একটি জীবনচরিত
যিনি ওই পোড়াবাড়িটায়
থাকতেন নিরিবিলি কোনো কোনো দিন
রোদে পিঠ দিয়ে আর শ্রাবণের ধারাজ্বলে ঠায়
সারাদিনমান সঙ্গীহীন
কাটাতেন গোলকচাঁপার নিচে, চোখ-ছলছল
তিনি ভাবতেন তার চুল
ঘাসের সবুজ শিখা, হাত অবিকল
মৃন্ময় গাছের ডাল, চোখ ফাল্গুনের কোনো ফুল,
ঠোঁটের কিনারে কালো শ্রাবণের মসৃণ লবণ
(ভাবতেন তিনি) আছে লেগে সারাক্ষণ।
কখনো কোটর থেকে কাঠবিড়ালিটা নেমে এলে
পাতাঝরা তন্ময় বিকেলে
দিতেন মাথাটা তার আদরে বুলিয়ে,
এবং ভুলিয়ে
রাখতেন ওকে ঘাসে বাদামের কৌতুকী খেলায়
গরুর খুরের রাঙা ধূলিওড়া নিমগ্ন বেলায়।
চুপচাপ সে অস্তিত্ব রোজনামচায় চিরন্তন
সুখে রাখতেন টুকে অভ্রের গুঁড়োর মতো মৌমাছি-গুঞ্জন,
বসন্তের বর্ণালি বর্ষার ভরা রাত্রির ক্রন্দন
সূর্যোদয় সূর্যাস্তের সূক্ষ্ম রসায়ন
কুয়াশায় পতঙ্গের জীবন বয়ন।
পাখির নীরব মৃত্যু, প্রতিটি ফুলের জন্মমুহূর্ত এবং
ফড়িঙের চঞ্চলতা, আকাশের সবগুলো রং
সবই তো পড়েছে ধরা চেতন-ঊষার মতো প্রাণে,
জার্নালের পাতায় যেখানে প্রাত্যহিক ঐকতানে
লিপিবদ্ধ আরো কিছু-গভীর গ্রন্থের নয়-জীবনের ভাষা
“হে সবুজ গাছ, হে আমার প্রিয় বন্ধু, মেঘেভাসা
পাখির মতোই চাই আজও তোমার ছায়ায় চাই কিছুক্ষণ
পূর্ণতায় নানান লতাগুল্মের প্রাণের রণন।
যেদিন গেলেন তিনি কে যেন বলল নিচু স্বরে,
“আমাদের রৌদ্রছায়াময় এ প্রান্তরে কখন গেছেন ঝ’র
একটি বয়েসী বৃক্ষ। অন্য কোন বোকা প্রতিবেশী
আওড়ালো শোকের চলতি শ্লোক ক’টি বড় বেশি।
রোদের ছুরির ঘায়ে, বৃষ্টির ধারালো নখে, হলুদ পাতায়
ওই পোড়াবাড়িটার স্মৃতি
হ’ল বাতাসের সহচরী শূন্যতায়,
নির্বিকার রইলেন শুধু, শুধু শ্রীমতী প্রকৃতি।
একটি দৃশ্যের আড়ালে
এখনও আকাশ আছে, এই খোলা জানালার বাইরে
রাস্তায় অটুট ট্রাফিকের ঐকতান। বাতাসের
টোকায় খড়খড়ি জেগে ওঠে স্বপ্ন থেকে, বারান্দায়
যুগল পায়রা প্রেমে নিমজ্জিত, গলির বুড়োটা
তারাভরা আকাশের মতো শতচ্ছিন্ন তালিমারা
কোট গায়ে বিড়ি টানে, বোষ্টমির গানে
মাথা নাড়ে, দূরের শূন্যতা শব্দময়
প্লেনের গুঞ্জনে।
কিন্তু তার শোক নেই, পরিতাপ নেই,
তৃষিত বাসনা নেই, নেই পৃথিবীর রৌদ্রছায়া
স্থির চোখে। আমি শুধু লাশ নিয়ে বসে আছি পাশে
হলুদ চাঁদের নিচে-আর যারা ছিল দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর
ঘুমভরা ঢুলুঢুলু চোখে গেছে দোকানে চা খেতে।
নিস্পন্দ শরীর এক পাশে আছে প’ড়ে, জমে-যাওয়া
দশটি আঙুল প্রসারিত দেখছি আমার দিকে-
যেন আঁকড়ে ধরবে তারা এখনি আমার স্তব্ধতাকে।
নির্বাপিত সত্তার আড়ালে
চকিতে উঠল জ্ব’লে গ্রীষ্মের সেঁকা দপদপে কোনো
তরুণ ফলের মতো তোমার মুখের
প্রখর যৌবন।
একটি মৃত্যুবার্ষিকী
হয়নি খুঁজতে বেশি, সেই অতদিনের অভ্যাস,
কী করে সহজে ভুলি? এখনও গলির মোড়ে একা
গাছ সাক্ষী অনেক দিনে লঘু-গুরু ঘটনার
আর এই কামারশালার আগুনের ফুলকি ওড়ে
রাত্রিদিন হাপরের টানে। কে জানত স্মৃতি এত
অন্তরঙ্গ চিরদিন? জানতাম তুমি নেই তবু
আঠারো সাতে কড়া নেড়ে দাঁড়ালাম
দরজার পাশে। মনে হলো হয়তো আসবে তুমি,
মৃদু হেসে তাকাবে আমার চোখে, মসৃণ কপালে,
ছোঁয়াবে আলতো হাত, বলবে ‘কী ভাগ্যি আরে
আপনি? আসুন। কী আশ্চর্য। ভেতরে আসুন। দেখি
অন্ধকারে বন্ধ দরোজায় দুটি চোখ আজও দেখি
উঠল জ্ব’লে। কতদিনকার সেই চেনা মৃদু স্বর
আমার সত্তাকে ছুঁয়ে বাতাসে ছড়াল
স্মৃতির আতর।
শূন্য ঘরে সোফাটার নিষ্প্রাণ হাতল
কী করে জাগল এইক্ষণে? একটি হাতের নড়া
দেখলাম যেন, চা খেলাম যথারীতি
পুরানো সোনালি কাপে, ধরালাম সিগারেট, তবু
সবটাই ঘটল যেন অলৌকিক
যুক্তি-অনুসারে।
মেঝের কার্পেটে দেখি পশমের চটি
চুপচাপ, তোমার পায়ের ছাপ খুঁজি
সবখানে, কৌচে শুনি আলস্যের মধুর রাগিণী
নিঃশব্দ সুরের ধ্যানে শিল্পিত তন্দ্রায়।
জানালায় সিল্ক নড়ে, ভাবি কত সহজেই তারা
তোমাকে কীটের উপজীব্য করেছিল,
সারাক্ষণ তোমার সান্নিধ্যে পেত যারা
অনন্তের স্বাদ।
বারান্দায় এলাম কী ভেবে অন্যমনে, পারব না
বলতে আজ। জানতাম তুমি নেই, তবু
কাদের জন্যে
লিখতে কহ যে দিনরাত্তির
কাদের জন্যে লিখব?
কাদের জন্যে দুঃখের পাঠ
করুণ ভাষ্যে শিখব?
ইঞ্জিনিয়ার ডাক্তার আর
মোক্তার আর রাজনীতিবিদ
আদার ব্যাপারী আর ব্যাংকার
পেডেন্ডো আর মিহি কলাবিদ
খুঁটবে আমার কাব্য।
তাদের জন্যে লিখব এবং
তাদের জন্যে ভাবব?
শকুন-উকিল ঘোর ঠিকাদার
আর নিধিরাম সর্দার আর
হুজুরের জি-হাঁ হুঁকোবরদার
বৈদ্য এবং বৈশ্য
ঘাঁটব আমার প্রাণ-নিংড়ানো
সাধের অনেক শস্য।
তাদের জন্যে সকাল সন্ধে
গাধার খাটুনি খাটব?
হঠাৎ-আলোর ঝলকানি-লাগা
সরু দড়িটায় হাঁটব?
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
এদেশে হায়েনা, নেকড়ের পাল,
গোখরো, শকুন, জিন কি বেতাল
জটলা পাকায় রাস্তার ধারে।
জ্যান্ত মানুষ ঘুমায় ভাগাড়ে।
অথচ তোমার চুল খুলে দাও তুমি।
এদেশে কতো যে ফাঁকির আছিলা,
কালোবাজারের অপরূপ লীলা।
আত্মহত্যা গুম খুন আর
ফটকা বাজার-সব একাকার।
এখনও খোঁপায় ফুল গুঁড়ে দাও তুমি।
মড়ক-মারির কান্নার রোল
সারা দেশটার পাল্টায় ভোল।
হা-ভাতে ছোঁড়ারা হুজুরের দোরে
সোনালি আমের মরশুমে ঘোরে।
এখনও তোমার বাহু মেলে দাও তুমি।
এদেশে আ’মরি যখন-তখন
বারো ভূতে খায় বেশ্যার ধন।
পান নাকো হুঁকো জ্ঞানীণ্ডণীজন,
প্রভুরা রাখেন ঠগেদের মন।
এখনও গানের সুরে ভেসে যাও তুমি।
এদেশে নেতারা হাওদায় চ’ড়ে
শিকার গাঁথেন বাক্যের শরে,
আসলের চেয়ে মেকিটাই দামি।
বিচিত্র দেশ, কৃতজ্ঞ আমি
এখনও যে মেয়ে হাসি জ্বেলে দাও তুমি।