ইচ্ছে তাঁর ইচ্ছে
সূর্য আকাশে রৌদ্র ছড়ায়,
দুপুরের রোদ বিকেলে গড়ায়,
অনাবৃষ্টিতে শস্যের ক্ষেত জ্ব’লেপুড়ে যায়
খালবিল সব নিমেষে শুকায়,
-ইচ্ছে তাঁর ইচ্ছে।
মারিতে মড়কে দেশ ছারখার,
নব সংসারে ওঠে হাহাকার,
মেঘচেরা রোদে বাতাসে নড়ছে গাছের ডালটা,
-ইচ্ছে তাঁর ইচ্ছে।
জীর্ণ দেয়ালে শুধু থেকে থেকে
বেয়াড়া একটা কাক ওঠে ডেকে,
চৌধুরীদের বউটা শরীরে জড়ায় আগুন
ষোড়শীর মনে জ্বলছে ফাল্গুন
-ইচ্ছে তাঁর ইচ্ছে।
রাত্রি ফুরোলে জ্ব’লে ওঠে দিন
বাঘের থাবায় মরছে হরিণ;
কালবোশেখীর তাণ্ডবে কাঁপে পড়ো-পড়ো চাল
শূন্য ভাঁড়ারে বাড়ন্ত চাল
-ইচ্ছে তাঁর ইচ্ছে।
বাতিল কেরানি চেয়ে নিয়ে ক্ষমা
মৃত্যুতে খোঁজে ত্রাণে উপমা।
ধ্বংসের মুখে গ্রাম আর কত নগর পোড়ালি,
মুষড়ে পড়ল জুতোর গোড়ালি।
-ইচ্ছে তাঁর ইচ্ছে।
ইতিহাস, তোমাকে
করাতের অসংখ্য দাঁতের মতো মুহূর্তগুলো
আমাকে কামড়ে ধরেছিল, আর সেই মরণ-কামড়ে
আমি ঝাঁঝরা শরীরটাকে দু’ একবার নেড়েচেড়ে
পৃথিবীর বন্ধ দরজা নখ দিয়ে আঁচড়াতে আঁচড়াতে
নিঃসাড় হয়ে যেতে পারতাম।
কিন্তু আমার দুঃখ-চর্চিত ললাটে
অন্য সম্মানের আভাস ছিল বলেই
বেঁচে রইলাম। তৃষ্ণার দুপুরে কোনো আহত সাপের মতো
এক সীমাহীন ক্রোধে, মূর্খ যন্ত্রণায় নিজেকে টেনেহেঁচড়ে
বেঁচে রইলাম সর্বনাশের পাশ কাটিয়ে
সমস্ত দুর্দশার মুখের ওপর আমার প্রবল থাবা মেলে দিয়ে।
জীবনকে খণ্ড খণ্ড চিত্রে দেখেছি-কখনো সুন্দর
কখনো কুৎসিত। যুবককে দেখেছি
দুপুর সন্ধ্যা আর রাত্রিকে রেণুর মতো
উড়িয়ে দিতে হাওয়ায় আর বৃদ্ধকে দেখেছি তার
খাটো মোমবাতিটাকে হিংসুক বাতাসের
বিরোধিতা থেকে রক্ষা করার জন্য কী ব্যস্তবাগীশ।
কখনো অশেষ হঠকারিতায় জীবনকে একটা
আংটির মতো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে চেয়েছি,-কখনো
সময়ের জরায়ু ছিঁড়ে নিতে চেয়েছি
কয়েকটি টসটসে নিটোল কালো আঙুর,
যাদের আমি ঠোঁটে নিয়ে থেঁতলে দিতে, পিষে ফেলতে
ভালবাসি, ভালবাসি যাদের মাংসল কণাগুলো ছুড়ে ফেলে দিতে
ইতিহাসের হলুদ জঞ্জালে।
পেঁজা তুলোর মতো তুষারে অশ্বেতরের
পায়ের ছাপ, সোনালি গমের মাঠ
আগুনের লকলকে জিভ কিংবা ধোঁয়াটে
সন্ধ্যার প্রান্তরে খণ্ডিত সৈনিক
একেই বলবে কি ইতিহাসের বিশ্বস্ত বিবৃতি?
একটি আলোকিত দেহকে বিনাশ করবে বলে যারা
ক্রুশকাঠে পেরেক ঠুকেছিল, তাদের
উৎসব, ব্যভিচার কিংবা যারা বালিতে, অন্ধকার
গুহার দেয়ালে মাছের চিত্র এঁকে
ক্রুশবিদ্ধ অস্তিত্বের মহাপ্রয়াণে চোখ মুছেছিল,
তাদের ঘরকন্না, প্রেমের ব্যাপ্ত বলয়, তা-ও কি
অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ নয় প্রতারক ইতিহাসের?
ইতিহাস সরোদের মতো বেড়ে উঠলে
আমি সুখী, দামামার মতো গর্জে উঠলে
দুঃখ আমাকে বিবর্ণ করে। জীবন যখন বর্বরের মুঠোয়
কপোতের নরম বুকের মতো কেঁপে ওঠে,
গহন পাতালের প্রাগৈতিহাসিক শীতল জল
নিভিয়ে দিতে চায় হৃদয়ের আগুন,
আমার সমস্ত সম্ভ্রম আর উল্লাস
অর্পণ করি আগামীর অঞ্জলিতে
‘কেননা ভবিষ্যৎ এক
জলদমন্দ্র সুর ইতিহাসের ধ্রুপদী আলাপে।
উদয়াস্ত দেখি ছায়া
কোথায় ভাসাব ভেলা? দূরন্ত জলের ধ্বনি শুনে
কত বেলা গেল,
তবুও আপন
মাটির বিরাগ মূর্ত, ঠাঁই নেই ভাই
প্রাণের পাড়ায় তাই জানি না কখন কে হারায়।
ভয়ে চোখে চোখ রাখি, হাঁটুর বিবরে ঢাকি মুখ,
বাঁচার ভাবনা
ক্লান্ত হয়ে ফেরে মনে। যাবো না যেখানে
কোনোদিন স্বপ্ন তার তেড়ে আসে কুকুরের মতো,
মাচার সংসারে রাতে (নিজেকে শুনিয়ে বলি) যতটুকু পারো
দেখে নাও মুখ,
কে জানে কখন হবে ভোর, কেউ হয়তো তোমার
ঝিমানো দুপুরে খুলবে না দোর।
কলাইয়ের শূন্য মাঠে কাঁপে সাদা ঢেউ,
কে যাবি ঘরের পানে সূর্য-নেভা টানে
গোধূলির গরু-ডাকাপথ
খরস্রোতা নদী, ফাঁকা সাঁঝে
কে দেখাবে আলো?
বাজে শুধু
ধু-ধু জলধ্বনি
ওরে
নেই ফিরে যাওয়ার উঠোন।
উদয়াস্ত দেখি ছায়া বন্ধ্যা জলে, কাকে পেতে চায়
এ হাওয়ার ক্ষুধা।
প্রত্যহের পথ
প্রাণের তৃষ্ণায় কেঁদে তারা সমকালীন দু’জন
তবু উঠল গাছ বেয়ে মানুষ শঙ্খিনী।
প্রতিযোগিতার শ্রমে যার দুটি আর্ত ক্লান্ত চোখ।
দেখে নিল অন্তিম আকাশ,
তার নীল হাহাকার যাবে কতদূর?
ভাসমান পশু আর নির্বাক মানুষ
ক্যামেরার স্বদেশী খোরাক,
অনেক অনেক দূরে শস্যের শিবির…
নির্বোধ আশায় আর মজে না যে মন,
কত বেলা গেল…
কী করে ফিরব ঘরে,
কোন ঘাটে ভিড়ে
আবার চাঁদের অভিবাদন গ্রহণ?
বৈঠায় মারিনি পাখি, শোনো
ভুলে কোনো অমোঘ প্রহরে,
তবু কেন
তবু কেন এই
জলের মরণ?
একজন লোক
লোকটার নেই কোন নামডাক।
তবু তার কথা অষ্টপ্রহর
ভেবে লোকজন অবাক বেবাক।
লোকটার নেই কোনোখানে ঠাঁই।
জীবন লগ্ন পথের ধুলায়,
হাতে ঘোরে তার অলীক লাটাই।
লোকটা কারুর সাতে-পাঁচে নেই।
গাঁয়ের মোড়ল, মিলের মালিক-
তবু ঘুম নেই কারুর চোখেই;
লোকটার কাঁধে অচিন শালিক।
বলে দশজনে এবং আমিও
রোদ্দুর খায় লোকটা চিবিয়ে,
জ্যোৎস্নাও তার সাধের পানীয়।
হাজার প্রদীপ জ্বালায় আবার
মনের খেয়ালে দেয় তা নিবিয়ে।
মেঘের কামিজ শরীরে চাপিয়ে
হাঁটে, এসে বসে ভদ্রপাড়ায়।
পাথুরে গুহায় পড়ে না হাঁপিয়ে
সে-ও সাড়া দেয় কড়ার নাড়ায়।
তবু দশজনে জানায় নালিশ
লোকটা ঘুমায় সারাদিনমান,
কাছে টেনে নিয়ে চাঁদের বালিশ।