দেয়ালিকা
এক
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে
লিখি কথা।
আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার
স্বাধীনতা।
দুই
সকালে বিকালে মনের খেয়ালে
ইঁদারায়
দাঁড়িয়ে থাকলে অর্থটা তার
কি দাঁড়ায়?
তিন
কখন বাজল ছ’টা
প্রাসাদে প্রাসাদে ঝলসায় দেখি
শেষ সূর্যের ছটা –
স্তিমিত দিনের উদ্ধত ঘনঘটা।
চার
বেজে চলে রেডিও
সর্বদা গোলমাল করতেই
‘রেডি’ ও।
পাঁচ
জাপানী গো জাপানী
ভারতবর্ষে আসতে কি শেষ
ধরে গেল হাঁপানী?
ছয়
জার্মানী গো জার্মানী
তুমি ছিলে অজেয় বীর
এ কথা আজ আর মানি!
সাত
হে রাজকন্যে
তোমার জন্যে
এ জনারণ্যে
নেইকো ঠাঁই-
জানাই তাই।
আট
আঁধিয়ারে কেঁদে কয় সল্তেঃ
‘চাইনে চাইনে আমি জ্বলতে।’
নিবৃত্তির পূর্বে
দুর্বল পৃথিবী কাঁদে জটিল বিকারে,
মৃত্যুহীন ধমনীর জ্বলন্ত প্রলাপ;
অবরুদ্ধ বে তার উন্মাদ তড়িৎ;
নিত্য দেখে বিভীষিকা পূর্ব অভিশাপ।
ভয়ার্ত শোণিত-চক্ষে নামে কালোছায়া,
রক্তাক্ত ঝটিকা আনে মূর্ত শিহরণ–
দিক্প্রান্তে শোকাতুরা হাসে ক্রূর হাসি,
রোগগ্রস্ত সন্তানের অদ্ভুত মরণ।
দৃষ্টিহীন আকাশের নিষ্ঠুর সান্ত্বনাঃ
ধূ-ধূ করে চেরাপুঞ্জি-সহিষ্ণু হৃদয়।
ক্লান্তিহারা পথিকের অরণ্য ক্রন্দনঃ
নিশীথে প্রেতের বুকে জাগে মৃত্যুভয়।।
পরাভব
হঠাৎ ফাল্গুনী হাওয়া ব্যাধিগ্রস্ত কলির সন্ধ্যায়ঃ
নগরে নগররক্ষী পদাতিক পদধ্বনি শুনি; –
দুরাগত স্বপ্নের কী দুর্দিন, – মহামারী,অন্তরে বিক্ষোভ –
অবসন্ন বিলাসের সংকুচিত প্রাণ।
ব্যক্তিত্বের গাত্রদাহ; রন্ধ্রহীন স্বধর্ম বিকাশ
অতীতের ভগ্ননীড় এইবার সুপুষ্ট সন্ধ্যায়।
বণিকের চোখে আজ কী দুরন্ত লোভ ঝ’রে পরে, –
বৈশাখের ঝড়ে তারই অস্পষ্ট চেতনা।
ক্ষয়িষ্ণু দিনেরা কাঁদে অনর্থক প্রসব ব্যথায়….
নশ্বর পৌষের দিন চারিদিকে ধূর্তের সমতাঃ
জটিল আবর্তে শুধু নৈমিত্তিক প্রাণের স্পন্দন।
গলিত উদ্যম তাই বৈরাগ্যের ভান, –
প্রকাশ্য ভিক্ষার ঝুলি কালক্রমে অত্যন্ত উদার;
সংক্রামিত রক্ত-রোগ পৃথিবীর প্রতি ধমনীতে।
শোকাচ্ছন্ন আমাদের সনাতন মন,
পৃথিবীর সম্ভাবিত অকাল মৃত্যুতে,
দুর্দিনের সমন্বয়, সম্মুখেতে অনন্ত প্রহর।
বিজিগীষা? – সন্দিহান আগামী দিনেরাঃ
দৃষ্টিপথ অন্ধকার, (লাল-সূর্য মুক্তির প্রতীক?
-আজ তবে প্রতীক্ষায় আমাদের অরণ্যবাসর।)
পরিবেশন
সান্ধ্য ভিড় জমে ওঠে রেস্তোরাঁর দুর্লভ আসরে,
অর্থনীতি, ইতিহাস, সিনেমার পরিচ্ছন্ন পথে –
খুঁজে ফেরে অনন্তের বিলুপ্ত পর্যায়।
গন্ধহীন আনন্দের অন্তিম নির্যাস
এক কাপ চা-এ আর রঙিন সজ্জায়।
সম্প্রতি নীরব হল; বিনিদ্র বাসরে
ধূমপান চলেঃ তবে ভবতরী তাস।
স্মৃতি-ভ্রষ্ট উঞ্ছজীবী চলে কোন মতে।
জড়-ভরতের দল বসে আছে পার্কের বেঞ্চিতে,
পবিত্র জাহ্নবী-তীরে প্রার্থী যত বেকার যুবক।
কতক্ষণ? গঞ্জনার বড় তীব্র জ্বালা-
বিবাগী প্রাণের তবু গৃহগত টান।
ক্রমে গোঠে সন্ধ্যা নামেঃ অন্তরও নিরালা,
এই বার ফিরে চলো, ভাগ্য সবই মিতে;
দূরে বাজে একটানা রেডিয়োর গান।
এখনো হয় নি শূন্য, ক্রমাগত বেড়ে চলে সখ।
ক্ষীণ শব্দ ভেসে আসে, আগমনী পশ্চিমা হাওয়ায়,
সুপ্রাচীন গুরুভক্তি আজো আনে উন্মুক্ত লালসা।
চুপ করে বসে থাকো অন্ধকার ঘরে এক কোণেঃ
রাম আর রাবণের উভয়েরই হাতে তীক্ষ্ণ কশা।।
পূর্বাভাস
সন্ধ্যার আকাশতলে পীড়িত নিঃশ্বাসে
বিশীর্ণ পাণ্ডুর চাঁদ ম্লান হয়ে আসে।
বুভুক্ষু প্রেতেরা হাসে শাণিত বিদ্রূপে,
প্রাণ চায় শতাব্দীর বিলুপ্ত রক্তের–
সুষুপ্ত যরো নিত্য কাঁদিছে ক্ষুদায়
দূর্ত দাবাগ্নি আজ জ্বলে চুপে চুপে
প্রমত্ত কস্তুরীমৃগ ক্ষুব্ধ চেতনায়
বিপন্ন করুণ ডাকে তোলে আর্তনাদ।
ব্যর্থ আজ শব্দভেদী বাণ–
সহস্র তির্যকশৃঙ্গ করিছে বিবাদ –
জীবন-মৃত্যুর সীমানায়।
লাঞ্ছিত সম্মান।
ফিরে চায় ভীরু-দৃষ্টি দিয়ে।
দুর্বল তিতিক্ষা আজ দুর্বাশার তেজে
স্বপ্ন মাঝে উঠেছে বিষিয়ে।
দূর পূর্বাকাশে,
বিহ্বল বিষাণ উঠে বেজে
মরণের শিরায় শিরায়।
মুমূর্ষ বিবর্ণ যত রক্তহীন প্রাণ–
বিস্ফারিত হিংস্র-বেদনায়।
অসংখ্য স্পন্দনে চলে মৃত্যু অভিযান
লৌহের দুয়ারে পড়ে কুটিল আঘাত,
উত্তপ্ত মাটিতে ঝরে বর্ণহীন শোণিত প্রপাত।
সুপ্তোত্থিত পিরামিড দুঃসহ জ্বালায়
পৈশাচিক ক্রূর হাসি হেসে
বিস্তীর্ণ অরণ্য মাঝে কুঠার চালায়।
কালো মৃত্যু ফিরে যায় এসে।।
প্রতিদ্বন্দ্বী
গন্ধ এনেছে তীব্র নেশায়, ফেনিল মদির,
জোয়ার কি এল রক্ত নদীর?
নইলে কখনো নিস্তার নেই বন্দীশালায়।
সচারাচর কি সামনা সামনি ধূর্ত পালায়?
কাজ নেই আর বল্লাল সেন-ই আমলে,
মুক্তি পেয়েছি ধোঁয়াতে নিবিড় শ্যামলে,
তোমাতে আমাতে চিরদিন চলে দ্বন্দ্ব।
ঠাণ্ডা হাওয়ায় তীব্র বাঁশির ছন্দ।
মনেরে জাগায় সাবধান হুঁশিয়ার।
খুঁজে নিতে হবে পুরাতন হাতিয়ার
পাণ্ডুর পৃথিবীতে।
আফিঙের ঘোর মেরু-বর্জিত শীতে
বিষাক্ত আর শিথিল আবেষ্টনে
তোমারে স্মরিছে মনে।
সন্ধান করে নিত্য নিভৃত রাতে
প্রতিদ্বন্দ্বী, -উচ্ছল মদিরাতে।।
প্রথম বার্ষিকী
আবার ফিরে এল বাইশে শ্রাবণ।
আজ বর্ষশেষে হে অতীত,
কোন সম্ভাষণ
জানাব অলক্ষ্য পানে?
ব্যথাক্ষুব্ধ গানে
ঝরাব শ্রাবণ বরিষণ!
দিনে দিনে, তিলে তিলে যে বেদনা
উদাস মধুর
হয়েছে নিঃশব্দ প্রাণে
ভরেছে বিপুল টানে,
তারে আজ দেব কোন সুর?
তোমার ধূসর স্মৃতি, তোমার কাব্যের সুরভিতে
লেগেছে সন্ধ্যার ছোঁওয়া, প্রাণ ভরে দিতে
হেমন্তের শিশিরের কণা
আমি পারিব না।
প্রশান্ত সূর্যাস্ত পরে দিগন্তের যে রাগ-রক্তিমা,
লেগেছে প্রাণের ‘পরে,
সহসা স্মৃতির ঝড়ে
মুছিয়া যাবে কী তার সীমা!
তোমার সন্ধ্যার ছায়াখানি
কোন পথ হতে মোরে
কোন পথে নিয়ে যাবে টানি’
অমর্ত্যরে আলোক সন্ধানী
আমি নাহি জানি।
একদা শ্রাবণ দিনে গভীর চরণে,
নীরবে নিষ্ঠুর সরণিতে
পাদস্পর্শ দিতে
ভিক্ষুক মরণে।
পেয়েছে পথের মধ্যে দিয়েছ অক্ষয়
তব দান,
হে বিরাট প্রাণ!
তোমার চরণ স্পর্শে রোমাঞ্চিত পৃথিবীর ধূলি
উঠিছে আকুলি’,
আজিও স্মৃতির গন্ধে ব্যথিত জনতা
কহিছে নিঃশব্দ স্বরে একমাত্র কথা,
‘তুমি হেথা নাই’।
বিস্ময়ের অন্ধকারে মুহ্যমান জলস্থল তাই
আদো তন্দ্রা, আধো জাগরণে
দক্ষিণ হাওয়ায় ক্ষণে ক্ষণে
ফেলিছে নিঃশ্বাস।
ক্লেদক্লিষ্ট পৃথিবীতে একী পরিহাস।
তুমি চলে গেছ তবু আজিও বহিছে বারোমাস
উদ্দাম বাতাস,
এখনো বসন্ত আসে
সকরুণ বিষণ্ণ নিঃশ্বাসে,
এখনো শ্রাবণ ঝরোঝর
অবিশ্রান্ত মাতায় অন্তর।
এখনো কদম্ব বনে বনে
লাগে দোলা মত্ত সমীরণে,
এখনো উদাসি’
শরতে কাশের ফোটে হাসি।
জীবনে উচ্ছ্বাস, হাসি গান
এখনো হয় নি অবসান।
এখনো ফুটিছে চাঁপা হেনা,
কিছুই তো তুমি দেখিলে না।
তোমার কবির দৃষ্টি দিয়ে
কোন কিছু দিলে না চিনিয়ে
এখন আতঙ্ক দেখি পৃথিবীর অস্থিতে মজ্জায়,
সভ্যতা কাঁপিছে লজ্জায়;
স্বার্থের প্রাচীরতলে মানুষের সমাধি রচনা,
অযথা বিভেদ সৃষ্টি, হীন প্ররোচনা
পরস্পর বিদ্বেষ সংঘাতে,
মিথ্যা ছলনাতে –
আজিকার মানুষের জয়;
প্রসন্ন জীবন মাঝে বিসর্পিল, বিভীষিকাময়।।