দুঃখ
আমাদের বারান্দায় ঘরের চৌকাঠে
কড়িকাঠে চেয়ারে টেবিলে আর খাটে
দুঃখ তার লেখে নাম। ছাদের কার্নিশ, খড়খড়ি
ফ্রেমের বার্নিশ আর মেঝের ধুলোয়
দুঃখ তার আঁকে চকখড়ি
এবং বুলোয়
তুলি বাঁশি-বাজা আমাদের এই নাটে।
আমাদের একরত্তি উঠোনের কোণে
উড়ে-আসা চৈত্রের পাতায়
পাণ্ডুলিপি বই ছেঁড়া মলিন খাতায়
গ্রীষ্মের দুপুরে ঢক্ঢক্
জল-খাওয়া কুঁজোয় গেলাশে, শীত-ঠকঠক
রাত্রির নরম লেপে দুঃখ তার বোনে
নাম
অবিরাম।
পিরিচ চামচ আর চায়ের বাটিতে
রোদ্দুরের উল্কি-আঁকা উঠোনের আপন মাটিতে
দুঃখ তার লেখে নাম।
চৌকি, পিঁড়ি শতরঞ্জি চাদর মশারি
পাঞ্জাবি তোয়ালে লাল কস্তাপেড়ে শাড়ি
প্রখর কম্বল আর কাঁথায় বালিশে
ঝাপসা তেলের শিশি টুথব্রাশ বাতের মালিশে
দুঃখ তার লেখে নাম।
খুকির পুতুলরানী এবং খোকার পোষমানা
পাখিটার ডানা
মুখ-বুজে-থাকা
সহধর্মিণীর সাদা শাড়ির আঁচলে দুঃখ তার
ওড়ায় পতাকা।
পায়ে-পায়ে-ঘোরা পুষি-বেড়ালের মসৃণ শরীরে
ছাগলের খুঁটি আর স্বপ্নের জোনাকিদের ভিড়ে
বৃষ্টি-ভেজা নিবন্ত উনুনে আর পুরানো বাড়ির
রাত্রিমাখা গন্ধে আর উপোসী হাঁড়ির
শূন্যতায় দুঃখ তার লেখে নাম।
হৃদয়ে-লতিয়ে-ওঠা একটি নিভৃততম গানে
সুখের নিদ্রায় কিবা জাগরণে, স্বপ্নের বাগানে,
অধরের অধীর চুম্বনে সান্নিধ্যের মধ্যদিনে
আমার নৈঃশব্দ আর মুখর আলাপে
স্বাস্থ্যের কৌলিন্যে ক্রূর যন্ত্রণার অসুস্থ প্রলাপে,
বিশ্বস্ত মাধুর্যে আর রুক্ষতার সুতীক্ষ্ম সঙ্গিনে
দুর্বিনীত ইচ্ছার ডানায়
আসক্তির কানায় কানায়
বৈরাগ্যের গৈরিক কৌপীনে
দুঃখ তার লেখে নাম।
রৌদ্রঝলকিত ভাঙা স্তিমিত আয়নায়
নববর্ষে খুকির বায়নায়
আমার রোদ্দুর আর আমার ছায়ায়
দুঃখ তার লেখে নাম।
অবেলায় পাতে-দেয়া ঠাণ্ডা ভাতে
বাল্যশিক্ষা ব্যাকরণ এবং আদর্শ ধারাপাতে
ফুলদানি, বিকৃত স্লেটের শান্ত মেঘলা ললাটে
আর আদিরসাত্মক বইয়ের মলাটে
চুলের বুরুশে চিরুনির নম্র দাঁতে
দুঃখ তার লেখে নাম।
কপালের টিপে,
শয্যার প্রবাল দ্বীপে,
জুতোর গুহায় আর দুধের বাটির সরোবরে
বাসনার মণিকণ্ঠ পাখিডাকা চরে
দুঃখ তার লেখে নাম।
বুকের পাঁজর ফুসফুস আমার পাকস্থলিতে
প্লীহায় যকৃতে আর অন্ত্রের গলিতে
দুঃখ তার লেখে নাম।
আমার হৃৎপিণ্ডে শুনি দ্রিমিকি দ্রিমিকি দ্রাক্ দ্রাক্
দুঃখ শুধু বাজায় নিপুণ তার ঢাক।
ঐ জীমরতিভরা পিতামহ ঘড়ির কাঁটায়
বার্ধক্য-ঠেকানো ছড়ি, পানের বাটায়
গোটানো আস্তিনে দুমড়ানো পাৎলুনে
কাগজের নৌকা আর রঙিন বেলুনে
দুঃখ তার লেখে নাম।
কখনো না-দেখা নীল দূর আকাশের
মিহি বাতাসের
সুন্দর পাখির মতো আমার আশায়
হৃদয়ের নিভৃত ভাষায়
দুঃখ তার লেখে নাম।
দুপুরে মাউথ অর্গান
উন্মত্ত বালক তার মাউথ অর্গানে দুপুরকে
চমকে দিয়ে সন্দেহপ্রবণ কিছু মানুষ ব্যতীত
দালান পুলিশ গাড়ি চকিত কুকুর অ্যাসফল্ট
রেস্তোরাঁকে বানাল দর্শক। ট্রাফিক সিগন্যালের
সবুজ বাতিটা ফের নতুন আশার মতো ঝল-
মল জ্বলে, কয়েকটি সম্ভ্রান্ত মোটর পাশাপাশি
হঠাৎ হরিণ হতে চেয়ে থমকে দাঁড়িয়েছে বুঝি
রোদচেরা সমুরের গমকে।
এভেন্যুর ফুটপাতে
উন্মত্ত বালক নেই, মাউথ অর্গান নাচে শুধু
দূরে-কাছে বাতাসের ঝঙ্কৃত সঙ্গতে। দুপুরের
রৌদ্রের বর্ষায় লোকগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে ঠায়
প্রত্যেকটি মানুষকে মনে হল স্বপ্নে-ভেসে-ওঠা
দ্বীপের মতন, লুপ্ত স্মৃতির সন্ধানে চমকিত;
সুরের হীরকদ্যুতি ঝলসিত বুকের শ্লেষ্মায়
মগজের কোষে। ফুটাতে শুয়ে-শুয়ে সিংহ মুখো
কুষ্ঠরোগী আকাশে দু’চোখ রাখে, স্বপ্ন দ্যাখে, দ্যাখে
রঙিন পাখির কত নরম শরীর ভেসে যায়,
বাতাসে ছড়ায় রঙ। কখনো ভাবে না তারা কবে
ট্রেনের চাকার তলে কে রাখল দুঃস্বপ্ন-মথিত
মাথা তার, জানে শুধু অফুরন্ত ওড়ার আকাশ
বালকের অর্গানের সুরে ঝরে ত্রিতল দালানে,
রঙমাখা ক্লান্ত ঠোঁটে, নিঃশেষিত ফলের ঝুড়িতে
পথে বিট পুলিশের পোশাকের নিষ্প্রাণ শাদায়
মোটরের মসৃণ শরীর আর ব্যাংকের দেয়ালে
ফুটপাতে পরিত্যক্ত বাদামের উচ্ছিষ্ট খোসায়
পকেটমারের ক্ষিপ্র নিপুণ আঙুলে, তিনজন
গুণ্ডার টেড়িতে শুকনো-মুখ ফেরিঅলার গলায়।
কুষ্ঠরোগী দ্যাখে তারও ক্ষতের পিছল রসে ঝরে
মত্ত বালকের অর্গানের সুর ভাবে এই সুর
পারে না গড়তে তার গলিত শরীরে ভাঁজে ভাঁজে
আবার নতুন মাংস শিল্পের অলীক রসায়নে?
হতে কি পারে না তার বিনষ্ট শরীর ওই দূর
আকাশের পাখিদের মতো ফের সহজ সুন্দর?
নরমুণ্ডের নৃত্যে
স্ফটিক পাত্রে রুপালি পানীয়
কাঁপছে তরল জ্যোৎস্নার মতো,
অঞ্জলি ভরা ফুলের পরাগ
অঙ্গার হলো চোখ ফেরাতেই।
পিপাসায় জ্বলি এবং আমিও
চরম ক্ষতির বোঝা টেনে চলি।
জ্ঞানের গরিমা উঁচু মিনারের
চূড়ো না ছুঁতেই হারিয়েছে খেই;
সকালসন্ধে দর্শন খুঁড়ে
এনেছি চকিত চতুর মুষিক।
তুমি যা-ই বলো চরাচরে আজও
অলীক ঘটনা ঘটছে সদ্য।
জ্ঞানীণ্ডণীদের নাকের তলায়
অহরত কত খেল চমকায়
কে তার ভাষ্য দেবে নির্ভুল?
ত্রিলোকে তেমন মল্লিনাথের,
ঈশ্বর জানে, দেখা মেলা ভার।
কালো মহাদেশ অনিশ্চিতের
নাগরদোলায় ঘুরছে সদাই
এবং অযুত তারার মুলুকে
মহাশূন্যের সেনা দেয় হানা।
ভালুকের কড়া দাপটে ঈগল
ক্ষুব্ধ চিত্তে ঝাপটায় ডানা;
সমানে-সমানে কোলাকুলি তাই
বিমূঢ় সিংহ খাচ্ছে বিষম।
শীর্ষ মেলাটি বুদ্বুদ যেন
এক লহমার ফুৎকারে ফাটে;
থাকবে বজায় ঠাণ্ডা লড়াই।
সিংহমশাই ছয় মোড়লের
হাটে যেতে চান, কিন্তু সহসা
পথ আগলায় শক্রপক্ষ।
দিনকাল বড় বেয়াড়া এখন-
এমনকি তার শুকনো হাড়ের,
হায়রে কপাল, আশ্বাস নেই।
গাত্র বাঁচিয়ে পুণ্যবানেরা
পথ চলে বটে দৈনন্দিন,
কিন্তু তাঁদের শান্ত সকাল,
অলস দুপুর অমাবস্যার
কুটিল আঁধারে হচ্ছে বিলীন।
হাবেভাবে তাঁরা এত সমাহিত,
ঈশ্বর যেন বন-ভোজনের
ঠাণ্ডা আমেজে মগ্ন এখন।
নরমুণ্ডের ভয়াল নৃত্যে
চলছে যখন স্বপ্ন হনন,
দুঃস্বপ্নের ঊর্ণাজালেই
দার্শনিকের প্রবীণ কণ্ঠে
মানবতা আনে অযুত যুগের
সূর্যোদয়ের প্রেমঘন ভাষা।