- বইয়ের নামঃ কবিতার দিকে ও অন্যান্য রচনা
- লেখকের নামঃ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
- বিভাগসমূহঃ কাব্যগ্রন্থ
০১. কবিতা ও সংস্কৃতি
আমরা যদি আঙুল তুলে দেখিয়ে দিতে পারতুম যে, কোন সংস্কৃতির কোথায় শুরু আর কোথায় শেষ, তাহলে ধরতে পারা যেত, কোন কবিতা কোন সংস্কৃতির এলাকার মধ্যে পড়ে কিংবা পড়ে না। কিন্তু তেমনভাবে আমরা আঙুল তুলতে পারছি কোথায়? যত সহজে একটা রাষ্ট্র, রাজ্য, জেলা, মহকুমা কিংবা পৌর এলাকার সীমানা আমরা নির্দেশ করতে পারি, সংস্কৃতির সীমানা তত সহজে নির্দেশ করবার জো নেই। দিনের আলো যেরকম নিজের শেষ সীমানার স্পষ্ট কোনও নির্দেশ না-রেখে রাত্রির অন্ধকারে হারিয়ে যায়, একটা সংস্কৃতিও ঠিক তেমনভাবেই অন্য সংস্কৃতির মধ্যে গিয়ে মেশে। বস্তৃত, না-আলো না-আঁধার গোধূলির এলাকা এক্ষেত্রে আরও বড়ো বলেই ধাঁধাটা আরও জটিল হয়ে দাঁড়ায়, এবং একটা সংস্কৃতির শেষ সীমানার পিলপেগুলোকে খুঁজতে খুঁজতে, হঠাৎ একসময়ে আমরা বুঝতে পারি যে, ইতিমধ্যে আমরা আর-একটা সংস্কৃতির ভিতর-মহলে এসে ঢুকে পড়েছি।
তিরিশের এক ইংরেজ কবিও ঠিক এই রকমের একটা ধাঁধার কথা তুলেছিলেন। তবে তাঁর সমস্যার ক্ষেত্রটা ছিল আরও ছােটো। সংস্কৃতির সঙ্গে কবিতার যোগসম্পর্ক নয়, তিনি খুঁজছিলেন এক ধরনের কবিতার সঙ্গে আর-এক ধরনের কবিতার যোগসূত্র। তাঁর প্রশ্ন ছিল, ইংরেজি কবিতাকে একটা উদ্যান হিসেবে কল্পনা করে নিয়ে সেই উদ্যানকে কি আমরা ছোটোবড়ো কতকগুলো টুকরোয় ভাগ করে ফেলতে পারি, এবং সেই টুকরোগুলোর চারধারে বেড়া বেঁধে বলতে পারি যে, দ্যাখো, এইটে হচ্ছে ওয়ার্ডসওয়ার্থের বাগান, আর ওইটে হচ্ছে শেলির? সেই কবি, ডে-লুইস, নিজেই অতঃপর জানাচ্ছেন যে, না, তা আমরা পারি না।
বলা বাহুল্য, কবিতার ক্ষেত্রে যে-বেড়া বাঁধা যায় না, সংস্কৃতির বৃহত্তর ক্ষেত্রে তাকে বাঁধতে যাওয়া আরও হাস্যকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। কেন-না, এক সংস্কৃতি যেখানে অন্য সংস্কৃতির সঙ্গে মিলেমিশে যায়, সেই টোয়াইলাইট জোন সে-ক্ষেত্রে আরও বড়ো। কথাটা সত্য আমাদের বঙ্গীয় সংস্কৃতি সম্পর্কেও। সীমানা-নিৰ্দেশক কোনও পিলপে কিংবা চেকপোস্ট সেখানে আমাদের চোখে পড়ে না। কিংবা সাইনবোর্ড লটকে কেউ সেখানে আমাদের বলে দেয় না যে, এই তুমি বঙ্গসংস্কৃতির এলাকা ছাড়িয়ে অন্য সংস্কৃতির মধ্যে ঢুকছে। তাহলে তার চৌহদ্দি আমরা কীভাবে বুঝে নেব, এবং কীভাবেই-বা নিশ্চিত হয়ে বলব যে, আধুনিক ংলা কবিতা বলতে যা আমরা বুঝি, তা এই বঙ্গসংস্কৃতির চৌহদ্দির মধ্যে পড়ে না?
তবে, বঙ্গসংস্কৃতির চতুঃসীমার স্পষ্ট কোনও নির্দেশ না-পেলেও, আধুনিক বাংলা কবিতার সঙ্গে তার যোগ-সম্পর্ক নিয়ে যে কেন প্রশ্ন ওঠে, সেটা আমরা ঠিকই বুঝতে পারি। প্রশ্ন ওঠবার কারণ আর কিছুই নয়, আমাদের এই বঙ্গভূমির সংস্কৃতি সম্পর্কে যে একটা মোটাদাগের ধারণা অনেকে লালন করে থাকেন, আধুনিক বাংলা কবিতার প্রকৃতিকে তাঁরা চট করে তার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারেন। না। ফলে তাঁরা অস্বস্তি বোধ করেন, তাদের মনের মধ্যে এই নতুন ধাঁচের কবিতা সম্পর্কে নানা সংশয়ের ছায়া পড়তে থাকে, এবং একসময়ে তারা বলেও বসেন যে, আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে এর কোনও যোগ-সম্পর্ক নেই, এটা নেহাতই বাইরেথেকে-আমদানি-করা কিংবা উপর-থেকে-চাপিয়ে-দেওয়া উটকো একটা ব্যাপার।
স্বীকার করা ভালো যে, মোটা-দাগের এই ধারণা আসলে মোটা-দাগের কিছু অনুষ্ঠানকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠে। অর্থাৎ এমন কিছু অনুষ্ঠানের কাছে সে প্রশ্রয় পায়, যার সাংস্কৃতিক কুলপরিচয় নিয়ে তর্কের কোনও অবকাশ নেই, এবং খুব সহজেই যাকে আমরা আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনের অঙ্গীভূত ব্যাপার বলে শনাক্ত করতে পারি। যথা মাঘমণ্ডল কিংবা পৌষপার্বণ। এ যে আমাদের বঙ্গসংস্কৃতির একেবারে খাসমহলের ব্যাপার, তা নিয়ে কোনও তর্কই কখনও উঠবে না। বলা বাহুল্য, এই রকমের আরও অসংখ্য অনুষ্ঠান আমাদের রয়েছে। কিন্তু শুধু এইসব অনুষ্ঠানকেই যদি আমরা আমাদের সংস্কৃতির একমাত্র অভিজ্ঞান বলে গণ্য করি, এবং শুধু এরই উপরে নির্ভর করে পেতে চাই আমাদের সংস্কৃতির সার্বিক পরিচয়, তা হলে আমাদের অবস্থা হবে সেইসব অন্ধের মতো, যাদের কেউ-বা শূড়, কেউ বা লেজ আর কেউ-বা পায়ের উপরে হাত বুলিয়ে হাতির চেহারা আন্দাজ করতে চেয়েছিল। হাতি নামক প্রাণীটির তারা খণ্ড-পরিচয় পেয়েছিল, পূর্ণ-পরিচয় পায়নি। একটু আগে যেসব অনুষ্ঠানের উল্লেখ করেছি, তার মধ্যেও বস্তৃত আমাদের সংস্কৃতির একটা খণ্ড-পরিচয় ধরা রয়েছে। এগুলি আমাদের সংস্কৃতির। সেই অংশের মধ্যে পড়ে, মূলত যা গ্রােমজ সংস্কৃতি কিংবা লোকসংস্কৃতি। এদের যোগ অনেকটাই আঞলিক ধর্মবিধি, সংস্কার কিংবা লোকচারের সঙ্গে। এবং শুধু এরই উপরে নির্ভর করে যদি আমরা বঙ্গসংস্কৃতির পরিচয় পাবার চেষ্টা করি, তাহলে তার পূর্ণ পরিচয় আমরা জানতে পারব না।
কার্যত আমরা অনেকে কিন্তু তা-ই করে থাকি। সংস্কৃতির বিচার করতে বসে অতিমাত্রায় নির্ভর করি এইসব আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া কিংবা লক্ষণের উপরে। এবং মধ্যযুগের বাংলা কাব্যে যেহেতু লোকসংস্কৃতির এলাকাভুক্ত নানা পদ্ধতি-প্রক্রিয়ার লক্ষণ খুবই ভুরিপরিমাণে ছড়িয়ে আছে, তাই সেই কাব্যকে বিশুদ্ধ বঙ্গীয় সংস্কৃতির ফসল বলে গণ্য করতে আমাদের কোনও অসুবিধে হয় না। মধ্যযুগ অবসিত হবার পরেও আমাদের কবিতায় এসব লক্ষণ অনেক পরিমাণে থেকে গিয়েছিল। সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ছিল ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতায়। খুবসম্ভব সেই কারণেই গুপ্তকবিকে আমরা খাটি বাঙালি কবি বলতে অভ্যস্ত হয়েছি।