বুকের অতলে লাফায় নীরবে আহত রক্ত।
ধানের স্বপ্ন দু’চোখে আমার, এই নগণ্য—
দাবি তুলতেই কারা বলে ওঠে বন্য, বন্য।
ধান তোলবার অস্ত্র নিলাম বিপুল শব্দে।
হঠাৎ তখুনি মনীষীরা বলে এ-ও জঘন্য।
তবু তো সূর্য উঠে আসে দেখি নতুন অব্দে।
স্বপ্নে আমায় ডেকে ওঠে এক সুখের পক্ষী
ঘুম ভেঙে আজ চলেছি তাহার কুজন লক্ষ্যি
কতদুর গেলে পাওয়া যাবে সেই নীল বিহঙ্গ
আমি হতে চাই দিনমান তার শরীর রক্ষী।
তারে নিরালায় পেতে দিতে চাই আমার অঙ্গ।
নদী তুমি
কে অস্বীকারের পাখি ডানা ঝাড়ো আমার ভিতরে
বেয়াদব শিসে তোর ছলকে ওঠে রক্ত চলাচল?
নিসর্গের মানচিত্র ছেঁদা করে একদা যে নদী
আনতো গভীর জল কর্মপরায়ণ ঘরে ঘরে
সেও আজ নদী নয়, কালসাপ, ধূর্ত বণিকের
গোপন দালাল যেন। পাটের চালান ভরা নাও
ভাসাও উদ্দাম গতি, হাসির গমকে নেড়ে পাল
পাটাতনে ভেঙে পড়ো বিশ্বাসঘাতক নীল জল।
একদিন আমাদের হবে। অজগর এই নদী
হবে জাগর ভাস্বর ঘোলা, হবে চঞ্চল তরল
পেশীতে মচকাবে দাঁড়, পালে আর দড়িতে বিদ্যুৎ।
আজ আমাদের নও, শশাষণে ধর্ষণে কালোরেখা।
যেন চোরের সাহায্যকারী তুমি, কবির সন্দেহ;
বোনের শাড়ির মতো মায়ের দেহের মতো নও!
পলাতক
পলাতক বলে লোকে, বুকে বড় বাজে। আমি তো এখনো
জীবনের জলাধারে হতে চাই তুমুল রোহিত।
কোথায় পালাবো আমি, যেখানে রাতেও
নারীর নিঃশ্বাস এসে চোখে মুখে লাগে। বুকে লেগে থাকে ক্লান্ত
শিশুর শরীর, বলো,
পালাবো কোথায়?
জীবনের পক্ষে তাই সারাদিন দরজা ধরে থাকি।
সকালে খোয়াড় থেকে মুরগীর বাচ্চাগুলো রোজ
সুন্দর শব্দ করে পাকালের প্রান্তে চলে গেলে
আমি তাড়াতাড়ি উঠে
হাত দিয়ে ঢেকে রাখি আগুনের মুখ।
সোনালি শখের লোভে জলদাসদের সেই একরত্তি মেয়ে
অকস্মাৎ সমুদ্রের ঢেউয়ে আটকে গেলে
আমি কি নির্ভয়ে
বঙ্গোপসাগরের জলে নামিনি একাকী?
আরশোলার অত্যাচারে তিক্ত হতে হতে
আমার রূপসী যবে পতঙ্গের গুষ্ঠিশুদ্ধ থেতলে দিয়ে যায়
শাড়ির প্রশংসা করে আমি কি তখন তারে প্রসন্ন করি না।
পালক ভাঙার প্রতিবাদে
আমি যেন সেই পাখি, স্বজন পীড়নে যারা
কালো পতাকার মতো হাহাকার করে ওঠে, ক-কা
আর্তনাদে ভরে দেয় ঘরবাড়ি, পালক ভাঙার
উপায়বিহীন প্রতিবাদে
আকাশ কাঁপিয়ে কাঁদে।
ছত্রখান হয়ে উড়ে উড়ে
ঘুরে ঘুরে পাখসাটে।
পিষ্ট প্রায় সগীর দশায়।
এমন রোদন ধ্বনি কেন আজ বেজে ওঠে?
এইতো সেদিনও
বোস্তামীর পুকুরের ঘোলা-ময়লা জলের কাছিম
হওয়ার সাধনা ছিলো, টকটকে লাল
মাংসের মণ্ডের মতো লোভ এসে ছিটকে পড়তো
থকথকে সিঁড়িতে সারাদিন।
আজ যেনো ভেঙে গেলো দারুণ খোলস, খুলে গেলো যেন
আমার কঠিন প্রাণ। রহস্যের ময়লা কালো জলে
অজস্র সফেদ ফিটকিরি ইতস্তত ছুঁয়ে দিয়ে কেউ
সহসা ধরিয়ে দিলো কম্পমান পানির পাতালে
ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেঙে যাওয়া নির্বোধের মুখচ্ছবিখানি।
এ মুখ আমার নয়, এ মুখ আমার নয়, বলে—
যতবার কেঁপে উঠি, দেখি,
আমার স্বজন হয়ে আমার স্বদেশ এসে
দাঁড়িয়েছে পাশে। নির্ভয়ে, আশ্বাসে
জিয়ল মাছের ভরা বিশাল ভাণ্ডের মতো নড়ে ওঠে বুক।
ব্যাকুল মুখের সারি ক্ষমার সুরভি নিয়ে আজ
হঠাৎ ফোটালো এক রক্তবর্ণ শতমুখী ফুল।
কাতারে কে ডাকে নাম ধরে? আদেশের গম্ভীর নিনাদে
আমার নামের ধ্বনি আমারই শরীর ঘিরে ঘিরে
ঝিঁঝির শব্দের মতো ঢুকে গেলো গ্রামের ভিতর।
মনে হলো, ডাক দিলে জড়ো হয়ে যাবে সব নদীর মানুষ
অসংখ্য নাওয়ের বাদাম মুহূর্তে গুটিয়ে ফেলে রেখে
জমা হয়ে যাবে এই চরের ওপর।
খেতের আড়াল থেকে কালো
মানুষের ধারা এসে বলে সরোষে আমাকে
কী ভাবে এগোবে তারা দুর্ভেদ্য নগরের তোরণে প্রথম।
প্রকৃতি
কতদূর এগোলো মানুষ!
কিন্তু আমি ঘোরলাগা বর্ষণের মাঝে
আজও উবু হয়ে আছি। ক্ষীরের মতোন গাঢ় মাটির নরমে
কোমল ধানের চারা রুয়ে দিতে গিয়ে
ভাবলাম, এ-মৃত্তিমা প্রিয়তমা কিষাণী আমার।
বিলের জমির মতো জলসিক্ত সুখদ লজ্জায়
যে নারী উদাম করে তার সর্ব উর্বর আধার।
বর্ষণে ভিজছে মাঠ। যেন কার ভেজা হাতখানি
রয়েছে আমার পিঠে। আর আমি
ইন্দ্রিয়ের সর্বানুভূতির চিহ্ন ক্ষয় করে ফেলে
দয়াপরবশ হয়ে রেখেছি আমায় কালো দৃষ্টিকে সজাগ।
চতুর্দিকে খনার মন্ত্রের মতো টিপ টিপ শব্দে সারাদিন
জলধারা ঝরে। জমির কিনার ঘেঁষে পলাতক মাছের পেছনে
জলডোরা সাপের চলন নিঃশব্দে দেখছি চেয়ে।
বাহুতে আমার
আতঙ্কে লাফিয়ে উঠছে সবুজ ফড়িং।
বুঝিবা স্বপ্নের ঘোরে আইল বাঁধা জমিনের ছক
বৃষ্টির কুয়াশা লেগে অবিশ্বাস্য যাদুমন্ত্রবলে
অকস্মাৎ পাল্টে গেলো। ত্রিকোণ আকারে যেন
ফাঁক হয়ে রয়েছে মৃন্ময়ী।
আর সে জ্যামিতি থেকে
ক্রমাগত উঠে এসে মাছ পাখি পশু আর মানুষের ঝাঁক
আমার চেতনা জুড়ে খুঁটে খায় পরস্পর বিরোধী আহার।
প্রত্যাবর্তনের লজ্জা
শেষ ট্রেন ধরবো বলে এক রকম ছুটতে ছুটতে স্টেশনে পৌঁছে দেখি
নীলবর্ণ আলোর সংকেত। হতাশার মতোন হঠাৎ
দারুণ হুইসেল দিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে।
যাদের সাথে শহরে যাবার কথা ছিল তাদের উৎকণ্ঠিত মুখ
জানালায় উবুড় হয়ে আমাকে দেখছে। হাত নেড়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে।
আসার সময় আব্বা তাড়া দিয়েছিলেন, গোছাতে গোছাতেই
তোর সময় বয়ে যাবে, তুই আবার গাড়ি পাবি।
আম্মা বলছিলেন, আজ রাত না হয় বই নিয়েই বসে থাক
কত রাত তো অমনি থাকিস।
আমার ঘুম পেলো। এক নিঃস্বপ্ন নিদ্রায় আমি
নিহত হয়ে থাকলাম।