- বইয়ের নামঃ প্রেম ও প্রকৃতি
- লেখকের নামঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- প্রকাশনাঃ মুঠোবই
- বিভাগসমূহঃ রবীন্দ্রসংগীত
অনন্তসাগরমাঝে দাও তরী ভাসাইয়া
অনন্তসাগরমাঝে দাও তরী ভাসাইয়া।
গেছে সুখ, গেছে দুখ, গেছে আশা ফুরাইয়া॥
সম্মুখে অনন্ত রাত্রি, আমরা দুজনে যাত্রী,
সম্মুখে শয়ান সিন্ধু দিগ্বিদিক হারাইয়া॥
জলধি রয়েছে স্থির, ধূ-ধূ করে সিন্ধুতীর,
প্রশান্ত সুনীল নীর নীল শূণ্যে মিশাইয়া।
নাহি সাড়া, নাহি শব্দ, মন্ত্রে যেন সব স্তব্ধ,
রজনী আসিছে ধীরে দুই বাহু প্রসারিয়া॥
অবেলায় যদি এসেছ আমার বনে
অবেলায় যদি এসেছ আমার বনে দিনের বিদায়ক্ষণে
গেয়ো না, গেয়ো না চঞ্চল গান ক্লান্ত এ সমীরণে
ঘন বকুলের ম্লান বীথিকায়
শীর্ণ যে ফুল ঝ’রে ঝ’রে যায়
তাই দিয়ে হার কেন গাঁথ হায়, লাজ বাসি তায় মনে।
চেয়ো না, চেয়ো না মোর দীনতায় হেলায় নয়ন-কোণে॥
এসো এসো কাল রজনীর অবসানে প্রভাত-আলোর দ্বারে।
যেয়ো না, যেয়ো না অকালে হানিয়া সকালে কলিকারে।
এসো এসো যদি কভু সুসময়
নিয়ে আসে তার ভরা সঞ্চয়,
চিরনবীনের যদি ঘটে জয়–সাজি ভরা হয় ধনে।
নিয়ো না, নিয়ো না মোর পরিচয়
এ ছায়ার আবরণে॥
অসীম সংসারে যার কেহ নাহি কাঁদিবার
অসীম সংসারে যার কেহ নাহি কাঁদিবার
সে কেন গো কাঁদিছে!
অশ্রুজল মুছিবার নাহি রে অঞ্চল যার
সেও কেন কাঁদিছে!
কেহ যার দুঃখগান শুনিতে পাতে না কান,
বিমুখ সে হয় যারে শুনাইতে চায়,
সে আর কিসের আশে রয়েছে সংসারপাশে–
জ্বলন্ত পরান বহে কিসের আশায়॥
আজ বুকের বসন ছিঁড়ে ফেলে দাঁড়িয়েছে
আজ বুকের বসন ছিঁড়ে ফেলে দাঁড়িয়েছে এই প্রভাতখানি।
আকাশেতে সোনার আলোয় ছড়িয়ে গেল তাহার বাণী।
ওরে মন, খুলে দে মন, যা আছে তোর খুলে দে–
অন্তরে যা ডুবে আছে আলোক-পানে তুলে দে।
আনন্দে সব বাধা টুটে সবার সাথে ওঠ্ রে ফুটে–
চোখের ‘পরে আলস-ভরে রাখিস নে আর আঁচল টানি॥
আজি মোর দ্বারে কাহার মুখ হেরেছি
আজি মোর দ্বারে কাহার মুখ হেরেছি।
জাগি উঠে প্রাণে গান কত যে।
গাহিবারে সুর ভুলে গেছি রে॥
আজি কোন্ সুরে বাঁধিব
আজি কোন্ সুরে বাঁধিব দিন-অবসান-বেলারে
দীর্ঘ ধূসর অবকাশে সঙ্গীজনবিহীন শূন্য ভবনে।–
সে কি মূক বিরহস্মৃতি গুঞ্জরণে তন্দ্রাহারা ঝিল্লিরবে।
সে কি বিচ্ছেদরজনীর যাত্রী বিহঙ্গের পক্ষধ্বনিতে।
সে কি অবগুণ্ঠিত প্রেমের কুণ্ঠিত বেদনায় সম্বৃত দীর্ঘশ্বাসে।
সে কি উদ্ধত অভিমানে উদ্যত উপেক্ষায় গর্বিত মঞ্জীরঝঙ্কারে॥
আপনহারা মাতোয়ারা আছি তোমার আশা ধরে
আপনহারা মাতোয়ারা আছি তোমার আশা ধরে–
ওগো সাকী, দেবে না কি পেয়ালা মোর ভ’রে ভ’রে॥
রসের ধারা সুধায় ছাঁকা, মৃগনাভির আভাস মাখা গো,
বাতাস বেয়ে সুবাস তারি দূরের থেকে মাতায় মোরে॥
মুখ তুলে চাও ওগো প্রিয়ে– তোমার হাতের প্রসাদ দিয়ে
এক রজনীর মতো এবার দাও না আমায় অমর ক’রে।
নন্দননিকুঞ্জশাখে অনেক কুসুম ফুটে থাকে গো,
এমন মোহন রূপ দেখি নাই গন্ধ এমন কোথায় ওরে॥
আবার মোরে পাগল করে দিবে কে
আবার মোরে পাগল করে দিবে কে।
হৃদয় যেন পাষাণ-হেন বিরাগ-ভরা বিবেকে॥
আবার প্রাণে নূতন টানে প্রেমের নদী
পাষাণ হতে উছল স্রোতে বহায় যদি–
আবার দুটি নয়নে লুটি হৃদয় হ’রে নিবে কে!
আবার মোরে পাগল করে দিবে কে॥
আবার কবে ধরণী হবে তরুণা।
কাহার প্রেমে আসিবে নেমে স্বরগ হতে করুণা॥
নিশীথনভে শুনিব কবে গভীর গান,
যে দিকে চাব দেখিতে পাব নবীন প্রাণ,
নূতন প্রীতি আনিবে নিতি কুমারী উষা অরুণা।
আবার কবে ধরণী হবে তরুণা।
দিবে সে খুলি এ ঘোর ধূলি- আবরণ।
তাহার হাতেআঁখির পাতে জগত-জাগা জাগরণ।
সে হাসিখানিআনিবে টানি সবার হাসি।
গড়িবে গেহ, জাগাবে স্নেহ– জীবনরাশি।
প্রকৃতিবধূ চাহিবে মধু, পরিবে নব আভরণ–
সে দিবে খুলি এ ঘোর ধূলি- আবরণ।
হৃদয়ে এসে মধুর হেসে প্রাণের গান গাহিয়া
পাগল করে দিবে সে মোরে চাহিয়া
আপনা থাকিভাসিবে আঁখি আকুল নীরে,
ঝরনা-সম জগত-মম ঝরিবে শিরে–
তাহার বাণীদিবে গো আনি সকল বাণী বাহিয়া।
পাগল করে দিবে সে মোরে চাহিয়া।
আমরা ঝ’রে-পড়া ফুলদল
আমরা ঝ’রে-পড়া ফুলদল ছেড়ে এসেছি ছায়া-করা বনতল–
ভুলায়ে নিয়ে এল মায়াবী সমীরণে।
মাধবীবল্লরী করুণ কল্লোলে
পিছন-পানে ডাকে কেন ক্ষণে ক্ষণে।
মেঘের ছায়া ভেসে চলে চির উদাসী স্রোতের জলে–
দিশাহারা পথিক তারা
মিলায় অকূল বিস্মরণে॥
আমাকে যে বাঁধবে ধরে
আমাকে যে বাঁধবে ধরে, এই হবে যার সাধন–
সে কি অমনি হবে।
আমার কাছে পড়লে বাঁধা সেই হবে মোর বাঁধন–
সে কি অমনি হবে॥
কে আমারে ভরসা করে আনতে আপন বশে–
সে কি অমনি হবে।
আপনাকে সে করুক-না বশ, মজুক প্রেমের রসে–
সে কি অমনি হবে।
আমাকে যে কাঁদাবে তার ভাগ্যে আছে কাঁদন–
সে কি অমনি হবে।
আমার কী বেদনা সে কি জানো
আমার কী বেদনা সে কি জানো
ওগো মিতা, সুদূরের মিতা।
বর্ষণনিবিড় তিমিরে যামিনী বিজুলি-সচকিতা॥
বাদল-বাতাস ব্যেপে আমার হৃদয় উঠিছে কেঁপে–
সে কি জানো তুমি জানো।
উৎসুক এই দুখজাগরণ এ কি হবে বৃথা
ওগো মিতা, সুদূরের মিতা,
আমার ভবনদ্বারে বোপিলে যারে
সেই মালতী আজি বিকশিতা–সে কি জানো।
যারে তুমিই দিয়েছ বাঁধি
আমার কোলে সে উঠিছে কাঁদি–সে কি জানো তুমি জানো।
সেই তোমার বীণা বিস্মৃতা॥