মায়ের চোখে
আমার খোকন গাঢ় দুপুরে ঘুমাত, ঘুমাবার
করত ভান আমার বালিশে, বুকে আর
‘গল্প বলো…কড়ির পাহাড়, শঙ্খমালা’, বলত গ্রীষ্মের দুপুরে
কাঁচা আম কত জলছবি হাতে, জাহাজের বাঁশি বাজাত নকল সুরে।
ওঁর চশমা চোখে টুপি পরে দেখা দিত মস্ত সং
আমার হেঁশেলে, লাল টুকটুকে কচি মুখে বুজরুকি ঢং
মাটিতে লুটাতে হেসে আর যারা দেখত পাঁচজন,
বলত, কী-যে কাণ্ড করে একরত্তি তোমার খোকন।
এখন সে স্থূলোদর, প্রশস্ত কপাল, পাতলা চুল
ঢাকে না মাথার টাক, স্লেট হাতে যায় না ইস্কুল।
আজ দেখি স্বাস্থ্যান্বেষী সে-ও ছড়ি হাতে
পার্কে কিংবা নদীতীরে (যদি কমে বাড়তি মেদ, বাড়ে
খুদেটুকু) ঘরে ফেলে সিঁড়ি হাতড়িয়ে অন্ধকারে।
বেড়েছে রক্তের চাপ, দাগ মেপে ঠিকঠাক ঘুমহীন রাতে
কেবলি ওষুধ খায়, ডেন্টিস্টের কাছে যায় যখন-তখন
আমার খোকন।
মূল্যের উপমা
(তাকে, আমাকে যে কবি ব’লে উপহাস করত)
লিখি না গোয়েন্দা গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী
কিংবা চিত্রতারকার বিচিত্র জীবনপঞ্জি লিখে
হয়নি প্রচুর অর্থাগম। অথচ যা-করি তা-ও
যায় না কখনো বলা অসংকোচে ভদ্রমণ্ডলীকে।
আমার উঠোনে সুখ নয় জানি মরালগামিনী
সকালের তাজা রোদে অপরাহ্নে অথবা উধাও
রাত্রির উপুড় করা অন্ধকারে। যখন প্রেমিক
প্রেমিকার উন্মোচিত স্তনে মুখ রেখে ভোলে শোক,
ঠোঁটের উত্তপ্ত তটে থরথর জীবনের দিক
ঝড়ে-পড়া সারেঙের মতো খোঁজে, গণিকার চোখ
যখন কাজলে দীপ্ত ক্লান্তির আড়ালে নগরের
অষ্টতম নাগরের আলিঙ্গনে, জেগে থেকে জ্বলি
স্বর্গবাসী স্বপ্নের চিন্তায় দ্বন্দ্বক্ষুব্ধ টেবিলের
নিষ্কম্প আলোর দিকে দৃষ্টি মেলে। নিজেকে কেবলি
ছেড়ে দিই শুভ্রতম জীবনের বিস্তীর্ণ অতলে।
নিখাদ বিশ্বাস নিয়ে নির্বীজ মাটির রুক্ষতাকে
সাজাই সরেস ফুলে, আমার ঝর্ণার স্নিগ্ধ জলে
মরুভূমি আর্দ্র হয়, শুকনো মৃত কাঠ হয় বীণা
এবং কর্দমে জেগে ওঠে এমন প্রতিমা যাকে
ত্রিলোকে দ্যাখেনি কেউ। প্রত্যহ নগদ মূল্য বিনা
দেয়াল পাথর গাছ নদী বালি বাতাস আঁধার
বিড়ালের চোখ আর পাখির ডানার কাছে শুধু
কথা খুঁজি নিজেকে জীবনপণ যুদ্ধে করে ক্ষয়।
অথচ করে না কেউ ক্ষমা, তাই আমি জ্বলি ধু-ধু-
বিজ্ঞাপন, করতালি, বরমাল্য, জয়-পরাজয়
যা-ই হোক, জানি তবু একরত্তি মূল্য নেই তার।
মেষতন্ত্র
মেষরে মেষ তুই আছিস বেশ,
মনে চিন্তার নেইকো লেশ।
ডানে বললে ঘুরিস ডানে,
বামে বললে বামে।
হাবে ভাবে পৌঁছে যাবি
সোজা মোক্ষধামে।
চলায় ঢিমে তালের রেশ,
মেষরে মেষ তুই আছিস বেশ।
যাদের কথায় জগৎ আলো
বোবা আজকে তারা,
মুখে তুবড়ি ছোটে যাদের
আকাট মূর্খ যারা।
দিনদুপুরে ডাকাত পড়ে
পাড়ায় রাহাজানি,
দশের দশায় ধেড়ে কুমির
ফেলছে চোখের পানি।
পৃথিবীটা ঘুরছে ঘুরুক
মানুষ উড়ুক চাঁদে,
ফাটায় বোমা সাগর তলায়
পড়ছে পড়ুক ফাঁদে।
তোর তাতে কি? খড়বিচুলি
পেলেই পোয়াবারো।
জাবর কেটে দিন চলে যায়,
পশম বাড়ুক আরও।
জগৎ জোড়া দেখিস ঐ
সবুজ চিকন ঘাসের দেশ।
মেষরে মেষ তুই আছিস বেশ!
যখন রবীন্দ্রনাথ
যখন রবীন্দ্রনাথ কালো ঘোড়াটাকে সিন্ধুপারে
দেখলেন, সম্মুখ শান্তির পারাবার
অবগাহনের তৃষ্ণা নিয়ে চোখে দৃশ্য-মোছা-ঝড়ে
দিলেন প্রশান্ত দৃষ্টি মেলে চরাচরে,
মৃত্যুর অতীত সৃষ্টিলীলা, শান্তিলেপা কত ছবি
শব্দের ছন্দের জাদু, মায়াবনবিহারিণী হরিণী এবং
ছায়া সুনিবিড় গ্রাম, মাছের কানকা ভরা গলি, ঋতুরং-
যেদিন গেলেন তিনি, ভুললেন সবি।
হামেদ জালাল, সেই পৌঢ়, জ্যোৎস্না রাতে
যিনি গ্রান্ড ক্যানালের গন্ডোলায় ভেসে
আপেলের মতো ছাড়িয়ে সত্যের খোসা, স্মিত হেসে
বুদ্ধের মূর্তির নিচে, যিনি বাদামি চুলের বান্ধবীর সাথে
কাঁকড়ার ঝোল কিংবা অয়েস্টার চোখে,
মাতাডোর আর ষাঁড়ের লড়াই দেখে
মিটিয়ে চোখের তৃষ্ণা ঘাসের ঘাগরার নাচে, শেষে
একদিন সাফল্যের তরী বেয়ে সুদূরে আবেশে
স্বদেশের ঘাটে ভিড়লেন,
যিনি শালিকের দিকে চেয়ে ‘আগে এখানে নামিনি?
তিনিও ধুলোয় মিশে ভুললেন কাঞ্চন-কামিনী,
ত্বকের নিবিড় লেনদেন।
সুফিয়া খাতুন যার ঘন কেশদামে
ছিল দীপ্ত যৌবনের স্বর্ণভস্ম, যাকে নীল খামে
স্বামী ছাড়া আরো ক’জন উদ্ভ্রান্ত যুবা নানা ছলে
পাঠিয়েছে পত্র-লোকে বলে,
তিনিও কবরে শুয়ে ভোলেন নিপুণ কামকলা।
কর্মঘর্ম গাঁথা ব্যস্ত রাস্তায় গলিতে যারা গলাবাজি
করে, দাঁতে দাঁত ঘষে,
সহানুভূতির মতো সবুজ সবজির প্রয়োজনে দর কষে,
রুটির মতোই জীবনকে ধ্রুব জানে
জমায় বিভ্রান্ত ভিড় শুঁড়ির দোকানে,
সোনার ষাঁড়ের লেজ ধরার আশায় দিনরাত
ঘোরে দিগ্ধিদিক, বিকেলের মিহি রোদে
নেতার বক্তৃতা শুনে দেয় করতালি, অকস্মাৎ
মুখ ঢেকে কেঁদে ওঠে বেনামি দুর্জ্ঞেয় কোনো বোধে
তারা যাবে, ভুলবে বাজার দর আর
সোমবার কিবা রবিবার।
যদি ইচ্ছে হয়
যদি ইচ্ছে হয় যেতে পারি আদিম অরণ্যে
যেখানে অন্ধকারে মূল্যবান রত্নের মতো জ্বলে
পাশব চোখ, ভালুকের কশ বেয়ে
গড়িয়ে পড়ে টাটকা মধুর ধারা।
কিন্তু আমি যাইনে সেখানে, থাকি শহরে, আমার শহরে।
ঊর্ধ্বশ্বাস ট্রাফিকের ব্যস্ততায় বিজ্ঞাপনের মতো
ঝলমলিয়ে ওঠা হাসি
শিরায় আনে আশ্চর্য শিহরণ
মনে হয় যেন ঢক করে গিলে ফেলেছি
এক ঢোঁক ঝাঁঝালো মদ। আর প্রহরে প্রহরে
অজস্র ধাতব শব্দ বাজে আমার রক্তে,
যেন ভ্রমরের গুঞ্জন।
আমার ছোট খুপরিতে ভোর আসে
ব্যালেরিনার মতো নিপুণ বিন্যাসে, আমি
মৃত কবিদের প্রাণবন্ত অক্ষরে ডুবে থাকি-
বেলা গড়িয়ে অবেলায় এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে।
রাতে খড়খড়িটা খুলে দেখি
বুড়ো রাজমিস্ত্রির চোখের মতো ছানি-পড়া আকাশে
জ্যামিতিক চাঁদ শোনে তারার কথকতা, সেই মুহূর্তে
রহমত ব্যাপারীর রক্ষিতা হয়তো তার ক্লান্ত যৌবনটাকে
কুঁচকে যাওয়া পোসাকের মতো
এলিয়ে দিয়েছে রাত্রির আলনায়।
কখনো দেখি, রাত্রির ফুটপাতের ধারে এসে জমে
সারি সারি উজ্জ্বল মসৃণ মোটর,
যেমন গাঢ়-সবুজ ডালে ভিড় করে
পাখির ঝাঁক সহজ অভ্যাসে।