অথচ জাহানারা কোনদিন ট্রেন ফেল করে না। ফরহাদ
আধ ঘণ্টা আগেই স্টেশনে পৌঁছে যায়। লাইলী
মালপত্র তুলে দিয়ে আগেই চাকরকে টিকিট কিনতে পাঠায়। নাহার
কোথাও যাওয়ার কথা থাকলে আনন্দে ভাত পর্যন্ত খেতে পারে না।
আর আমি এঁদের ভাই
সাত মাইল হেঁটে শেষ রাতের গাড়ি হারিয়ে
এক অখ্যাত স্টেশনে কুয়াশায় কাঁপছি।
কুয়াশার শাদা পর্দা দোলাতে দোলাতে আবার আমি ঘরে ফিরবো।
শিশিরে আমার পাজামা ভিজে যাবে। চোখের পাতায়
শীতের বিন্দু জমতে জমতে নির্লজ্জের মতোন হঠাৎ
লাল সূর্য উঠে আসবে। পরাজিতের মতো আমার মুখের উপর রোদ
নামলে, সামনে দেখবো পরিচিত নদী। ছড়ানো ছিটানো
ঘরবাড়ি, গ্রাম। জলার দিকে বকের ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে। তারপর
দারুণ ভয়ের মতো ভেসে উঠবে আমাদের আটচালা।
কলার ছোট বাগান।
দীর্ঘ পাতাগুলো না না করে কাঁপছে। বৈঠকখানা থেকে আব্বা
একবার আমাকে দেখে নিয়ে মুখ নিচু করে পড়তে থাকবেন,
ফাবি আইয়ে আলা ই-রাব্বিকুমা তুকাজ্বিবান …।
বাসি বাসন হাতে আম্মা আমাকে দেখে হেসে ফেলবেন।
ভালোই হলো তোর ফিরে আসা। তুই না থাকলে
ঘরবাড়ি একেবারে কেমন শূন্য হয়ে যায়। হাত মুখ
ধুয়ে আয়। নাস্তা পাঠাই।
আর আমি মাকে জড়িয়ে ধরে আমার প্রত্যাবর্তনের লজ্জাকে
ঘষে ঘষে
তুলে ফেলবো।
বাতাসের ফেনা
কিছুই থাকে না দেখো, পত্র পুষ্প গ্রামের বৃদ্ধরা
নদীর নাচের ভঙ্গি, পিতলের ঘড়া আর হুকোর আগুন
উঠতি মেয়ের ঝাঁক একে একে কমে আসে ইলিশের মৌসুমের মতো
হাওয়ায় হলুদ পাতা বৃষ্টিহীন মাটিতে প্রান্তরে
শব্দ করে ঝরে যায়। ভিনদেশী হাঁসেরাও যায়
তাদের শরীর যেন অর্বুদ বুদ্বুদ
আকাশের নীল কটোরায়।
কিছুই থাকেনা কেন? করোগেট, ছন কিংবা মাটির দেয়াল
গায়ের অক্ষয় বট উপড়ে যায় চাটগাঁর দারুণ তুফানে
চিড় খায় পলেস্তরা, বিশ্বাসের মতন বিশাল
হুড়মুড় শব্দে অবশেষে
ধসে পড়ে আমাদের পাড়ার মসজিদ!
চড়ুইয়ের বাসা, প্রেম, লতাপাতা, বইয়ের মলাট।
দুমড়ে মুচড়ে খসে পড়ে। মেঘনার জলের কামড়ে
কাঁপতে থাকে ফসলের আদিগন্ত সবুজ চিৎকার
ভাসে ঘর, ঘড়া-কলসী, গরুর গোয়াল
বুবুর স্নেহের মতো ডুবে যায় ফুল তোলা পুরোনো বালিশ।
বাসস্থান অতঃপর অবশিষ্ট কিছুই থাকে না
জলপ্রিয় পাখিগুলো উড়ে উড়ে ঠোঁট থেকে মুছে ফেলে বাতাসের ফেনা।
বোধের উৎস কই, কোন দিকে?
আচ্ছন্ন চিন্তার মধ্যে স্তব্ধতায় অকস্মাৎ শুনি
সেলাই কলের চলা। পড়শী ঘরণী
বানায় শিশুর জামা।
হঠাৎ গুলির শব্দ। চিৎকার, ধর ধর ধর
কিন্তু আমি কাকে ধরবো? স্টেনগান কাঁধে নিয়ে হেঁটে যায়
উনিশশো তেয়াত্তর সাল।
বাগান মাড়িয়ে দিয়ে জীপ যায়,
আবার গুলির শব্দ
মা…মা…মা জানালা বন্ধ করো
টেলিফোন টেলিফোন…
আবার গুলির শব্দ। বাঁচাও বাঁচাও…
বানাও শালাকে ছিঁড়ে ফেলো–
…ট্যাট্…ট্যাট্…ট্যাট
খোল্ শালী চোরের চোদানী শাড়ি খোল্
…ট্যাট্…ট্যাট্…ট্যাট
ছেলে তুই, ছেলে তুই আমার ধর্ম বাপ তুই…
…ট্যাট্…ট্যাট্…ট্যাট
সেলাই কলের চলা থেমে আছে। সব দরজা বন্ধ করে
জেগে আছি বাতাসের বিরুদ্ধে নীরব। একেমন শিহরণ
গ্রীষ্মকে শীত আর শীতকেও গ্রীষ্ম করে দেয়?
আমার কি জাড় আছে? শরীর কি ভিজে গেলো ঘামে?
বোধের উৎস কই, কোনদিকে?
আমাকে রাখতে দাও হাত।
একবার স্পর্শ করি শিশ্নে, সহ্যগুণে, প্রেমে
রক্তের ভিতর দিয়ে একবার দেখা যায় যদি
বিশাল মিনার সেই, যাকে লোকে পুরুষার্থ বলে।
ভাগ্যরেখা
সামনে দেখি গর্ত এক রয়েছে বড়ো হা করে
আমার দিকে, দেখি, নিগূঢ় আঘাতে;
জীবন যেন জালের মাছি টানছে কালো মাকড়ে
কোনো কিছুই পারে না তারে জাগাতে।
তাহলে আমি জেনেছি এই, আমার প্রাণ ঝলকের
যা কিছু ছোঁয়া দেখেছি সবি ঝালিয়ে;
বয়স করে তাড়া ভীষণ জীবন নাকি পলকের
শহর থেকে শহরে আসি পালিয়ে।
প্রেমের কাছে থেমেছিলো, গরীব সেই অসতী—
আপন মনে দিচ্ছে টান বিড়িতে,
সেও তো এক বিরাণ নারী, গুড়িতে যাওয়া বসতি,
ছিলাম যার দরগাহের সিঁড়িতে।
লোভের লতা বাড়েনি মনে, ভূমিতে সেই চাষও না
যা দিয়ে যায় ভাগ্যরেখা নাড়ানো;
যেখান থেকে এসেছিলাম অতীত সেই বাসনা
পাবো কি তারে শেমিজ খুলে দাঁড়ানো?
যার স্মরণে
স্মরণে যার বুকে আমার জলবিছুটি
আমার ঘরে রাখলো না সে চরণ দু’টি।
ধানের সবুজ করলো কি যে আড়াল দিয়ে
যাসনে মেয়ে, মন্ত্র দিলো বনের টিয়ে।
নাওয়ের বাদাম ডাকলো তারে; চরের মাটি
আদর করে বিছিয়ে দিলো শীতলপাটি;
ভয় ধরিয়ে ডাকলো হুতোম ছাতিম গাছে
বন্য বাতাস কাঁপলো এসে বুকের কাছে।
পাতার ফাঁকে রাত্রি যখন নামলো সেজে
সেই যুবতীর বাংড়ি হাতে উঠলো বেজে।
হঠাৎ নদী ধরলো এসে সাপের ফণা
হাওয়ার আঘাত করলো তারে অন্যমনা!
খোঁপার বাঁধন ভাঙলো যখন যত্নে গড়া
ব্যর্থ হলো আমার সকল মন্ত্ৰপড়া।
শোণিতে সৌরভ
তোমার মুখ আঁকা একটি দস্তায়
লুটিয়ে দিতে পারি পিতার তরবারি
বাগান জোত জমি সহজে, সস্তায়
তোমার মুখ আঁকা একটি দস্তায়
পরীর টাকা পেলে কেউ কি পস্তায়?
কে নেবে তুলে নাও যা কিছু দরকারী,
তোমার মুখ আঁকা একটি দস্তায়
বিলিয়ে দিতে পারি পিতার তরবারি।
তোমার মাংসের উষ্ণ আতাফল
শোণিতে মেশালো কি মধুর সৌরভ?
প্রতিটি দিন যায় আহত, নিষ্ফল
তোমার মাংসের উষ্ণ আতাফল,–
ঈভের মতো আজ হওনা চঞ্চল
আমার ডানহাতে রাখো সে গৌরব;
তোমার মাংসের উষ্ণ আতাফল
শোণিতে মেশালো কি মধুর সৌরভ।