ক্ষয়
পুবের আকাশে প্রতিদিন একই
সূর্য সকালে আবির মাখে।
কীর্তিনাশার প্রমত্তা রূপ
আজও খেলে যায় চরের বাঁকে।
আমি শুধু আমি বদলে যাচ্ছি,
মানে মোট কথা হচ্ছি বুড়ো।
গতকল্যের কিছু নেই বাকি,
বিগত যুগের স্বপ্ন গুঁড়ো।
দেয়ালের এই পিকাসো মাতিস
চির অক্ষয় থাকবে বটে;
অথচ আমার দেহের চিত্রে
কত কী-যে শুধু নিত্য ঘটে।
চোখ ফেরালেই বছর ফুরায়,
কমে ক্রমাগত দেহের তাপ।
চোখের তলায় ত্বকে অঙ্কিত
কাকের পায়ের শীর্ণ ছাপ।
খুপরির গান
ধুলো গিলে ভিড় ছেনে উকুনের উৎপাত উজিয়ে
ক্লান্তি ঠেলে রাত্তিরে ঘুমোতে যাই মাথাব্যথা নিয়ে।
না-জ্বেলে ক্ষয়িষ্ণু মোমবাতি স্বপ্নচারী বিছানায়
গড়াই, লড়াই করি ভাবনার শক্রদের সাথে-
হাত নাড়ি লাথি ছুড়ি পৃথিবীর গোলগালা মুখ
লক্ষ্য করে। বিবেকের পিঁপড়ে যদি সত্যি হেঁটে যায়
পিচ্ছিল দেয়ালে, মন থেকে মুছে নেব ছোটখাটো
পাপবোধ অল্পবিস্তরেণ…পোষমানা মূল্যায়নে
পাব সুখ দেখব কি নেড়েচেড়ে এক টুকরো হলদে
নিষ্প্রাণ কাগজে মোড়া আত্মা, সত্যি একরত্তি সেই
আধ্যাত্মিক পিণ্ড…আর পরাবিদ্যা ভাসাব জ্যোৎস্নায়?
দিনে কৃষ্ণচূড়া রাতে রজনীগন্ধার স্পর্শ যারা
পেতে চায় অন্তরঙ্গ সাহচর্যে, যদি বলে তারা
‘গুনে-গুনে রেজগি দিয়ে প্রতিদিন অভ্যাসবশত
ছুঁয়েছি লাভের বুড়ি, লোকসান বলে কাকে জানি না ইয়ার’
‘কী দেবে জবাব তবে অসংখ্য তারার ব্যালেরিনা,
ভ্যানগগ রক্তে তার কালো কাক ফসলের ক্ষেত
সূর্যমুখী এক জোড়া জীর্ণ বুটজুড়ো কেবলি মথিত করে
রোদে সূচ্যগ্রে বিদ্ধ হল শাশ্বতীর আকাঙ্ক্ষায়,
সহযাত্রী বন্ধু তার হলুদ যেসাস খোঁজে আরেক প্রান্তরে
নতজানু, ঊর্ধ্ববাহু, কণ্ঠে কালো বৃষ্টির আরক।
এ-পাড়ায় ১৭টি উজবুক ৫ জন বোবা
৭টি মাতাল আর ৩ জন কালা বেঁচেবর্তে
আছে আজও দুর্দশার নাকের তলায়। মাঝে-মাঝে
দুর্লভ আঙুর চেয়ে কেউ-কেউ তারা বলে থাকে
‘টক সব টক-তার চেয়ে তাড়ির ঝাঁঝালো ঢোঁক
ঢের ভালো, ভালো সেই গলির মোড়ে জ্বলজ্বলে
পানের দোকান আর বাইজির নাচের ঘুঙুর।
বমির নোংরায় ভাসে মেঝে, রুটির বাদামি টুকরো
চড়ুই পালাল নিয়ে। তাকাব না কখনো বাইরে…
ঘরে জানলা নেই…হলুদ যেসাস বিদ্ধ কড়িকাঠে…
রৌদ্রঝলসিত কাক ওড়ে মত্ত রক্তে কাঠফাটা
আত্মার প্রান্তরে। সারারাত
অনিদ্রা দুঃস্বপ্ন আর
ছারপোকা, ছিদ্রান্বেষী ইঁদুরের উৎপাত উজিয়ে
ময়লা চাদর ছেড়ে উঠি ফের মাথাব্যথা নিয়ে।
খেলনার দোকানের সামনে ভিখিরি
বড় রাস্তা, ঘুপচি গলি, ঘিঞ্জি বস্তি, ভদ্রপাড়া আর
ফলের বাজার ঘুরে খেলনার দোকানের সামনে
দাঁড়ালাম। কাচের আড়ালে দেখি কাঠের পুতুল,
রেলগাড়ি, ছক-কাটা বাড়ি, আরবি ঘোড়া এক জোড়া,
উড়ন্ত পাখির মতো এরোপ্লেন, টিনের সেপাই।
ভালুক বাজায় ব্যান্ড, বাঁকা-শিং হরিণের পাশে
বাঘের অঙ্গার জ্বলে, বিকট হা করে আছে সিংহ
সারি সারি রয়েছে সাজানো ওহো হরেক রকম
বাজনা বাঁশি বাদশা বেগম আর উজির নাজির।
আমার পিরান নেই, পাগড়ি নেই লালমুখো সেই
উজিরের ম’তো, নাগরা নেই পায়। এখন দুপুরে
লেপ্টে আছে পৃথিবীর গায়। কয়েকটি যুবককে
ধরে নিয়ে যাচ্ছে ওরা-লোকে বলে রাত্রিদিন তারা
নেহাই হাতুড়ি দিয়ে ইচ্ছেমতো চেয়েছে গড়তে
কত কিছু, দেশকে নতুন করে গড়ে পিটে নিতে
চেয়েছে হুজ্জত সব জ্বলন্ত জোয়ান। বুঝি তাই
ঢিট করে দেবে ওরা যৌবনের গোঁয়ার ইচ্ছাকে।
“গান বন্ধ কর্ তোরা, নর্তকী নাচের মুদ্রা ভোল”-
“এমন হুকুমনামা জারী হলে সংস্কৃতি সদনে
আমরা গোল্লায় যাব এবং দাঁতাল বর্বরতা
সদর্পে তুলবে মাথা প্রাগৈতিহাসিক কূপ থেকে”
হেঁটে যেতে যেতে বলব কয়েকটি সুবেশ যুবক।
ইচ্ছে হয় মুখ ঘষি খেলনার দোকানের কাচে
বড় ইচ্ছে হয় ঘষি দুটি চোখ। যে-বিড়িটা কানে
গুঁজে ভোরে বেরিয়ে পড়েছি পথে তাই টানি সুখে
এখানে দাঁড়িয়ে ঠায় দুপুরের ঠাঠা রোদে। যদি
ছুঁয়ে দেখি স্বচ্ছ কাচ সূর্যসেঁকা আত্মায় আরাম
পাবো কিছু মনে হয়; দেখি মেঘেরা পালায় দৌড়ে
যেমন ছেলের দল ছুটে যায় পাঠশালা ছুটি
হয়ে গেলে। এ দুপুরে নিজের ছায়াকে দেখে কাচে
ঘুরে-ফিরে কেন শুধু গাঁয়ের নদীকে মনে পড়ে?
গাঁয়ের নদীর তীরে একজন বাউল আমাকে
একদিন ‘এদেশে আলোর কথা ভুলে থাকে লোক;
বড় বেশি অন্ধকার ঘাঁটে আর নখের আঁচড়ে
গোলাপ-কলিজা ছেঁড়ে পরস্পর’-বলেছিল হেসে।
নৌকোর গলুইয়ে বসে বুঝিনি সেদিন তার কথা,
আমি শুধু মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিলাম তাকিয়ে
তার দুটি উদাস চোখের দিকে; শুনতে পেলাম
নদীর শব্দের সাথে মিশে গেছে বাউলের স্বর।
ডেপুটি হাকিম নই, নই কোনো ভবঘুরে কবি;
পথের গোলাম আমি, বুঝেছ হে, অলীক হুকুমে
চৈত্ররাতে ফুটপাতে শুই। ঠ্যাং দুটি একতারা
হয়ে বাজে তারাপুঞ্জে, মর্মরিত স্বপ্নের মহলে
বাউলের কথামৃত স্বপ্নে হয় আমের বউল।
‘দ্যাখো দ্যাখো হাড্ডিসার লোকটার মুখের কী ছিরি,
কেতমন বিচ্ছিরি লাগে, দ্যাখো কত নোংরা’ বলে দুটি
তরুণী কলের পুতুলের মতো হেঁটে গেল চলে।
উঁচু বুক দেখে ভাবি পেশোয়ারি উজ্জ্বল দোকানে
দূর থেকে দেখছি তাজ্জব হয়ে টসটসে ফল।
নিজেকে কুচ্ছিত ভেবে লজ্জা পেলে সদর রাস্তায়
আমাদের চলে? উপরে আকাশ জ্বলে নির্বিকার।
যে ভদ্দরলোক এ মুহূর্তে এক খিলি পান কিনে
পুরল শৌখিন মুখে সে অশ্লীল গল্পের নায়ক
হতে পারে সহজেই। হতে পারে বেশ্যার দালাল।
বেইমান দুনিয়ায় খুনসুটি, ভালবাসাবাসি
বুঝি না কিছুই-নাকি বিলকুল বুড় হাবড়া আমি
হয়ে গেছি এতদিনে। কী যে ভাবি এত হাবিজাবি!
আমার জীবন নয় সুখের পানসি ঢেউয়ে ঢেউয়ে
ভেসে যাবে অথবা নেইকো’ কোনো তালুক মুলুক
দু’হাতে ওড়াব ব’সে। পুণ্যলোভী দাতার দয়ায়
জীবনে সম্বল শুধু কয়েকটি তামার পয়সা।
গতকাল ফ্রকপরা যে-মেয়েটি একটি দু’আনি
হাসিমুখে দিয়েছিল এই হতচ্ছাড়া ভিখিরিকে,
কাচের আড়ালে রাখা ফুটফুটে পুতুলের মুখে
হঠাৎ পেলাম খুঁজে রাঙা তার মুখের আদল
-আমার মাবুদ তাকে খোশহাল বেগম করুন।
যে লোকটা সারাদিন পাখি বেচে গড়েছে সংসার,
হলুদ পাখির মতো যার বউ, সে কেন গলায়
পরে ফাঁস? সে লাশ পচার আগে মৃত এক পাখি
বউটিকে নিশীথে কাঁদাতে এসে দ্যাখে, হা কপাল,
আনন্দে উচ্ছল নারী হয়েছে উৎসব দ্বিধাহীন,
আয়নায় কাজল পরা দুটি চোখ ক্ষুধায় উজ্জ্বল।
‘দূর হ এখান থেকে হা-ভাতে ভিখিরি কোথাকার
আঁস্তাকুড়ে বেছেন আস্তানা, নোংরা খুঁটে খা-গে’-
দোকানি খেঁকিয়ে ওঠে। খেলনা ফেলনা নয় জানি,
এখন এখান থেকে, আল্লা, যাব কোন জাহান্নামে!
খেলনা ফেলনা নয়। ফলের বাজার, পুতুলের
স্থির চোখ…পীরের মাজার হৈচৈ মানুষের ভিড়,
গাঁয়ের নদীর তীর গুঞ্জরিত বাউলের স্বরে…
গেরস্তপাড়ায় বেশ্যাবৃত্তি, ভালুক বাজায় ব্যান্ড,
খেলনা ফেলনা নয়… বাজনা বাজে, ফলের বাজার,
ফ্রকপরা ফুটফুটে মেয়েটির একটি দু’আনি
হাতের চেটোয় নাচে, কাচের আড়ালে দুই যোদ্ধা,
সেপাই রাঙায় চোখ, ভদ্দপাড়ায় বাজনা বাজে,
“আস্তাকুড়ে বেছে নে আস্তানা’, খেলনা ফেলনা নয়…