
তবেই যে তুই শুনতে পাবি কে বাঁশি বাজায় গো।
শুকনো দিনের তাপ তোর বসন্তকে দেয় না যেন শাপ।
ব্যর্থ কাজে মগ্ন হয়ে লগ্ন যদি যায় গো ব’য়ে
গান-হারানো হাওয়া তখন করবে যে ‘হায় হায়’ গো॥
উদাসিনী সে বিদেশিনী কে নাই বা তারে জানি
উদাসিনী সে বিদেশিনী কে নাই বা তারে জানি
মনে জাগে নব নব রাগে তারি মরীচিকা-ছবিখানি॥
পুবের হাওয়ায় তরীখানি তার
ভাঙা এ ঘাট কবে হল পার,
রঙিন মেঘে আর রঙিন পালে তার করে গেল কানাকানি॥
একা আলসে গণি বসে পলাতকা যত ঢেউ।
যায় তারা যায়, ফেরে না, চায় না পিছু-পানে আর কেউ।
জানি তার নাগাল পাব না, আমার ভাবনা
শূন্যে শূন্যে কুড়ায়ে বেড়ায় বাদলের বাণী॥
এ কী হরষ হেরি কাননে
এ কী হরষ হেরি কাননে।
পরান আকুল, স্বপন বিকশিত মোহমদিরাময় নয়নে॥
ফলে ফুলে করিছে কোলাকুলি, বনে বনে বহিছে সমীরণ
নবপল্লবে হিল্লোল তুলিয়ে– বসন্তপরশে বন শিহরে।
কী জানি কোথা পরান মন ধাইছে বসন্তসমীরণে॥
ফুলেতে শুয়ে জোছনা হাসিতে হাসি মিলাইছে।
মেঘ ঘুমায়ে ঘুমায়ে ভেসে যায় ঘুমভারে অলসা বসুন্ধরা–
দূরে পাপিয়া পিউ-পিউ রবে ডাকিছে সঘনে॥
এ ভালোবাসার যদি দিতে প্রতিদান
এ ভালোবাসার যদি দিতে প্রতিদান–
একবার মুখ তুলে চাহিয়া দেখিতে যদি
যখন দুখের জল বর্ষিত নয়ান–
শ্রান্ত ক্লান্ত হয়ে যবে ছুটে আসিতাম, সখী,
ওই মধুময় কোলে দিতে যদি স্থান–
তা হলে, তা হলে, সখী, চিরজীবনের তরে
দারুণযাতনাময় হ’ত না পরান।
একটি কথায় তব একটু স্নেহের স্বরে
যদি যায় জুড়াইয়া হৃদয়ের জ্বালা,
তবে সেইটুকু, সখী, কোরো অভাগার তরে–
নহিলে হৃদয় যাবে ভেঙেচুরে বালা!
একবার মুখ তুলে চেয়ো এ মুখের পানে–
মুছায়ে দিয়ো গো, সখী, নয়নের জল–
তোমার স্নেহের ছায়ে আশ্রয় দিয়ো গো মোরে,
আমার হৃদয় মন বড়োই দুর্বল।
সংসারের স্রোতে ভেসে কত দূর যাব চলে–
আমি কোথা রব আর তুমি কোথা রবে।
কত বর্ষ হবে গত, কত সূর্য হবে অস্ত,
আছিল নূতন যাহা পুরাতন হবে।
তখন সহসা যদি দেখা হয় দুইজনে–
আসি যদি কহিবারে মরমের ব্যথা–
তখন সঙ্কোচভরে দূরে কি যাইবে সরে।
তখন কি ভালো করে কবে নাকো কথা।
একবার বলো সখী ভালোবাস মোরে
একবার বলো, সখী, ভালোবাস মোরে–
রেখো না ফেলিয়া আর সন্দেহের ঘোরে।
সখী, ছেলেবেলা হতে সংসারের পথে পথে
মিথ্যা মরীচিকা লয়ে যেপেছি সময়।
পারি নে, পারি নে আর– এসেছি তোমার দ্বার–
একবার বলো, সখী, দিবে কি আশ্রয়।
সহেছি ছলনা এত, ভয় হয় তাই
সত্যকার সুখ বুঝি এ কপালে নাই।
বহুদিন ঘুমঘোরে ডুবায়ে রাখিয়া মোরে
অবশেষে জাগায়ো না নিদারুণ ঘায়।
ভালোবেসে থাকো যদি লও লও এই হৃদি-
ভগ্ন চূর্ণ দগ্ধ এই হৃদয় আমার
এ হৃদয় চাও যদি লও উপহার॥
এতদিন পরে সখী সত্য সে কি হেথা ফিরে এল
এতদিন পরে, সখী, সত্য সে কি হেথা ফিরে এল।
দীনবেশে ম্লানমুকে কেমনে অভাগিনী
যাবে তার কাছে সখী রে।
শরীর হয়েছে ক্ষীণ, নয়ন জ্যোতিহীন–
সবই গেছে কিছু নাই– রূপ নাই, হাসি নাই–
সুখ নাই, আশা নাই — সে আমি আর আমি নাই–
না যদি চেনে সে মোরে তা হলে কী হবে॥
এবার বুঝি ভোলার বেলা হল
এবার বুঝি ভোলার বেলা হল–
ক্ষতি কী তাহে যদি বা তুমি ভোলো॥
যাবার রাতি ভরিল গানে
সেই কথাটি রহিল প্রাণে,
ক্ষণেক-তরে আমার পানে
করুণ আঁখি তোলো॥
সন্ধ্যাতারা এমনি ভরা সাঁঝে
উঠিবে দূরে বিরহাকাশমাঝে।
এই-যে সুর বাজে বীণাতে
যেখানে যাব রহিবে সাথে,
আজিকে তবে আপন হাতে
বিদায়দ্বার খোলো॥
এসো এসো ওগো শ্যামছায়াঘন দিন
এসো এসো ওগো শ্যামছায়াঘন দিন, এসো এসো।
আনো আনো তব মল্লারমন্দ্রিত বীন॥
বীণা বাজুক রমকি ঝমকি,
বিজুলির অঙ্গুলি নাচুক চমকি চমকি চমকি।
নবনীপকুঞ্জনিভৃতে কিশলয়মর্মরগীতে–
মঞ্জীর বাজুক রিন্-রিন্-রিন্-রিন্॥
নৃত্যতরঙ্গিত তটিনী বর্ষণনন্দিত নটিনী–আনন্দিত নটিনী,
চলো চলো কূল উচ্ছলিয়া কলো-কলো-কলো কল্লোলিয়া।
তীরে তীরে বাজুক অন্ধকারে ঝিল্লির ঝঙ্কার ঝিন্-ঝিন্-ঝিন্-ইন॥