চেনা অচেনার সঙ্গত
The stars rang like silver coins in my hand.
RIMBAUD
সবাই দেখল তাকে বিস্ময়ের উন্মুখ চৌকাঠে,
দাঁড়িয়ে দেখল তার শীর্ণ হাতে একমুঠো তারা,
খেলছে সে-যেন কতগুলো ঝকঝকে টাকা
নেড়েচেড়ে দেখছে তন্ময় হয়ে মুগ্ধতার ঘুলঘুলি দিয়ে।
নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে তারা দশজন
দেখল সে শুয়ে-শুয়ে বৃষ্টির ঝাঁঝালো মদে ডুবে
খুঁজছে সোমত্ত নৌকো তার ভেজা ঠোঁটে কিনারে
চুমো খাবে বলে। তারা শুধু পরস্পর
পিটপিটে চোখ টিপে দেখল কানের জানালায়
নির্ভার অস্তিত্ব এক বসেছে নিঃশব্দে। পৃথিবীর
সমস্ত স্তব্ধতা যেন শরীরে রেখেছে ঘিরে সেই আগন্তুক।
সবাই বলল তাকে, পাখিটাকে-শুয়োরের তাজা
টকটকে মাংসের পিণ্ডের মতো সন্ধ্যার সাক্ষাতে-
সবাই বলল তাকে সমবেত কণ্ঠের ক্রেঙ্কারে
‘গাও পাখি গান গাও, এ প্রহর গানের প্রহর।
নিষ্কম্প স্তব্ধতা দেখে তারা ফের দ্বিগুণ বিক্রমে
করল গানের ফরমাশ। নৈঃশব্দের দরবারে
তবুও হল না উন্মীলিত ফুলের পাপড়ির মতো কোমল গান্ধার।
চুরুট রঙের কোট ছুড়ে ফেলে, ফটোগ্রাফারের
কালো কাপড়ের মতো পর্দা টেনে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে
এক পশলা তারা সে-লোকটা (সবাই দেখল যাকে)
তাকাল পাখির ছোট দুটি সোনালি চোখের দিকে।
হাতের মুঠোয় তারা চকিতে উঠল বেজে রুপালি মুদ্রার
ঝনঝনে শব্দের মতো, পাখির চোখের দুটি তারা
ঝরাল আলোর দ্যুতি লোকটার কম্পিত মুঠোয়।
ছুঁচোর কেত্তন
যদি মুখ খুলি কী বলব? বলার কিছুই নেই?
বলব কি দ্যাখো কৃষ্ণচূড়া রমনার শান্ত গাল
দিয়েছে রাঙিয়ে, বলব কি আর দশজন মরে মরুকগে,
আমার সকালে চাই রোজ দুটি আধাসেদ্ধ ডিম,
রুটি-মাখনের সঙ্গে-জ্যাম না-ই হোক, ক্ষতি নেই
অথবা মলির ছোট মেয়েটার (কী-যে তার নাম
ক’দিন হয়েছে হাম), যে-লেখক এবার পেলেন
আদমজী পুরস্কার তিনি প্রত্যহ মাজেন দাঁত
কলিনস্ দিয়ে, কী করে বিকোয় সবজি
বাজারে ইত্যাদি টুকিটাকি বলব কি
ছাদহীন ঘরে দিন কে চায় কাটাতে আজীবন,
সোনার খাঁচায় রইল না দিনগুলি।
আদিতে কিছুই নেই, অন্তে নেই কিছু;
মধ্যে শুধু এই থাকা না-থাকার জ্যোৎস্না চমকিত
ঊর্ণাজাল।
গ্রীষ্মের দুপুরে
রাস্তার বিবর্ণ কোণে ঘোড়ার খুরের শব্দ সত্য,
সত্য এই জানালার কাচে কালো বৃষ্টির আঁচড়,
পাতার কঙ্কাল আর ব্রিজের ওপর ঝকঝক
রাত্রির চলন্ত ট্রেন, দাড়ি না-কামানো
মুখের মতন দিন সত্য-সত্য সবি।
কিন্তু তবু কী সম্পর্ক পূর্ণিমা চাঁদের সঙ্গে এই
খেঁকি কুকুরের? অথবা রজনীগন্ধা আর দূর
চিমনির ধোঁয়া অবিশ্বাস্য কী গ্রন্থিতে আছে বাঁধা?
সম্বন্ধের কোন প্রসারিত পরিধিতে
মগ্ন পরস্পর হাতের চকিত মুদ্রা জনাকীর্ণ
এভেন্যুর ফোয়ারার বিচূর্ণিত জল!
একটি প্রখর পাখি ঠুক্রে ফেলে দেয় অবরিত
পোকা-খাওয়া মূল্যবোধ। আমরা যে-যার মতো পথ চলি,
দেখি বুড়ো লোকটা পার্কের বেঞ্চে ব’সে হাঁপিয়ে, ফুঁপিয়ে
অভিশাপ ছুড়ে দেয়, গাল পাড়ে ভিখিরিকে আর
উল্কি-পরা সরু গলি চমকায় নগ্ন ইশারায়,
বেকার যুবক দৃষ্টি দ্যায় সিনেমার প্ল্যাকার্ডের
রঙচঙে ঠোঁটে, মুখে বুকে আর মদির ঊরুতে।
পৃথিবীটা চলছে, চলবে যতদিন সূর্য তার
ছিটোবে সোনালি থুতু, কিন্তু যদি
ততই নিশ্চিত এই পৃথিবীর ভবিষ্যৎ তবে
কেন সে নব্বুই বছরের বুড়ো কনকনে হাওয়ায় ভাসিয়ে ধবধবে
সাদা চুল এক হাঁটু তুষারের মধ্যে দাঁড়িয়ে শোনায় কতো
শান্তি ললিত বাণী একই কেন্দ্রে ঘুরপাক-খাওয়া
অগণিত মানুষের হাটে!
যদি মুখ আদপেই খুলি বলব কি এপ্রিলের
উত্তপ্ত হাওয়ায় ঘেমে মেঘে রোজ হচ্ছি নাজেহাল,
ব্লাউজ পিস্টা চমৎকার…তোমাকে মানাবে ভালো
পরো যদি খয়েরি শাড়ির সঙ্গে অথবা হানিফ
করেছে সেঞ্চুরি ফের, দালাই লামার আত্মজীবনীতে কত
ঘটনার সমাহার; বলব কি চলো যাই কফি খাই
হাল ফ্যাশনের কিছু বই পড়া চাই
নইলে লাফাবে তুমি এঁদো ডোবা, কুয়োর ভেতরে।
বলব কি টাইয়ের নিখুঁত নট শিখলোনা বাঁধতে বেচারা
আজ অব্দি, বলব কি তিনটি সরলরেখা মিলেই ত্রিভুজ…
ঘরে বসে ছুঁচোর কেত্তনে আজ মেটাব কি সাধ,
বলব কি…
ডায়েরির একটি পাতা
সকালের রোদে এই সাতই আশ্বিনে
আরো একটি দিন এলো জানাতে সাদর
সম্ভাষণ। বিছানায় শুয়ে-শুয়ে চাদরে পা ঘষি,
অন্যমনে আঙুল চালিয়ে দিই চুলে
কোথাও উজ্জ্বল মোটরের হর্ন বেজে ওঠে (শুনি)
চেনা শব্দ হরেক রকম। টিক টিক ঘরি বাজে, ঠিক ঠিক
টিকটিকি সাড়া দেয় সহযোগী তন্ময় নিষ্ঠায়।
বাথরুমে গড়ায় কলের পানি, বারান্দায় দেখি
হাওয়ায় টবের ফুলে সে কী গলাগলি।
আলোলাগা ভালোলাগা বেলা
খেলা করে সত্তার প্রাঙ্গণে
-বেঁচে আছি।
আলনায় ঝোলানো আমার
ইজের কামিজ সাদা দেয়ালের ফুল,
টেবিলে পুরানো ছবি, শুকনো ফল, দাড়ি কামাবার
সরঞ্জাম, অসমাপ্ত কবিতার পাণ্ডুলিপি, বই
সবকিছু ঝলমলিয়ে ওঠে
আশ্বিনের রোদ্দুরে এবং
মনে হয় থাকব এখানে চিরদিন।
যখন পাশের ঘর থেকে ভেসে আসে
রুটি মাখনের ঘ্রাণ, সোনালি চায়ের
সুগন্ধ, চূড়ির শব্দ, দরজায় আড়ালে তোমার
কণ্ঠস্বর ছোঁয় প্রাণ, ভাবি কী সুন্দর
এই বেঁচে থাকা…
তিনটি বালক
রুটির দোকান ঘেঁষে তিনটি বালক সন্তর্পণে
দাঁড়ালো শীতের ভোরে, জড়োসড়ো। তিন জোড়া চোখ
বাদামি রুটির দীপ্তি নিল মেখে গোপন ঈর্ষায়।
রুটিকে মায়ের স্তন ভেবে তারা, তিনটি বালক
তৃষিত, আত্মাকে সঁপে সংযত লোভের দোলনায়,
অধিক ঘনিষ্ঠ হ’ল তন্দুরের তাপের আশায়।
কিন্তু তারা কর্মঠ থাবার তাড়া খেয়ে, তাড়াতাড়ি
ফিরে গেল হিমেল বাতাসে খুঁজে নিতে অন্য কোনো
বুভুক্ষার পরিমেল। যে বুড়ো লোকটা আধপোড়া সিগারেট
তন্ময় নিষ্ঠায় রাস্তা থেকে তুলে নেয়, তার কাছে
তিনটি বালক যেন নরক পালক, সহযাত্রী
দুঃখের ভ্রমর-ডিসেম্বরে ফুটপাতে
কুঁকড়ে থেকে এক কোণে হাড়ে হাড়ে টের পায় যারা
হিমেল হাওয়ার ধার শরীরের মাংস যেন খ’সে প’ড়ে যাবে
ইতস্তত পচা কমলালেবুর মতো নামমাত্র স্পর্শে, আর
ফুটোভরা কাঁথার তলায় শুয়ে তারাময় খোলা
আকাশের নিচে কোনো দিন
হয়তো অলক্ষ্যে হয় স্বর্গের শিকার।
মাঝে-মাঝে স্বপ্ন দেখে ম্লান কুয়াশায়
এক ঝাঁক ঘুঘু নামে পূর্বপুরুষের
সম্পন্ন ভিটায়।