পার্কের নিঃসঙ্গ খঞ্জ
পার্কের নিঃসঙ্গ খঞ্জ চেয়েছে চাঁদের কাছে বুঝি
একটি অদ্ভুত স্বপ্ন তাই রাত্রি তাকে
দিল উপহার
বিষাদের বিস্রস্ত তনিমা
যেন সে দুর্মর কাপালিক
চন্দ্রমার করোটিতে আকণ্ঠ করবে পান সুতীব্র মদিরা
পৃথিবীতে সম্পন্ন গাছের পাতা ঝরে
হরিণের কানের মতন পাতা ঝরে ধ্বনি ঝরে
উজ্জ্বল মাছের
রুপালি আঁশের মতো ধ্বনি ঝরে ঝরে ধ্বনি
ঝরে পৃথিবীতে
সে ধ্বনির আকাঙ্ক্ষায় জ্ব’লে ততদিন সে-ও
থাকবে পথের প্রান্তে প্রতীক্ষার ঘাটে
যতদিন সহজে ভাসানো চলে সোনার কলস
রৌদ্রের দস্যুতা জেনে বৃষ্টির আঁচড়ে
মুহ্যমান দুঃখের দর্পণে দেখে মুখ
বাসি রুটি
চিবোয় অভ্যাসবশে জ্যোৎস্নাজ্বলা দাঁতে
আর স্মৃতিগুলি একপাল কুকুরের মতো
খিঁচিয়ে ধারালো দাঁত মনের পিছনে করে তাড়া
ভাবে
একতাল শূন্যতায় ভাবে
বেহেস্তের ছবি যায় কশাই চামার
ছুতোর কামার আর
মুটে মজুরের ঘরে আর দরবেশের গুহায়
বাদশার হারেমে সুন্দরী বাঁদী যদি
বিলাসের কামনার খাদ্য হয় সোহাগ জোগায়
বিলোল অধরে
গড়ায় ক’ফোঁটা পানি ক্ষুধিত পাষাণে
অথবা নুলোর বউ কাঁদে ভাদ্রের দুপুরে
তবে যে লোকটা হেঁটে যায়
বিকেলের মোলায়েম রোদে
তার কীবা এসে যায়
অন্যের দুঃখের নদী বয়ে যেতে দেখে
আমরা সবাই কম বেশি
স্বস্তির হাওয়ায় ভাসি নিজের ফাঁড়ার কথা ভেবে
একচ্ছত্র ক্ষুধার সাম্রাজ্যে ঘুরে ঘুরে
ধুলো ঘেঁটে ছাই ছেনে হৈ হৈ ছেলেদের
দৌরাত্ম্যে অস্থির
ফিরে আসে পার্কে এই নিরানন্দ বাদামের খোসা
ভবঘুরে কাগজের অভ্যস্ত জগতে
যেখানে অনামি
বাউণ্ডুলে ময়লা ভিখিরি আর লম্পট জোচ্চোর
গণ্ডমূর্খ আর ভণ্ড ফকির অথবা
অর্ধনগ্ন ভস্মমাখা উন্মাদিনী বেহেড মাতাল
এসে জোটে সন্ধ্যার আড়ালে
যখন কোথাও
রজনীগন্ধার ডালে কাগজের মতো চাঁদ বোনে
স্বপ্নের রুপালি পাড়
অর্ধদগ্ধ বিড়িটাকে শুকনো ঠোঁটে চেপে
তাকায় রাস্তার ধারে চাঁদহীন মাঠে
অদ্ভুত বিকৃত মুখে যেন
পৃথিবীর কোনো সত্যে সৌন্দর্যে কল্যাণে
আস্থা নেই তার যেন একটি কর্কশ পাখি
আত্মাকে ঠুকরে বলে তোমার বাগান নেই বলে
রক্তিম গোলাপ আসবে না
বিকলাঙ্গ স্বপ্নের অলিন্দে কোনো দিন
জানে তার নেই ঠাঁই সুন্দরের কোলে
নুলোর বউটা তবে তাকে
থাক থাক
এসব কথার বুজরুকি
কখনো সাজে কি তার চালচুলো নেই যার এই
দুনিয়ার ঘরে
রোঁয়াওঠা কুকুরের সাহচর্য্যে গ্রীষ্মের গোধূলি
হয়তো লাগবে ভালো রাত্রি এলে চাঁদ
হয়তো অদ্ভুত স্বপ্ন দেবে তার সত্তার মাটিতে
বিষাদের ঘরে
কেউ জাগাবে না তাকে
পার্কের নিঃসঙ্গ খঞ্জটাকে
পিতার প্রতিকৃতি
‘কখনো নদীর স্রোতে মৃত গাধা
ভেসে যেতে দেখেছি সন্ধ্যায়,
দেখেছি একদা যারা হৈচৈ করে যুদ্ধে
গেছে তাদের ক’জন
মহৎ স্বপ্নের শব কাঁধে নিয়ে হেঁটে-হেঁটে
ক্লান্ত হয়ে ফের
স্বগৃহে এসেছে ফিরে। গোবিন্দলালের পিস্তলের
ধোঁয়ায় রোহিনী আর একটি যুগের অস্তরাগ
মিশে যেতে দেখেছি আমরা’-বলে
পিতা থামলেন কিছুক্ষণ।
তিনি ভোরে খাচ্ছিলেন রুটি আর স্মৃতির তিতির
পুরানো চেয়ারে ব’সে। রোদ্দুরের অরেঞ্জ স্কোয়াশে
ভিজিয়ে প্রবীণ কণ্ঠ বল্লেন জনক
“আমি তো বেঁচেছি ঢের খেয়ে-দেয়ে
ভালো থেকে অশেষ কৃপায়
তাঁর, কত বছরের রৌদ্রজলে ক্ষ’য়ে গেছে
অস্তিত্বের ধার
আর কে না জানে প্রকৃত দীর্ঘায়ু যিনি
অনেক বিচ্ছেদ মৃত্যু তার মনে প্রেতের ছায়ার
মতো ঝুলে থাকে আজীবন। শৈশবের
অশেষ সন্ধান তাকে টেনে আনে জনশূন্যতার
নেউল-ধূসর তীর্থে, যেখানে কুয়োর জলে
সত্যের নিটোল মুখ দেখার আশায়
যেতে হয়-যেখানে দরোজা বন্ধ, বারান্দায়
পাখির কংকাল,
গোলাপের ছাই প’ড়ে আছে
একটি বাতিল জুতো বিকেলের রোদের আদরে
হেসে উঠে বলের মতন নেচে নেচে নিরিবিলি
ফুলের জগতে চলে যায়
এবং একটি ঘোড়া চমকিত বালকের আকাঙ্ক্ষার ঘ্রাণে
মত্ত হয়ে ছুটে যায় দলছাড়া মেঘের তল্লাশে,
সহসা খিঁচিয়ে মুখ ছিঁড়ে নেয় অস্তগামী
সূর্যটির মাংস একতাল।
বেঁচে আছি বহুদিন তবু পৃথিবীকে
এখনও রহস্যময় মনে হয়… আর শোনো
ভাবতে পারি না
কোনো দিন থাকব না এখানে, চেয়ারে ব’সে
ঝিমাব না
ভোরের রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে কোনো দিন।
‘তখন থাকবে তুমি আমার সন্তান
-দীর্ঘজীবী হও তুমি,
তোমার কর্মঠ আঙুলের উষ্ণ রক্তে ঘন ঘন
আমার অপূর্ণ ইচ্ছাগুলি
এক ঝাঁক হাসের মতোই জানি
নিপুণ সাঁতার কেটে তোমাকে জোগাবে স্বপ্ন অনিদ্রার রাতে-‘
-বলে তিনি মুগ্ধ চোখে ফেরালেন মুখ
অতীতের দিকে,
তখন রাসেল রিলকে বুদ্ধ পিকাসোর
নাম জানেন না ভেবে
পারিনি করুণা করতে বয়েসী পিতাকে।
পুরাকালে
পুরাকালিএ কে এক বণিক তার সবচেয়ে দামি
মুক্তোটিকে বাগানের মাটির গভীরে
রেখেছিল লুকিয়ে যেখানে
সূর্যের তিমির-দীর্ণ আলো
পৌঁছেনি কখনো,
হৈমন্তী গাছের পাতা ঝরেনি যেখানে।
তোমাকে পাওয়ার ইচ্ছা সেই
মুক্তোর মতোই জ্বলে আমার ভেতর রাত্রিদিন
আর আমি ভাবি এই সৌন্দর্যকে লালন করার
আশ্চর্য সাহস
কে দিল আমাকে?
মাথায় ভাবনা নিয়ে
মাথায় ভাবনা নিয়ে খুপরিতে আছি শুয়ে এই
নিজের আঁধারে লগ্ন, দেখি
ময়লা দেয়ালে আঁকা দুঃখের নিভৃত ফুল আর
মনকে প্রবোধ দিই রাত্রিদিন দুর্দশার ঢাক
বাজিয়ে কী লাভ?
প্রাণধারণের কত অমাবস্যা, কত না পূর্ণিমা,
বৈশাখের দীপ্ত দিন, শ্রাবণের সন্ধ্যা সুনিবিড়-
জীবনের এই রূপান্তর, আবর্তিত ইতিহাস,
ব্যক্তি-সমাজের চেতনায়
সোনার রোদ্দুর দিয়ে বোনে
প্রত্যহ স্বপ্নের পাড় বিমুগ্ধ খেলায়।
আত্মদান স্মৃতি আর সম্প্রীতির নিবিড় পূর্ণিমা
মানুষে মানুষে পড়ে আশ্চর্য সংলাপ
জীবনের মতো ব্যাপ্ত একটি সিম্ফনি
ঝরায় ঝরনার পানি
ফোটায় বাগানের ফুল স্বপ্নে জাগরণে।
দ্যাখো এই ঘরে জ্যোতির্ময় হতে পারে আজও,
আবার আমার আত্মা নতুন জন্মের প্রতিভায়
হতে পারে নিবিড় বাগান
তোমার দৃষ্টির তারাময় প্রস্রবণে।
যখন নিরুদ্ধ হতাশায় জীবনকে মনে হয়
একমুঠো বালি আর আকাশের চাঁদ
প্রতিভাত হয়
ভিক্ষুকের ভাঙা পাত্র বলে,
তোমার স্বপ্নের দীপ জ্ব’লে ওঠে নরকে আমার-
বুভুক্ষায় ঝরে
চকিতে স্বর্গের কান্তিবিগলিত দ্রাক্ষার মদিরা।