১৩
লোবানের গন্ধে লাল চোখ দুটি খোললা রূপবতী
আমার নিশ্বাসে কাপে নকশাকাটা, বস্ত্রের দুকূল,
শরমে আনত করে হয়েছিলে বনের কপোতী?
যেন বা কাঁপছো আজ ঝড়ে পাওয়া বেতসের মূল?
বাতাসে ভেঙেছে খোঁপা, মুখ তোলো, হে দেখনহাসি
তোমার টিকলি হয়ে হৃদপিণ্ড নড়ে দুরু দুরু
মঙ্গলকুলোয় ধান্য ধরে আছে সারা গ্রাব্বাসী
উঠোনে বিন্নীর খই, বিছানায় আতর, অগুরু।
শুভ এই ধানদুর্বা শিরোধার্য করে মহিয়সী
আবরু আলগা করে বাঁধো ফের চুলের স্তবক,
চৌকাঠ ধরেছে এসে ননদীরা তোমার বয়সী
সমানত হয়ে শোনো সংসারের প্রথম সবক।
বধূবরণের নামে দাড়িয়েছে মহামাতৃকূল
গাঙের ঢেউয়ের মতো বলো কন্যা কবুল, কবুল।
১৪
বৃষ্টির দোহাই বিবি, তিলবর্ণ ধানের দোহাই
দোহাই মাছ-মাংস দুগ্ধবতী হালাল পশুর,
লাঙল জোয়াল কাস্তে বায়ুভরা পালের দোহাই
হৃদয়ের ধর্ম নিয়ে কোন কবি করে না কসুর।
কথার খেলাপ করে আমি যদি জবান নাপাক
কোনদিন করি তবে হয়ো তুমি বিদ্যুতের ফলা,
এ-বক্ষ বিদীর্ণ করে নামে যেন তোমার তালাক
নাদানের রোজগারে না উঠিও আমিষের নলা।
রাতের নদীতে ভাসা পানিউড়ী পাখির ছতরে,
শিষ্ট ঢেউয়ের পাল যে কিসিমে ভাঙে ছল ছল
আমার চুম্বন রাশি ক্রমাগত তোমার গতরে
ঢেলে দেবো চিরদিন মুক্ত করে লজ্জার আগল,
এর ব্যতিক্রমে বানু এ-মস্তকে নামুক লানৎ
ভাষার শপথ আর প্রেমময় কাব্যের শপথ।
স্বপ্নের সানুদেশে
একদা এক অস্পষ্ট কুয়াশার মধ্যে আমাদের যাত্রা
তারপর দিগন্তে আলোর ঝলকানিতে আমাদের পথ
উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। বাতাসে ধানের গন্ধ,
পাখির কাকলিতে মুখরিত অরণ্যানী।
আমাদের সবার হৃদয় নিসর্গের এক অপরাপ ছবি হয়ে
ভাসতে লাগলো।
নদী, নদী—
সন্তানেরা উল্লসিত আনন্দের মধ্যে আঙুল তুলে
যে স্পষ্ট জলধারা দেখালো, তা আমাদের প্রাণ।
এই সেই স্রোতস্বিনী, যার নকশায় আমাদের রমণীরা
শাড়ি বোনেন। ঐ সেই বাঁক যার অনুকরণে
আমার বোনেরা বমি রেখায় এঁটে দেহ আবৃত করেন।
দেখো সেই পুণ্যতোয়া,
যার কলস্বর আমাদের সঙ্গীতে নিমজ্জিত করে।
দেখো, দেখো।
আমরা যেখানে যাবো, সেই বিশাল উপত্যকার ছবি।
আমাদের সমস্ত অন্তরকে গ্রাস করে আছে। আমাদের পতাকায়
রূপকথার বাতাস ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যৎ
আমাদের আশাকে দোলাচ্ছে সোনালি দোলকের মতো,
বার বার।
আনন্দে আপ্লুত হয়ে আমরা স্বপ্নের দিকে
রওনা দিয়েছি। দুঃখ
আমাদের ক্লান্ত করে না।
দুর্যোগের রাতে আমরা এক উজ্জ্বল দিনের দিকে
মুখ ফিরিয়েছি। বিঘ্ন
আমাদের বিবশ করেনি।
চীৎকার, কান্না ও হতাশার গোলকধাঁধা ছেড়ে
আমরা বেরিয়ে যাবো। মৃত্যু
আমাদের স্পর্শ না করুক।
স্বপ্নের সানুদেশে আমরা শস্যের বীজ ছড়িয়ে দেবো
বাম দিকে বয়ে যাবে রুপোলি নদীর জল, ডানে
তীক্ষ্ণ তুষিত পর্বত।
স্বব্ধতার মধ্যে তার ঠোঁট নড়ে
আমি জানতাম প্রত্যেক বিজয়ীর জন্যে থাকে পুরস্কার।
যুদ্ধ ফেরত ক্লান্ত বীরদের পাওনা, পুলকের প্রস্রবণ।
এমন কি আহত, পঙ্গুদের বুকেও সান্তনার পদক ঝলকায়।
আর কে না জানে এসব তাদেরই প্রাপ্য। চিরকালই বীরত্বের
বিনিময়ে এরকম রেওয়াজ রয়েছে।
কিন্তু একজন কবিকে কি দেবে তোমরা? যে ভবিষ্যতের দিকে
দাঁড়িয়ে থাকে বিষণ্ণ বদনে? অঙুলি হেলনে যার নিসর্গও
ফেটে যায় নদীর ধারায়। উচ্চারণে কাঁপে মাঠ,
ছত্রভঙ্গ মিছিল, মানুষ, পাক খেয়ে এক হয়ে যায়।
যখন সে ফিরে, দেখে, আচ্ছন্ন উঠোন। সে দেখে
শিশুর শব নিস্পৃহ মায়ায়। সে দেখে ধর্ষিতার শাড়ি
ছিন্ন ভিন্ন, হত্যায় ছাপানো। স্ততার মধ্যে তার ঠোঁট নড়ে
ইতিবৃত্ত ভেঙে পড়ে রক্তবর্ণ অক্ষরের স্রোতে।
আমি এক সময় সংবাদপত্রে প্রুফরিডার ছিলাম।
প্রতিটি আকার ই-কারের অনুপস্থিতি এখনও
আমার চোখে লাগে। তবু কেন এরকম হচ্ছে
কে আমাকে বলে দেবে?
আমি কেন প্রতিটি রংয়ের ভিতর
অন্য রংকে দেখতে পাই।