স্বপ্নপথ
আজ রাত্রে ভেঙে গেল ঘুম,
চারিদিক নিস্তব্ধ নিঃঝুম,
তন্দ্রাঘোরে দেখিলাম চেয়ে
অবিরাম স্বপ্নপথ বেয়ে
চলিয়াছে দুরাশার স্রোত,
বুকে তার বহু ভগ্ন পোত।
বিফল জীবন যাহাদের,
তারাই টানিছে তার জের;
অবিশ্রান্ত পৃথিবীর পথে,
জলে স্থলে আকাশে পর্বতে।
একদিন পথে যেতে যেতে
উষ্ণ বক্ষ উঠেছিল মেতে
যাহাদের, তারাই সংঘাতে
মৃত্যুমুখী, ব্যর্থ রক্তপাতে।।
স্মারক
আজ রাতে যদি শ্রাবণের মেঘ হঠাৎ ফিরিয়া যায়
তবুও পড়িবে মনে,
চঞ্চল হাওয়া যদি ফেরে হৃদয়ের আঙ্গিনায়
রজনীগন্ধা বনে,
তবুও পড়িবে মনে।
বলাকার পাখা আজও যদি উড়ে সুদূর দিগঞ্চলে
বন্যার মহাবেগে,
তবুও আমার স্তব্ধ বুকের ক্রন্দন যাবে মেলে
মুক্তির ঢেউ লেগে,
মুক্তির মহাবেগে।
বাসরঘরের প্রভাতের মতো স্বপ্ন মিলায় যদি
বিনিদ্র কলরবে
তবুও পথের শেষ সীমাটুকু চিরকাল নিরবধি
পার হয়ে যেতে হবে,
বিনিদ্র কলরবে।
মদিরাপাত্র শুষ্ক যখন উৎসবহীন রাতে
বিষণ্ণ অবসাদে
বুঝি বা তখন সুপ্তির তৃষা ক্ষুব্ধ নয়নপাতে
অস্থির হয়ে কাঁদে,
বিষণ্ণ অবসাদে।
নির্জন পথে হঠাৎ হাওয়ার আসক্তহীন মায়া
ধূলিরে উড়ায় দূরে,
আমার বিবাগী মনের কোণেতে কিসের গোপন ছায়া
নিঃশ্বাস ফেলে সুরে;
ধূলিরে উড়ায় দূরে।
কাহার চকিত-চাহনি-অধীর পিছনের পানে চেয়ে
কাঁদিয়া কাটায় রাতি,
আলেয়ার বুকে জ্যোৎস্নার ছবি সহসা দেখিতে পেয়ে
জ্বালে নাই তার বাতি,
কাঁদিয়া কাটায় রাতি।
বিরহিণী তারা আঁধারের বুকে সূর্যেরে কভু হায়
দেখেনিকো কোনো ক্ষণে।
আজ রাতে যদি শ্রাবণের মেঘ হঠাৎ ফিরিয়া যায়
হয়তো পড়িবে মনে,
রজনীগন্ধা বনে।।
হদিশ
আমি সৈনিক, হাঁটি যুগ থেকে যুগান্তরে
প্রভাতী আলোয়, অনেক ক্লান্ত দিনের পরে,
অজ্ঞাত এক প্রাণের ঝড়ে।
বহু শতাব্দী দরে লাঞ্ছিত, পাই নি ছাড়া
বহু বিদ্রোহ দিয়েছে মনের প্রান্ত নাড়া
তবু হতবাক দিই নি সাড়া।
আমি সৈনিক, দাসত্ব কাঁদে যুদ্ধে যেতে
দেখেছি প্রাণের উচ্ছ্বাস দূরে ধানের ক্ষেতে
তবু কেন যেন উঠি নি মেতে।
কত সান্ত্বনা খুঁজেছি আকাশে গভীর নীলে
শুধু শূন্যতা এনেছে বিষাদ এই নিখিলে
মূঢ় আতঙ্ক জন-মিছিলে।
ক্ষতবিক্ষত চলেছি হাজার, তবুও একা
সামনে বিরাট শত্রু পাহাড় আকাশ ঠেকা
কোন সূর্যের পাই নি দেখা।
অনেক রক্ত দিয়েছি বিমূঢ় বিনা কারণে
বিরোধী স্বার্থ করেছি পুষ্ট অযথা রণে;
সঙ্গিবিহীন প্রাণধারণে।
ভীরু সৈনিক করেছি দলিত কত বিক্ষোভ
ইন্ধন চেয়ে যখনি জ্বলেছে কুবেরীর লোভ
দিয়েছি তখনি জন-খাণ্ডব!
একদা যুদ্ধ শুরু হল সারা বিশ্ব জুড়ে,
জগতের যত লুণ্ঠনকারী আর মজুরে,
চঞ্চল দিন ঘোড়ার খুরে।
উঠি উদ্ধত প্রাণের শিখরে, চারিদিকে চাই
এল আহ্বান জন-পুঞ্জের শুনি রোশনাই
দেখি ক্রমাগত কাছে উৎরাই।
হাতছানি দিয়ে গেল শস্যের উন্নত শীষ,
জনযাত্রায় নতুন হদিশ –
সহসা প্রণের সবুজে সোনার দৃঢ় উষ্ণীষ।।
হে পৃথিবী
হে পৃথিবী, আজিকে বিদায়
এ দুর্ভাগা চায়,
যদি কভু শুধু ভুল ক’রে
মনে রাখো মোরে,
বিলুপ্ত সার্থক মনে হবে
দুর্ভাগার!
বিস্মৃত শৈশবে
যে আঁদার ছিল চারিভিতে
তারে কি নিভৃতে
আবার আপন ক’রে পাব,
ব্যর্থতার চিহ্ন এঁকে যাব,
স্মৃতির মর্মরে?
প্রভাতপাখির কলস্বরে
যে লগ্নে করেছি অভিযান,
আজ তার তিক্ত অবসান।
তবু তো পথের পাশে পাশে
প্রতি ঘাসে ঘাসে।
লেগেছে বিস্ময়!
সেই মোর জয়।।