বিভীষণের প্রতি
আমরা সবাই প্রস্তুত আজ, ভীরু পলাতক
লুপ্ত অধুনা এদেশে তোমার গুপ্তঘাতক,
হাজার জীবন বিকশিত এক রক্ত-ফুলে,
পথে-প্রান্তরে নতুন স্বপ্ন উঠেছে দুলে।
অভিজ্ঞতার আগুনে শুদ্ধ অতীত পাতক,
এখানে সবাই সংঘবদ্ধ, হে নবজাতক।
ক্রমশ এদেশে গুচ্ছবদ্ধ রক্ত-কুসুম
ছড়ায় শত্রু-শবের গন্ধ, তাতে ভাঙে ভীত ঘুম।
এখানে কৃষক বাড়ায় ফসল মিলিত হাতে,
তোমার স্বপ্ন চূর্ণ করার শপথ দাঁতে ,
যদিও নিত্য মূর্খ বাধার ব্যর্থ জুলুমঃ
তবু শত্রুর নিদনে লিপ্ত বাসনার দুম।
মিলিত ও ক্ষত পায়ের রক্ত গড়ে লালপথ,
তাইতো লক্ষ মুঠিতে ব্যক্ত দৃঢ় অভিমত।
ক্ষুদিত প্রাণের অক্ষরে লেখা, “প্রবেশ নিষেধ,
এখানে সবাই ভুলেছে দ্বন্দ্ব ভুলেছে বিভেদ।”
দুর্ভিক্ষ ও শত্রুর শেষ হবে যুগপৎ,
শোণিত ধারার উষ্ণ ঐক্যে ঘনায় বিপদ।।
বুদ্বুদ মাত্র
মৃত্যুকে ভুলেছ তুমি তাই,
তোমার অশান্ত মনে বিপ্লব বিরাজে সর্বদাই।
প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা মৃত্যুকে স্মরণ ক’রো মনে,
মুহূর্তে মুহূর্তে মিথ্যা জীবন ক্ষরণে, –
তারি তরে পাতা সিংহাসন,
রাত্রি দিন অসাধ্য সাধন।
তবুও প্রচণ্ড-গতি জীবনের ধরা,
নিয়ত কালের কীর্তি দিতেছে পাহারা,
জন্মের প্রথম কাল হতে,
আমরা বুদ্বুদ মাত্র জীবনের স্রোতে।
এ পৃথিবী অত্যন্ত কুশলী,
যেখানে কীর্তির নামাবলী,
আমাদের স্থান নেই সেথা –
আমরা শক্তের ভক্ত, নহি তো বিজেতা।।
মুহূর্ত (ক)
এমন মুহূর্ত এসেছিল
একদিন আমার জীবনে
যে মহূর্তে মনে হয়েছিল
সার্থক ভুবনে বেঁচে থাকাঃ
কালের আরণ্য পদপাত
ঘটেছিল আমার গুহায়।
জরাগ্রস্ত শীতের পাতারা
উড়ে এসেছিল কোথা থেকে,
সব কিছু মিশে একাকার
কাল-বোশেখীর পদার্পণে
সেদিন হাওয়ায় জমেছিল
অদ্ভুত রোমাঞ্চ দিকে দিকে;
আকাশের চোখে আশীর্বাদ,
চুক্তি ছিল আমৃত্যু জীবনে।
সে সব মুহূর্তগুলো আজো
প্রাণের অষ্পষ্ট প্রশাখায়
ফোটায় সবুজ ফুল,
উড়ে আসে কাব্যের মৌমাছি।
অসংখ্য মুহূর্তে গ’ড়ে তোলা
স্বপ্ন-দুর্গ মুহূর্তে চুরমার।
আজ কক্ষচ্যুত ভাবি আমি
মুহূর্তকে ভুলে থাকা বৃথা; –
যে মুহূর্ত অদৃশ্য প্লাবনে
টেনে নিয়ে যায় কান্তরে।
আজ আছি নক্ষত্রের দলে,
কাল জানি মুহূর্তের টানে
ভেসে যাব সূর্যের সভায়,
ক্ষুব্ধ কালো ঝড়ের জাহাজে।।
মুহূর্ত (খ)
মুহূর্তকে ভুলে থাকা বৃথা
যে মুহূর্ত
তোমার আমার আর অন্য সকলের
মৃত্যুর সূচনা,
যে মুহূর্ত এনে দিল আমার কবিতা
আর তোমার আগ্রহ।
এ মুহূর্তে সূর্যোদয়,
এ মুহূর্তে নক্ষত্রের সভা,
আর এক মুহূর্তে দেখি কালো ঝড়ে
সুস্পষ্ট সংকেত।
অনেক মুহূর্ত মিলে পৃথিবীর
বাড়াল ফসল,
মুহূর্তে মুহূর্তে তারপর
সে ফসলে ঘনালো উচ্ছেদ।
এমন মুহূর্ত এল আমার জীবনে,
যে মুহূর্ত চিরদিন মনে রাখা যায় –
অথচ আশ্চর্য কথা
নতুন মুহূর্ত আর এক
সে মুহূর্তে ছড়ালো বিষাদ।
অনেক মুহূর্ত গেছে অনেক জীবন,
যে সব মুহূর্ত মিলে
আমার কাব্যের শূন্য হাতে
ভরে দিত অক্ষয় সম্পদ।
কিন্তু আজ উষ্ণ-দ্বিপ্রহরে
আমার মুহূর্ত কাটে কাব্যরচনার
দুঃসহ চেষ্টায়।
হয়তো এ মুহূর্তেই অন্য কোনো কবি
কাব্যের অজস্র প্রেরণায়
উচ্ছ্বসিত, অথচ বাধার
উদ্ধত প্রাচীর মুখোমুখি।
অতএব মুহূর্তকে মনে রাখা ভাল
যে মুহূর্ত বৃথা ক্ষয় হয়।
গোপন মুহূর্ত আজ এক
নিশ্ছিদ্র আকাশে
অবিরাম পূর্বাচল খুঁজে
ক্লান্ত হল অস্ফুট জীবনে,
নিঃসঙ্গ স্বপ্নের আসা-যাওয়া
ধূলিসাৎ – তাই আজ দেখি,
প্রত্যেক মুহূর্ত অনাগত
মুহূর্তের রক্তিম কপোলে
তুলে ধরে সলজ্জ প্রার্থনা।।
মৃত পৃথিবী
পৃথিবী কি আজ শেষে নিঃস্ব
ক্ষুধাতুর কাঁদে সারা বিশ্ব,
চারিদিকে ঝরে পড়া রক্ত,
জীবন আজকে উত্যক্ত।
আজকের দিন নয় কাব্যের
পরিণাম আর সম্ভাব্যের
ভয় নিয়ে দিন কাটে নিত্য,
জীবনে গোপন-দুর্বৃত্ত।
তাইতো জীবন আজ রিক্ত,
অলস হৃদয় স্বেদসিক্ত;
আজকে প্রাচীর গড়া ভিন্ন
পৃথিবী ছড়াবে ক্ষতচিহ্ন।
অগোচরে নামে হিম-শৈত্য,
কোথায় পালাবে মরু দৈত্য?
জীবন যদিও উৎক্ষিপ্ত,
তবু তো হৃদয় উদ্দীপ্ত,
বোধহয় আগামী কোনো বন্যায়,
ভেসে যাবে অনশন, অন্যায়।।
সহসা
আমার গোপন সূর্য হল অস্তগামী
এপারে মর্মরধ্বনি শুনি,
নিস্পন্দ শবের রাজ্য হতে
ক্লান্ত চোখে তাকাল শকুনি।
গোদূলি আকাশ ব’লে দিল
তোমার মরণ অতি কাছে,
তোমার বিশাল পৃথিবীতে
এখনো বসন্ত বেঁচে আছে।
অদূরে নিবিড় ঝাউবনে
যে কালো ঘিরেছে নীরবতা,
চোখ তারই দীর্ঘায়িত পথে
অস্পষ্ট ভাষায় কয় কথা।
আমার দিনান্ত নামে ধীরে
আমি তো সুদূর পরাহত,
অশত্থশাখায় কালো পাখি
দুশ্চিন্তা ছড়ায় অবিরত।
সন্ধ্যাবেলা, আজ সন্ধ্যাবেলা
নিষ্ঠুর তমিস্রা ঘনাল কী!
মরণ পশ্চাতে বুঝি ছিল
সহসা উদার চোখাচোখি।।
সুতরাং
এত দিন ছিল বাঁধা সড়ক,
আজ চোখে দেখি শুধু নরক!
এত আঘাত কি সইবে,
যদি না বাঁচি দৈবে?
চারি পাশে লেগে গেছে মড়ক!
বহুদিনকার উপার্জন,
আজ দিতে হবে বিসর্জন।
নিষ্ফল যদি পন্থা;
সুতরাং ছেঁড়া কন্থা
মনে হয় শ্রেয় বর্জন।।
স্বতঃসিদ্ধ
মৃত্যুর মৃত্তিকা ‘পরে ভিত্তি প্রতিকূল –
সেখানে নিয়ত রাত্রি ঘনায় বিপুল;
সহসা চৈত্রের হাওয়া ছড়ায় বিদায়ঃ
স্তিমিত সূর্যের চোখে অন্ধকার ছায়।
বিরহ-বন্যার বেগে প্রভাতের মেঘ
রাত্রির সীমায় এসে জানায় আবেগ,
ধূসর প্রপঞ্চ-বিশ্ব উন্মুক্ত আকাশে
অনেক বিপন্ন স্মৃতি বয়ে নিয়ে আসে।
তবু তো প্রাণের মর্মে প্রচ্ছন্ন জিজ্ঞাসা
অজস্র ফুলের রাজ্যে বাঁধে লঘু বাসা;
রাত্রির বিবর্ণ স্মৃতি প্রভাতের বুকে
ছড়ায় মলিন হাসি নিরর্থ-কৌতুকে।।