আমি যখন ছোটো, আমাদের গ্রাম ছিল
এক উদ্দাম নদীর আক্রোশের কাছে। ক্রমাগত ভাঙনের রেখা
ধীরগতিতে গ্রামকে উজাড় করে এগোতে থাকলে
আমি প্রাত্যহিক ভাঙনের খবর আমার মাকে এনে দিতাম।
দৌড়ে এসে বলতাম, আজ ইদ্রিসদের
গোয়াল ঘরটা গেল মা।
আমার বাপের ছিল অঘুমের অসুখ। সারারাত
ধস নামার শব্দ পোহাতেন। কখনো দেখতাম
সড়কি নিয়ে নদীর দিকে যাচ্ছেন।
আমি তার পেছন নিলে বলতেন, আয়
কোথায় চর জাগলো দেখে আসি।
দশ মাইলের মধ্যে চরের খবর মাঝিরা কেউ জানতো না।
গলুইয়ের ওপর থেকে হাত নেড়ে নেড়ে
তারা দুর গঞ্জের দিকে চলে গেলে
আমরা ঘরে ফিরতাম!
ভাঙন যখন চল্লিশ গজের মধ্যে এগোলো। আমার বাপ
তখন অসুস্থ। কি তার অসুখ ছিল জানি না,
কেবল আমাকে নদীর কাছে যেতে বলতেন। বলতেন
জেনে আয় কোন্ দিকে চর পড়েছে।
আমি তার কথায় দৌড় দিতাম। কিন্তু ফিরে এসে বলতাম
আজ কৈবর্তপাড়ার নলিনীদের ভিটেবাড়ি ভাঙলো বাবা।
মা চোখ টিপতেন। কিন্তু আমি তো ছিলাম শিশু
যে মিথ্যা বলতে শেখেনি। একদিন এ-ভাবেই
সব শেষ হয়ে গেল।
যেদিন নদী এসে আমাদের বাড়িটাকে ধরলো
সেদিনের কথা আমার চোখের ওপর স্থির হয়ে আছে।
বাক্সপেটরা থালা ঘটিবাটি নিয়ে আমরা
গাঁয়ের পেছনে বাপের কবরে গিয়ে দাঁড়ালাম।
জায়গাটা ছিল উঁচু আর নিরাপদ। দেখতে
অনেকটা চরের মতোই। মা সেখানে বসে
হাঁপাতে লাগলেন। কাদলেন এমনভাবে যে
অভিযোগহীন এমন রোদন ধ্বনি বহুকাল শুনিনি আমি।
তারপর ভাঙনের রেখা পেছনে রেখে
আমরা গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছিড়ে পড়লাম।
কেউ গেলাম মামুর বাড়িতে। কেউ ফুপুর। যেমন
বাবেল থেকে মানুষের ধারা
ছড়িয়ে পড়লো পৃথিবীতে।
জাতিস্মর
আমি যতবার আসি, মনে হয় একই মাতৃগর্ভ থেকে পুনঃ
রক্তে আবর্তিত হয়ে ফিরে আসি পুরনো মাটিতে।
ওঁয়া ওঁয়া শব্দে দুঃখময় আত্মার বিলাপ
জড়সড় করে দেয় কোন দীন দরিদ্র পিতাকে।
আর ক্লান্ত নির্ভার আরামে
মায়ের সজল চোখ মুদে আসে।
কখন, কিভাবে যেন বেড়ে উঠি
পূর্বজন্মের সেই নম্রস্রোতা নদীর কিনারে।
কে কোথায় জাতিস্মর?
সমস্ত প্রাণীর মধ্যে আমি কি কেবলই
স্মরণে রেখেছি স্পষ্ট কোন গাঁয়ে জন্মেছি কখন?
অথচ মানুষ
নিজের পাপের ভারে
শুনেছি জন্মায় নাকি পশুর উদরে—
বলে ত্রিপিটক।
কী প্রপঞ্চে ফিরে আসি, কী পাতকে
বারম্বার আমি
ভাষায়, মায়ের পেটে
পরিচিত, পরাজিত দেশে?
বাক্যের বিকার থেকে তুলে নিয়ে ভাষার সৌরভ
যদি দোষী হয়ে থাকি, সেই অপরাধে
আমার উৎপন্ন হউক পুনর্বার তীর্যক যোনিতে।
অন্তত তাহলে আমি জাতকের হরিণের মতো
ধর্মগণ্ডিকায় গ্রীবা রেখে
নির্ভাবন দেখে যাবো
রক্তের ফিনকিতে লাল হয়ে
ধুয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ নির্ভয়ে, নির্বাণে।
তরঙ্গিত প্রলোভন
পীরের মাজারে বসে কোনো রাতে বাউলের দল
যেমন হঠাৎ ধরে হু হু শব্দে প্রেমের জিকির
আমার কবিতা সেই মত্তদের রাতের গজল
তোমার শ্রবণে দিক কলজে ছেঁড়া কথার তিমির।
অস্তিক সম্মান যদি পায় কোনো শূন্যের পূজারী
সাকার রূপের ভক্ত কেন তবে ঘৃণার্হ বলো না?
আমার সম্মুখে তুমি বিদ্যাধরী দ্রাবড়ি কুমারী
মুক্ত করে দাও গাঢ় মহাকৃষ্ণ কান্তির ছলনা।
নদীর গভীর থেকে কতদিন বাতি জ্বেলে ধরে
গণ্ডের দালাল ভেবে ডেকেছিল ভরার কুটিলা
তরঙ্গিত প্রলোভন ক্রমাগত বুকে এসে পড়ে
টান করে ধরে আছি দীপ্ত ধনুকের ছিলা।
কে বিদ্রোহী আলো জ্বালো এতদূর দীর্ণ জনপদে?
আমাকে দেখাও মুখ অন্ধকার রাত্রির বিপদে।
তোমার আড়ালে
কোথাও রয়েছে ক্ষমা, ক্ষমার অধিক সেই মুখ
জমা হয়ে আছে ঠিক অন্তরাল আত্মার ওপর।
আমার নখের রক্ত ধুয়ে গেলে
যেসব নদীর জল লাল
হয়ে যাবে বলে ভয়ে দিশেহারা
আজ সে পানির ধারা পাক খেয়ে নামে
আমার চোখের কোণে
আমার বুকের পাশ ঘেঁষে।
তোমার আড়ালে দেখি ঢেকে যায় আমার নিবাস
শরীর, স্বাস্থ্যের দীপ্তি, পৌরুষের চিহ্ন কতিপয়
ঢেকে যায় গাছপালা পতঙ্গ উদ্ভিদ
এমন কি নারীর মুখ, কান্তিময়
মাংসের কপাট।
ঢেকে যায় কাব্যহিংসা, পক্ষপাত
শিল্পের আসন।
তোমার আড়ালে পড়ে থাকে
মৃত্যুভয়,
কালজ্ঞ কবির বৈভব।
তোমার হাতে
তোমার হাতে ইচ্ছে করে খাওয়ার
কুরুলিয়ার পুরনো কই ভাজা;
কাউয়ার মতো মুন্সী বাড়ির দাওয়ায়
দেখবো বসে তোমার ঘষা মাজা।
বলবে নাকি, এসেছে কোন গাঁওয়ার?
ভাঙলে পিঠে কালো চুলের ঢেউ
আমার মতো বোঝেনি আর কেউ,
তবু যে হাত নাড়িয়ে দিয়ে হাওয়ায়
শহরে পথ দেখিয়ে দিলে যাওয়ার।
দায়ভাগ
ভোলো না কেন ভুলতে পারো যদি
চাঁদের সাথে হাঁটার রাতগুলি
নিয়াজ মাঠে শিশির-লাগা ঘাস
পকেটে কার ঠাণ্ডা অঙ্গুলি
ঢুকিয়ে হেসে বলতে, অভ্যাস;
বকুলডালে হাসতো বুলবুলি।
মোছো না কেন মুছতে পারো যদি
দেয়ালে কালো অঙ্গারের দাগ,
রঙ্গভরে ফোটাতে মুখ যার
ভাবনা ছিলো করবো কিনা রাগ
কণ্ঠা বেয়ে কাঁপতো সরু হার;
খেলার বুঝি থাকে না দায়ভাগ?
তোমার ছাদে ওঠে তো গোল চাঁদ
সাহস থাকে ঢাকো না জ্যোস্নাকে
হাঁসের খেলা ভাসায় ভরা নদী
কাটো না জল যদি বা দোষ থাকে;
রক্তলোভী আলোছায়ার ফাঁদ—
ভাঙো না কেন ভাঙতে পারো যদি।
নতুন অব্দে
ভাতের গন্ধ নাকে এসে লাগে ভাতের গন্ধ
জেগে উঠতেই চারিদিকে দেখি, দুয়ার বন্ধ।
দ্বার খোলবার সাহসে যখন শরীর শক্ত
হঠাৎ তখুনি মহতো বলে লোকটা অন্ধ;