আত্মপ্রতিকৃতি
আমি তো বিদেশী নই, নই ছদ্মবেশী বাসভূমে-
তবে কেন পরিচয় অন্ধকার ঘরে রাজা, কেন
দেশের দশের কাছে সারাটা জীবন ডুগডুগি
বাজিয়ে শোনাব কথা, নাচাব বানর ফুটপাতে?
কেন তবে হরবোলা সেজে সারাক্ষণ হাটে মাঠে
বাহবা কুড়াব কিংবা স্টেজে খালি কালো রুমালের
গেরো খুলে দেখাব জীবন্ত খরগোশ দর্শকের
সকৌতুক ভিড়ে? কেন মুখে রঙ মেখে হব সঙ?
না, তারা জানে না কেউ আমার একান্ত পরিচয়
আমি কে? কী করি সারাক্ষণ সমাজের চৌহদ্দিতে?
কেন যাই চিত্রপ্রদর্শনী, বারে, বইয়ের দোকানে,
তর্কের তুফান তুলি বুদ্ধিজীবী বন্ধুর ডেরায়?
না, তারা জানে না কেউ।
অথচ নিঃসঙ্গ বারান্দায়
সন্ধ্যা, এভেন্যুর মধ্যরাত্রির স্তব্ধতা, সার্কাসের
আহত ক্লাউন আর প্রাচীনের অতন্দ্র বিড়াল,
কলোনির জীবনমথিত ঐকতান, অপ্সরীর
তারাবেঁধা কাঁচুলি, গলির অন্ধ বেহালাবাদক
ব্রাকের সুস্থির মাছ, সেঁজার আপেল জানে কত।
সহজে আমাকে, জানে কবরের দুর্বিনীত ফুল।
আত্মহত্যার আগে
শয্যাত্যাগ, প্রাতরাশ, বাস, ছ’ঘণ্টার কাজ, আড্ডা,
খাদ্য, প্রেম, ঘুম, জাগরণ; সোমবার এবং মঙ্গলবার
বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি আর রবিবার একই
বৃত্তে আবর্তিত আর আকাশ তো মস্ত একটা গর্ত-
সেখানে ঢুকব নেংটি ইঁদুরের মতো। থরথর
হৃদয়ে প্রতীক্ষা করি, স্বপ্ন দেখি আগামীকালের
সারাক্ষণ, অনেক আগামীকাল্য উজিয়ে দেখেছি
তবু থাকে আরেক আগামীকাল। সহসা আয়নায়
নিজের ছায়াকে দেখি একদিন-উত্তীর্ণ তিরিশ।
পূর্ণিমা চাঁদের দিকে পিঠ দিয়ে, অস্তিত্বকে মুড়ে
খবরের কাগজে ছড়াই দৃষ্টি যত্রতত্র, নড়ি,
মাঝে-মাঝে ন’ড়ে বসি, সত্তার স্থাপত্যে অবিরল
অলক্ষ্যে গড়িয়ে পড়ে মাছের ঝোলের মত জ্যোৎস্না
আর আমি বিজ্ঞাপন পড়ি, হাত-পা ছড়িয়ে পড়ি
এবার কলপ দিন, আপনি তো জানেন অকাল-
পক্ব চুলে কলপ লাগালে অনায়াসে ফিরে আসে
ফেরারি যৌবন… আর এই ফলপ্রদ টনিকটা
খাবেন প্রত্যহ তিনবার ঠিকঠাক দাগ মেপে
অর্থাৎ চায়ের চামচের দু’চামচ এবং খাবার আগে
কিংবা পরে, তাহলে বাড়বে ক্ষিদে আর স্নায়ুগুলি
নিশ্চিত সবল হবে, যদি খান সুস্বাদু টনিক।
ধরা যাক যা-কিছু লিখেছি সবি পড়ে লোকে, প’ড়ে
প্রচুর তারিফ করে, ব্যাংকের খাতাও স্ফীতকায়;
উন্নতির সবগুলি গোল ধাপ পেয়েছে আমার
সুকৃতী পায়ের ছাপ, ইচ্ছাপূরণের যত গান
হৃদয়ের সাতটি মহলে পেলো খুঁজে সফলতা;
জীবনের প্রতিটি সুন্দর স্বপ্ন পাপড়ি মেলে
চেয়েছ আমার দিকে পত্নীর গার্হস্থ্য প্রণয়ের
পরিণাম পুত্র-কন্যা সহজে এসেছে যথারীতি
এবং নিজের বাড়ি, সাজানো বাগান, ধরা যাক,
গাজরের ক্ষেত, মুরগি ইত্যাদির স্বচ্ছন্দ বিন্যাসে
মানবজীবন ধন্য। শৈশবের সাধের কল্পনা
নকশা অনুসারে, ধরা যাক, একে একে ঘটল সবি।
অনেক সমুদ্র ঘুরে কত বন্দরের গন্ধ মেখে
একদিন সার্থবাহ বার্ধক্যের অবসন্ন ঘটে
ফিরে আসে পণ্যবাহী সার্থক জাহাজ, পালতোলা,
গলাফোলা নাবিকের গানে গুঞ্জরিত। মূর্খ যত
চেঁচিয়ে মরুক তারা, পূর্ণতার স্তবে রাত্রিদিন
জপেছি ভীষণ মন্ত্র ক্ষয়ে ক্ষয়ে… কিন্তু তারপর?
আড় হয়ে বিকেলের রোদ পড়ে চায়ের আসরে;
কয়েকটি সুবেশ তরুণ-তরুণীর সংগত সংলাপে
গোলাপ বাগান জ্বলে রক্তিম কুঁড়ির জাগরণে
মুহূর্তের অতন্দ্র মালঞ্চে। টেবিলের ফুলদানি
জ্যোৎস্নার বিস্ময়ে ফোটে মহিলার অন্ধকার ঘরে।
নিয়ন আলোর মতো কারুর হাসির শত কণা
জাগায় স্মৃতির শব, হাড়হিম দেহে লাগে তাপ।
আমি নই ইডিপাস, তাহলে কী করে উচ্চরোলে
সভাসদ মাঝে করি উচ্চারণ ‘অবশেষে বলি
ভালো সবকিছু ভালো?’
অসংগতি, না আমার মধ্যে নেই, রয়েছে সেখানে
রেস্তোরাঁয়, অন্ধকারে দেয়ালে আমার চতুর্দিকে,
বলতে পারো বরং নিজেই আমি নিমজ্জিত, ওহে,
এ-অসংগতির মধ্যে। লিপস্টিক ঘষে মুছে-ফেলা
ঠোঁটের মতন আত্মা নিয়ে কী আশ্বাসে বাঁচায় যায়
যন্ত্রণার অগ্নিকুণ্ডে, বিরক্তির মাছির জ্বালায়?
যেহেতু উপায় নেই ফেরবার, আমার সম্মুখে
দুটি পথ অবারিত, আমন্ত্রণে প্রকট চটুল-
গলায় বিশ্বস্ত ক্ষুর কিংবা অলৌকিক বিশ্বাসের
রাজ্যে শুধু অন্ধের স্বভাবে বিচরণ, সায় দেয়া
কবন্ধের শাস্ত্রের শাসনে, পরচুলা খ’সে পড়া
ক্রমাগত অনর্থক যুক্তিহীন মাথা নেড়ে-নেড়ে।
ঈশ্বর কি শিউরে ওঠেন মলভাণ্ডে? উনুনের
কড়াইয়ের তীব্র জ্বালে কুঁকড়ে যান কাগজের মতো?
যদি বলি প্রবঞ্চনা ঈশ্বরের অন্য নাম তবে
সত্য থেকে সঠিক ক’গজ দূরে আমার সংশয়ী
পদক্ষেপ? তা হলে বিশ্বস্ত ক্ষুর গলায় ছোঁয়ালে
অথবা ক’ফোঁটা বিষ কণ্ঠ বেয়ে নেমে গেলে এই
জ্বঠরের পাকে পাকে, পার্থক্যের কী জটিল সূত্র
উন্মোচিত হবে পরিণামে?
আমার মাকে
মাকে দেখি প্রতিদিন ধ্যানী প্রদক্ষিণে
ছায়াবৃতা আপন সংসারে। তাকে চিনে
নিতে পারি সহজেই যখন নিভৃত অনুভবে বারবার
একটি ভাস্বর নদী, ফলের বাগান, মাঠ আর
শস্যক্ষেত, দূরের পাহাড়
গলে গিয়ে একই স্রোতে বয়ে যায়, সীমা
মুছে যায় চরাচরে স্বদেশের স্বতন্ত্র মহিমা
অনন্য উপমা তাঁর। কে যেন চকিতে চেনা স্বরে
বলে শুনি, পাল্কি চড়ে, বেনারসি পরে
যদিন এলেন তিনি আমার ঘরে
চেরাগের মতো কল্যাণের হাত ধরে-
তারই স্মৃতি আছে লেগে অদৃশ্য চাঁপার উন্মীলনে,
সোনার কলসে আর সাঁঝ-নামা দিঘির গহনে।
মার চোখে শৈশবের ক্রৌঞ্চ দ্বীপ ভাসে?
চোখে বেনেবউ পাখি, চোখে চন্দ্রমল্লিকার দাবি
শঙ্কিত আভাসে আঁকা-ভাবি
রান্না আর কান্না গাঁথা রুক্ষ এই মরুর আকাশে
এখনও কি স্বপ্ন বোনে ঊর্ণনাভ চাঁদ
নাকি স্বপ্নের জরির পাড়ে সবি জাদুকরি ফাঁদ।
চেয়েছে বুকের সূক্ষ্ণ সোনালি সুতোয় চিরদিন
সমস্ত জীবন হোক নকশিকাঁথা সে ইচ্ছার ঋণ
শুধে দিতে বুঝি হতে হয়
গাছের মতোই এই রৌদ্রজলে মৃন্ময়, তন্ময়।
মাকে দেখি। আজও দেখি কী এক মায়ায়
পাখি তার হাত থেকে স্নেহের খাবার খেয়ে যায়
দু’বেলা আবেগ ভরে। দেখি তসবি গুনে
সত্তার মিনারে
সত্তার কিনারে
ঐ দূরায়নী আজানের ধ্বনি শুনে
আর সুবে-সাদেকের তীব্র শুভ্রতায় নির্মেঘ আনন্দে শোকে
আজীবন সমর্পিতা কোরানের শ্লোকে।
আমার দুর্ভাগ্য সেই বিশ্বাসের অনড় জমিনে
দেখি না প্রোথিত কোনো অলীক পর্বত-যাকে চিনে
দ্বন্দ্বহীন জীবনের কাছে আত্মবিসর্জনে পাব স্বর্গসুখ।
মাঝে-মাঝে সংশয়ের গলিতে বিমুখ
প্রশ্ন তুলে ধরে ফণা
আমি কি সঠিক জানি ভদ্রমহিলাকে
-আমি যার একান্ত বিস্তার অনন্তের শুভ্রলোকে-
চিনি তাকে?
ব্যথা হয়ে বাজে মাঝে-মাঝে তারও চোখ
আমার অস্তিত্ব-পটে ‘কে এই অচেনা ভদ্রলোক?’