আমার মস্তিষ্কে নয়
আমার কৈশোর বুঝি বসে আছে চোখের ভিতরে
বিশাল ধনুক হাতে ক্লান্ত এক সবুজ বালক।
অথচ এ-দৃষ্টিগ্রাহ্য আওতায় আমার
আমারি ছেলেকে দেখি টেরি কাটে ঘুরিয়ে দর্পণ।
কে জানে আমিই কিনা, কিম্বা ঠিক আমিই রয়েছি
ফিরিয়ে দিচ্ছি চুল সোজাসুজি তালুর ওপর।
সটানে পরেছি মোজা, ঘষে নিয়ে হাতার বোতাম
ব্রাশ চালিয়েছি জোরে–বুঝিবা স্তিমিত গ্লাসকীড
চল্লিশ বছর থেকে ঝেড়ে ফেলবে বাপের বয়স।
আমার চোখের তলদেশে
একদা এমন ছিল যে, আমার চোখই ছিল সমস্ত দুঃখের আকর।
এমন কি একটা করুণ উপন্যাসও পড়তে পারতাম না আমি।
বুক ঠেলে কান্না উঠে আসতো চোখে। গাল বেয়ে নামতো ধারাজল।
উপচানো চোখ নিয়ে আমি লজ্জায় মুখ লুকাতাম।
একটা সামান্য বই নিয়ে আমার এ অবস্থা দেখে
পড়ার টেবিলে বোনেরা পাথর হয়ে যেতো। আম্মা
থমকে দাঁড়াতেন। আর আব্বা ঘরে থাকলে
সোজাসুজি বিহ্বল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে
কি যেন ভাবতে ভাবতে মসজিদে চলে যেতেন।
কিন্তু তাদের চোখ থাকতো সবর্দাই নির্জলা পাথর।
দুঃখ পেলে তারা একেবারেই কাঁদতেন না, এমন নয়।
সন্তপ্ত অথবা সন্তানহারা হলে তারাও কাঁদতেন। তাদের
চোখও ফেটে যেতো। একবার আমার কনিষ্ঠতমা বোন
নিউমোনিয়ায় মারা গেলে আম্মা অনেকদিন
কেঁদেছিলেন। সে কান্না, আমি ভুলিনি।
আমার মাকে শোকাভিভূতা ভাবলেই দৃশ্যটি
চোখের ওপর এসে দাঁড়ায়। কিন্তু আবহমান কালের মধ্যে
তারা ছিলেন বাম্পহীন। নির্জল, নির্মেষ।
আমার কৈশোর আমাকে আর্দ্র করে রেখেছিল।
আর আমার চোখ ছিল গ্রাসে ভিজানো
ইছবগুলের দানার মতো জলভরা।
এখন কিছুই পাল্টে গেছে।
যে চোখ ছিল ঝিলের ভিতর উত্থিত ফোয়ারার মতো।
এখন তার তলদেশে চকচকে বালি।
আজকাল আমার মার সাথে আমার কদাপি দেখা হয়।
মাঝে মাঝে আসেন। গ্রাম থেকে নিয়ে আসেন সরু চাল।
গাঁওয়া ঘি। খাঁটি সর্ষের তেল আর বিশুদ্ধ অনুতাপময় কান্না।
তার ধারণা শহরের ভেজালে আমার স্বাস্থ্য নষ্ট হচ্ছে।
আমার ছেলেরা ঠিকমতো বাড়ছে না।
যেমন আমি ভাবি, গ্রাম থেকে শুদ্ধ মানুষের স্রোত এসে
একদিন শহর দখল করে নেবে। তেমনি।
আমরা দুদিক থেকে দুজনকে দেখি।
আমার মার শুধু অভিযোগ আর অভিযোগ
একবার ভাইয়ের বিরুদ্ধে। একবার বোন আর
বহমান কালের বিরুদ্ধে। তারপর
অবিরল কান্না।
আমার বাপ নেই। থাকলে
তিনিও কি কাঁদতেন?
তবু আমার জননী বাপাকুল চোখে কেন আমার
চোখের দিকেই তাকিয়ে থাকেন?
আমি অবশ্য সান্ত্বনাচ্ছলে তাকে ধমক লাগাই।
তার কান্না থামে না।
তাকে সংসার চালাবার মতো টাকা দিই। কিন্তু
আমার চোখ শুকনো থাকে। যেন
সকালের সংবাদপত্রের দুটি জাজ্বল্যমান
আন্তর্জাতিক হেডলাইন।
আমার প্রাতরাশে
সকালে দরজা খুলে এই রাজভিখারীর হাত
যেমন সংবাদপত্রের মতো অস্থায়ী কচুর পাতায়
খেতে চায় স্ফটিকশুভ্র স্বচ্ছ স্বাদ, আজ সেই পাত্রে টলমল
ঘোলাজল সমুদ্রের। দেখো
এত বড়ো বঙ্গোপসাগরকেই আজ যেন
ভাঁজ করে পাঠালেন সাংবাদিক
সজ্জন সুধীরা।
আমার প্রাতরাশের হলদেটে
টাটকিনি মাছের ফাঁকে ফাঁকে
কলার টুমের মতো অসাবধানে শুয়ে পড়লো
ভোলার অসংখ্য মৃত কিশোরের শব। আর
সঙ্গিনীর দীপ্ত ধুম্রময় চায়ের সুনামে
সন্দ্বীপের পেটফোলা যুবতীর লাশ ধোয়া পানি
ছিটকে ছিটকে ঝরতে লাগলো একটানা।
জানলার হাওয়ার ঠকঠকি শুনে এত ভয়?
বুঝিবা এখুনি
লাখো লাখো মড়া গাই
বিশাল গোয়াল ভেবে
ঢুকে যাবে আমার কামরায়।
কিম্বা দেবতা বেল-এনলিল তার
আজ্ঞাবহ জলের পীড়নে
প্রাণহীন একপাল তাগড়া গরুকে
ঢেউয়ে ঢেউয়ে তাড়িয়ে ফিরিয়ে
আমার বুকের মধ্যে ঠুকলেন
খড়কে-অলা বিশাল পাজন।
আমি আর আসবো না বলে
আর আসবো না বলে দুধের ওপরে ভাসা সর
চামোচে নিংড়ে নিয়ে চেয়ে আছি। বাইরে বৃষ্টির ধোঁয়া
যেন শাদা স্বপ্নের চাদর
বিছিয়েছে পৃথিবীতে।
কেন এতো বুক দোলে? আমি আর আসবো না বলে?
যদিও কাঁপছে হাত তবু ঠিক অভ্যেসের বশে
লিখছি অসংখ্য নাম চেনাজানা
সমস্ত কিছুর।
প্রতিটি নামের শেষে, আসবো না।
পাখি, আমি আসবো না।
নদী, আমি আসবো না।
নারী, আর আসবো না, বোন।
আর আসবো না বলে মিছিলের প্রথম পতাকা
তুলে নিই হাতে।
আর আসবো না বলে
সংগঠিত করে তুলি মানুষের ভিতরে মানুষ।
কথার ভেতরে কথা গেঁথে দেওয়া, কেন?
আসবো না বলেই।
বুকের মধ্যে বুক ধরে রাখা, কেন?
আসবো না বলেই।
অথচ স্মৃতির মধ্যে পরতে পরতে জমে আছে
দুঃখের অস্পষ্ট জল। মনে হয় যে নদীকে চিনি
সেও ঠিক নদী নয়, আভাসে ইঙ্গিতে কিছু জল।
যে নারী দিয়েছে খুলে নীবিবন্ধ, লেহনে পেষণে
আমি কি দেখেছি তার পরিপূর্ণ পিঠের নগ্নতা?
হয়তো জংঘার পাশে ছিল তার খয়েরী জরুল
লেহনলীলায় মত্ত যা আমার লেলিহান জিহ্বারও জানে না।
আজ অতৃপ্তির পাশে বিদায়ের বিষণ্ণ রুমালে
কে তুলে অক্ষর কালো, ‘আসবো না’
সুখ, আমি আসবো না।
দুঃখ, আমি আসবো না।
প্রেম, হে কাম, হে কবিতা আমার
তোমরা কি মাইল পোস্ট না ফেরার পথের ওপর?
আমিও রাস্তায়
অসংখ্য চক্ষু যেন ঘিরে ফেলবে এখুনি আমাকে
শস্যের সবুজ থেকে ক্রমাগত উঠে এসে গোসার গোঙানি
করোগেটে ঢেউ তুলে চাবকে দেবে আমাকে নির্মম।
তন্নতন্ন দেখে নেবে বাসন কোশন
পুঁথিপত্র ছারখার ছড়িয়ে চৌদিকে
শিকার পাইলা খুলে দেখবে নেই, ভাত বা সালুন।