গুপ্তকবি খাঁটি বাঙালি কবি ছিলেন হয়তো, কিন্তু খুব বড়ো দরের কবি ছিলেন কি না, সেটা সন্দেহের বিষয়। যা দিয়ে কবিতা লেখা হয়, সেই উপকরণের ঊর্ধ্বে যিনি উঠতে পারেন, তাকেই আমরা বড়ো কবি বলি। গুপ্তকবি সে-ক্ষেত্রে তার উপকরণের দ্বারাই শৃঙ্খলিত, তার ঊর্ধ্বে তিনি উঠতে পারেননি। কিন্তু সে-কথা এখন থাক। ‘খাঁটি বাঙালি কবি’ সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র যা বলেছিলেন, আপাতত সেটাই আমাদের বিচার্য। বঙ্কিম বলেছিলেন, “এখন আর খাঁটি বাঙালি কবি জন্মে না- জন্মিবার জো নাই- জন্মিয়া কাজ নাই।” কথাটার অর্থ কী? আসলে, বঙ্কিম খুব স্পষ্ট করেই উপলব্ধি করেছিলেন যে, সামাজিক যে-পরিবেশ আমাদের কবিতার ক্ষেত্রে তথাকথিত খাঁটি বাঙালিয়ানাকে উৎসাহিত করে, সেই পরিবেশটিাই আর নেই। তিনি লক্ষ করেছিলেন যে, এতাবৎকােল যা ছিল মূলত গ্ৰামমুখী, ফলত লোকসংস্কৃতির নানা লক্ষণের দ্বারা আপাদমস্তক চিহ্নিত, নগরজীবনের বিকাশের সঙ্গে-সঙ্গে সেই বঙ্গসংস্কৃতির ক্ষেত্র স্বতই আরও প্রসারিত হয়েছে, এবং গ্রামীণ চরিত্রের পাশাপাশি তার একটা নাগরিক চরিত্রও গড়ে উঠেছে। তার চেয়েও বড়ো কথা, আমাদের সাহিত্যপ্রয়াস ইতিমধ্যে শহরে এসে কেন্দ্রীভূত হয়েছে, এবং— সেই কারণে— তার মধ্যে আর গ্রামজি সংস্কৃতির মোটাদাগের লক্ষণগুলোকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। বলা বাহুল্য, এটাই যে স্বাভাবিক এবং এর জন্য হা-হুতাশ করা যে নিরর্থক, বঙ্কিম তা-ও খুব ভালোই বুঝেছিলেন। নইলে, “পৌষপার্বণে যে একটা সুখ আছে, বৃত্ৰসংহারে তাহা নাই” এ-কথা জেনেও তিনি বলবেন কেন যে, আমরা বৃত্ৰসংহারই চাই, তার বদলে “পৌষপার্বণ চাই না”?
এখানে একটা কথা বলে নেওয়া দরকার। সেটা এই যে, শহর। এদেশে আগেও ছিল। কিন্তু সেই শহর আর বঙ্কিমের সময়কার শহরের চরিত্র এক নয়। বঙ্কিমের শহর তো মধ্য-উনিশ শতকের কলকাতা। গ্রামজ সংস্কৃতির সঙ্গে তার চিত্তের সম্পর্ক নিশ্চয় আগের তুলনায়- ধরা যাক গ্রামজ সংস্কৃতির সঙ্গে শেষ মধ্যযুগীয় কৃষ্ণনগরের চিত্তের যে-সম্পর্ক, সেই তুলনায়— অনেক কমে এসেছিল। এখন আরও কমেছে। ফলত, যে ‘বৃত্ৰসংহার’কে বঙ্কিম- ‘পৌষপার্বণের তুলনায়— প্রগত মানসিকতার ফসল বলে মনে করেছিলেন, একালের কলকাতার শিক্ষিত সমাজ তাকেও বিশেষ প্ৰগত কিংবা প্রাসঙ্গিক ব্যাপার বলে গণ্য করে না। সাহিত্যমাত্ৰেই তো এক ধরনের উচ্চারণ। বৃত্ৰসংহারীও তা-ই। কিন্তু যে-ধরনের উচ্চারণ, একালের শিক্ষিত নাগরিক মানুষ তার সঙ্গে কোনও সাযুজ্য অনুভব করে। না, ফলে তার দ্বারা তার নান্দনিক ক্ষুধার তৃপ্তি ঘটে না। এই সহজ সত্যটাকে স্বীকার করে নিলেই ধরতে পারা যাবে যে, রবীন্দ্রনাথের সময় থেকে বাংলা কবিতা যে একটা ভিন্ন পথে মোড় নেয়, এবং সেইখানেই থেমে না গিয়ে ক্ৰমেই। আরও নূতনতর সম্ভাবনার মধ্যে খুঁজতে থাকে তার মুক্তি, এটা কোনও উটকো আকস্মিক ঘটনা নয়। আসলে আমাদের নাগরিক মানসিকতার ক্ৰমিক বিবর্তনের মধ্যেই কবিতার এই দিক-বদলের জমি ক্ৰমে তৈরি হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু অত্যন্ত সহজ সত্যকেও অনেক ক্ষেত্রে আমরা স্বীকার করি না। এবং আমরা খেয়াল করে দেখি না যে, এরই ফলে আমাদের আচরণে ও উক্তিতে কত পার্থক্য ঘটে যায়। আমরা একদিকে আমাদের অর্থনৈতিক প্রয়োজনের তাড়নায় বৃহৎ-সংসার থেকে সরে গিয়ে ছোটোমাপের সংসার রচনায় প্রবৃত্ত হই, এবং অন্যদিকে একান্নাবতী পরিবারের জন্য সমানে আশ্রমোচন করি। আমরা একদিকে বিজলিবাতির সুবিধেটুকু গ্ৰহণ করতে ছাড়ি না, এবং অন্যদিকে বলি যে, রেড়ির তেলের আলোয় চক্ষু খুবই মিগধ থাকে, সুতরাং আমাদের ‘বাপ-পিতেমো’রা যে রেড়ির তেলের পিদ্দিম জ্বেলে পড়াশোনা করতেন, সেটাই ছিল ভালো ব্যবস্থা। মেয়েদের যে স্বয়ং-নির্ভর হওয়া দরকার, মনে মনে এইটে বুঝে গিয়ে আমরা একদিকে আমাদের কন্যাদের ইশকুল-কলেজে পাঠাই, এবং অন্যদিকে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলি, “আর কি এরা আদর করে পিড়ি পেতে অন্ন দেবে? আহা, কী কথাই না গুপ্তকবি লিখে গিয়েছেন!” আসলে এসব মায়াকান্না ছাড়া আর কিছুই নয়। আমরা যদি সত্যিই বুঝতুমি যে, একান্নবর্তী পরিবারই ভাল, রেড়ির তেলের আলোই ভালো এবং স্ত্রীজাতিকে হেঁসেলের মধ্যে আটকে রাখাই ভাল, তা হলে নিশ্চয় একান্নবর্তী পরিবার থেকে আমরা বেরিয়ে আসতুম না, বিজলিবাতিকে আমাদের বাড়ির মধ্যে ঢুকতে দিতুম না এবং বাড়ির মেয়েদের ইশকুল-কলেজে পাঠাতুম না। কিন্তু তাতে আমরা রাজি নই। আমরা একই সঙ্গে বর্তমানের আঁচল ধরে চলব, এবং অতীতের জন্যে মায়াকান্না কঁদব। ভেবেও দেখব না যে, এটা কত বড়ো ভণ্ডামি।
এই ভণ্ডামি আসলে আমাদের সংস্কৃতির সর্বক্ষেত্রেই চলেছে। প্রশ্নটা অবশ্য সর্বদা ঠিক ভালো-মন্দেরও নয়। এমনকি প্রয়োজন-অপ্রয়োজনেরও নয়। বরং বলা যায়, সাযুজ্যবোধের। আমাদের শহুরে শিক্ষিত মানুষদের অনেকেই যে ময়দানে গিয়ে সংস্কৃতি-সম্মেলনের ছাউনির তলায় বসে, দেহতত্ত্বের গান শুনে কিংবা কবির লড়াই দেখে মুগ্ধ হন, তাতে বিস্ময়ের কিছুই নেই। কেন-না, এ তো আমরা জানিই যে, যা একেবারে আহেলা বিদেশি বস্তু, তা-ও অনেকক্ষেত্ৰে- আর কিছু নয়, শুধু আউটল্যানডিশ বলেই— আমাদের চিত্তে কিছুটা মোহের সঞার করে। দেহতত্ত্ব কিংবা কবির লড়াই তো সে-ক্ষেত্রে আমাদের ঘরেরই জিনিস, সুতরাং তার সান্নিধ্যে এসে কেউ মুগ্ধ হলে আমরা বিস্মিত হব কেন। কিন্তু শহুরে শিক্ষিত মানুষরা যখন নিতান্ত মুগ্ধ হয়েই ক্ষান্ত হন না, উপরন্তু বলেন যে, ওরই মধ্যে তাঁদের চিত্তের মুক্তি, তখন একটু ধাঁধা লাগে বইকি। তার কারণ, যে-পরিবেশে তারা লালিত হয়েছেন ও যে-ধরনের শিক্ষা তারা পেয়েছেন, তাতে তাদের চিত্তবৃত্তি আরও সূক্ষ্ম ও জটিল হবার কথা, এবং— সেই কারণেই- লোকসংস্কৃতির ওই দুই নিদর্শনের সঙ্গে র্তাদের বিশেষ সাযুজ্যবোধ করবার কথা নয়। বস্তৃত তাদের অনেক বেশি আত্মীয়তা বোধ করবার কথা আরও সূক্ষ্ম এবং আরও জটিল গান কিংবা কবিতার সান্নিধ্যে এসে।