হতে পারে যে, সত্যিই তাদের একাংশ তা করেন না। সে-ক্ষেত্রে সন্দেহ স্বাভাবিক যে, যদিও তারা শহুরে সংস্কৃতির কোলে বর্ধিত হয়েছেন, তবু নাগরিক পরিবেশ ও শিক্ষার সূক্ষ্মতা ও জটিলতা তাদের স্পর্শ করতে পারেনি। (সেটা যে একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার, তা-ও নয়। বস্তৃত, আজন্ম শহরে কাটিয়েও চলনে-বালনে আমৃত্যু এক ধরনের গ্রাম্য সারল্য বজায় রেখে যান, এমন মানুষও এই কলকাতায় অনেক চোখে পড়বে।) অন্যদিকে, সূক্ষ্মতা ও জটিলতার মধ্যে যাঁরা আদৌ অস্বস্তি বোধ করেন না, এবং চরিত্রে ও মেজাজে যাঁরা সর্বৈব আর্বান, বৈঠকখানায় বাঁকুড়ার ধর্মঠাকুরের ঘোড়া কিংবা পুরুলিয়ার ছৌ-নৃত্যের মুখোশ সাজিয়ে তাঁরা যখন আধুনিক বাংলা কবিতার আদ্যশ্ৰাদ্ধ করেন, এবং ঘোষণা করেন যে, এই কবিতা আমাদের সংস্কৃতির বহির্ভূত একটা ব্যাপার, ফলত এতে আমাদের নান্দনিক ক্ষুধার তৃপ্তি নেই, তখন তাঁদের ভণ্ড না-বলে কোনও গত্যন্তর থাকে না।
ভণ্ডামির সঙ্গে হাত মিলিয়েছে মুখতা। ভণ্ডেরা সব জেনেশুনেও যে অতীতের জয়ধ্বনি দেয়, তার কারণ, তারা জানে যে, তাতেই হাততালি মিলাবার সম্ভাবনা। সেকেলে ছায়াছবিতে দূরবাসী স্বামীকে যে-কারণে একটু শিথিল-চরিত্রের মানুষ হিসেবে দেখানো হত, এবং মদিরাক্ষী মায়াবিনীর খপ্পর থেকে যে-কারণে তাকে আবার সাধবী রমণীর কাছে ফিরিয়ে আনা হত, কিংবা শ্রমিকের প্রণয়িনী নায়িকার শিল্পপতি-পিতাকে দিয়ে যে-কারণে অতি উদাত্ত কণ্ঠে বালানো হত, “ভাইসব, এই কারখানা আমি তোমাদের নামেই লিখে দিলুম”, একেলে নাগরিক মজলিশেও ঠিক সেই একই কারণে অনেকসময়ে সেকেলে ধাঁচের কবিতার জন্য অশ্রুমোচন করা হয়। এ আর কিছুই নয়, নিছক ক্ল্যাপট্র্যাপের ব্যাপার।
আর মূর্খেরা সে-ক্ষেত্রে জানেও না যে, জীবন্ত যে-কোনও সংস্কৃতির সীমারেখা কীভাবে দিনে দিনে, আমাদের দৃষ্টির অগোচরে, দূর থেকে আরও দূরে সরে যেতে থাকে। একটি জীবন্ত ভাষা যেভাবে অন্য ভাষার শব্দ আত্মসাৎ করে, একটি জীবন্ত সংস্কৃতিও ঠিক তেমনভাবেই রচনা করে তার নবীনতর প্রয়াসের ক্ষেত্র, কিংবা হাত বাড়িয়ে দেয় অন্যবিধ প্রবণতার দিকে, এবং এইভাবেই ক্ৰমে বাড়িয়ে নেয়। তার সীমানা। এই যে জীবন্ততা, এরই দিকে আঙুল তুলেছিলেন এক বাঙালি কবি। সংস্কৃতি-বিষয়ক এক বিতর্ক-বৈঠকে রহস্যচ্ছলে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন যে, বঙ্গসংস্কৃতি বলতে কি আমরা এমন এক অট্টালিকার কথা বুঝব, যার নির্মাণকার্য আজ থেকে অনেককাল আগেই সমাপ্ত হয়ে গেছে, এবং যাতে আর এখন নতুন করে কিছু জানলা-দরজা ফোটাবার কিংবা যার ঘরের সংখ্যা কিছু বাড়িয়ে নেবার কোনও উপায়ই আর নেই?
না, তা আমরা বুঝি না। বঙ্গসংস্কৃতি যদি শুধু জারি সারি, আউল বাউল, পালপার্বণ, আলপনা আর পাঁচালির মধ্যেই আটকে থাকত, তাহলে বুঝতে হত যে, এর প্রাণশক্তি কবেই নিঃশেষ হয়ে গেছে। কিন্তু সেটা হয়নি বলেই তার পরিসর এখন আগের তুলনায় অনেক বড়ো। একদিকে সে যেমন গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত বাড়িয়ে নিয়েছে তার রাজ্যপাট, অন্যদিকে তেমনই ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত থেকে মাইকেল কি হেম নবীন পর্যন্ত এসেই তার দম ফুরিয়ে যায়নি। রবীন্দ্রনাথ থেকে জীবনানন্দ, সবকিছুকেই সে অক্লেশে আত্মসাৎ করতে পেরেছে। আরও পারবে। শহরে বসে চণ্ডীমণ্ডপের জন্য যিনি যতই হা-হুতাশ করুন, বঙ্গসংস্কৃতির অগ্রগতি তাতে আটকে থাকবে না।
চৈত্র, ১৩৮১