শীতরাত্রির সংলাপ
যে-রাত্রির পাস্টেরনাক দেখেছেন সাদা প্রান্তরের
বরফের স্তূপে, নেকড়ের ক্ষুধিত চিৎকারে ছেঁড়া
শূন্যতায়, সে-রাত্রি দেখিনি আমি এবং এখানে
আমাদের ফটকে জমে না।
অজস্র তুষার আর বরফ চিবানো আধ-পাগলা
মেয়ে বাগানের ভাঙা বেড়াটার ধারে
অথচ চৌকাঠে
মুচ্কি হেসে দাঁড়ায় না এসে সিল্কের রুমাল-বাঁধা
চুলে খোলা পায়।
একদার কুয়াশায় লীন কোনো পৌষের হিমেল
রাত আজও অস্তিত্বের গির্জের চূড়োয়
ঝরায় শিশির কণা মনে পড়ে সেই ছোট ঘরে
প্রথম প্রহরে তুমি পড়ছিলে ডাক্তার জিভাগো
একা, গায়ে পাৎলা কোট, নামহীন দূরত্বে আসীনা-
তখন তোমাকে সহজেই ভাবা যেত বিদেশিনী,
বলেও ছিলাম তাই। আর সেইক্ষণে অকস্মাৎ
নরম কাগজ থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে এলো পাস্টেরনাকের
সাদা রাত্রি, যেন
পড়ল ছড়িয়ে সবখানে, উদ্ভাসিত
আমাদের সত্তার জটিল গাছপালা।
বলেছিলে ‘শীতের প্রখর রাত্রি দিয়েছে নামিয়ে
আমাদের অন্ধখার হা-খোলা কবরে।
হয়তো চাঁদের প্রেত খানা-খন্দে উঁকি
দেবে ক্ষণকাল, ক্ষণকাল গোপনে রাত্রির কানে
দুল হয়ে থাকবে ঝুলে ক’টি চামচিকে
তৃতীয় প্রহরে। রাত্রিভর হিম হাওয়া বয়ে যায়
রক্তের ফেনিল হ্রদে আর বারবার কেঁপে ওঠে
অস্তিত্বের প্রচ্ছন্ন কংকাল।
আমি তার উত্তরে বলেছি এই দাঁতে-দাঁতে লাগা
নীল জীবনকে তাপ দেবে বসন্তের
উদার জ্বালানি। দ্যাখো চেয়ে সৌন্দর্যের গাঢ় স্তবে
মুখর রহস্যময় নিঃসঙ্গ মানুষ।
শুধু প্রশ্নে বিদ্ধ আমি
শুধু প্রশ্নে আমি, উড্ডীন যে-প্লেন কোনো দিন
পারে না নামতে নিচে এরোড্রমে, ঘোরে দিগ্ধিদিক,
গুঁড়ো হয় বিস্ফোরণে, অথবা নিখোঁজ তারই মতো
উত্তর দেয় না ধরা মননের মায়াবী গণ্ডিতে।
বরং ঘোরায় নিত্য কত ছলে, পড়ি খানা-খন্দে,
আবর্তে তলিয়ে যাই, মাথা ঠুকি পাথুরে গুহায়।
গাছ কি শিউরে ওঠে ঠাণ্ডা ভয়ে যখন শরীর
থেকে তার পাতাগুলি ঝরে যায় অথবা আনন্দে
উল্লসিত পাখির চোখে সোনালি শস্যের মাঠ কোনো
কখনো ওঠে কি জ্ব’লে স্বপ্নের মোহন আমন্ত্রণে?
মাছ কি বিতৃষ্ণ হয়ে মগ্ন হয় আত্মনিপীড়নে
কোনো ক্ষণে জলের বাগানে চায় পাখির কোরাস?
নিজেকে নিঃসঙ্গ ভেবে পথের কুকুর ফুটপাতে
রাত্রির নেশায় মত্ত খোঁজে কোন একান্ত সুহৃদ?
সন্দেহ ক্রমশ কেন হতাশায় হয়ে যায় লীন
বুদ্ধির জটিল চৌমাথায়? অনিদ্রার আক্রমণে
বেসিনে আরশোলা দেখে আঁতকে কেন উঠি মধ্যরাতে
মুখ ধুতে গিয়ে, কেন ভাবি কাফ্কার নায়কের
পরিণা, বিপন্ন অস্তিত্ব যার বুকে হেঁটে হেঁটে
শুনতে চেয়েছে জ্যোৎস্না-চমকিত বেহালার সুর,
চেয়েছে খুঁজতে সম্পর্কের অবলুপ্ত তন্তুজাল।
শুধু প্রশ্নে বিদ্ধ আমি আজীবন, উত্তরের প্লেন
নামে না ঘাঁটিতে কোনো, থামে না তর্কের কোলাহল।
সূর্যাবর্ত
বাঁচার আনন্দে আমি চেতনার তটে
প্রত্যহ ফোটাই ফুল, জ্বালি দীপাবলি
ধ্যানী অন্ধকারে। আর মৃত্যুকে অমোঘ
জেনেও স্বপ্নের পথে, জেনেও আমার
পৃথিবীতে খুঁজি
জীবনের দান গানে গানে, প্রাণলোকে
খুঁজি ফিরি উপসৃত সুন্দরের স্মৃতি।
অভ্যাসের বিবর্ণ দৃষ্টিতে নয়, সৃষ্টির আবেশে
সপ্রেম তাকাই চতুর্দিকে
এই চরাচরে উন্মীলিত
বৈশাখী রৌদ্রের উজ্জীবনে,
উধাও মাঠের প্রান্তে ধ্যানী ঐ গাছের ছায়ায়
আর বনে বনে মর্মরিত খোলা ঊর্মিল হাওয়ায়
নীলিমায় দিই মেলে মানসমরাল।
ব্যাপ্ত এই চরাচরে পতঙ্গ অথবা
নিবিড় গোলাপ-সবি মনে হয় অরূপ রতন।
এখনও সূর্যের আলো পৃথিবীরে আসে
যথারীতি, ঝরনার মতন ঝরে সম্পন্ন গৃহীর
নিকানো উঠোনে আর কবরের পুরানো ফাটলে।
প্রদীপ্ত সূর্যের রং লাগে যুবতীর
সলজ্জ রক্তিম গালে, আর
আলো ঝরে নিদ্রাহীন রোগীর শয্যায়।
পিচ্ছিল শবের ভোজে মত্ত কৃমি অথবা আজানে
উচ্চকিত সবচেয়ে উঁচু কোনো উজ্জ্বল মিনার-
সবাই অলক্ষ্যে পায় সূর্যের প্রসাদ
সমপরিমাণে;
এবং উদার সূর্য উপমা তোমার।
প্রকৃতির টোলে আমি কখনো নিইনি পাঠ, তবু
ঋতুতে ঋতুতে
আমার সত্তার স্বরগ্রাম
কেবলি ধ্বনিত হয়, অবিরাম প্রহরে প্রহরে
এখনও যে ক্লান্ত হলে নিসর্গের কাছে
আশ্চর্যের গ্লাস হাতে যাই,
অবসন্ন চেতনার গোধূলিতে শুনি
সান্ত্বনার ভাষা এখনও রবীন্দ্রনাথ,
সে তোমারি দান।
আমাকে দিয়েছ ভাষা, তার ধ্বনি, প্রতীকী হিল্লোল
অস্তিত্বের তটে আনে কত
ঐশ্বর্যের তরী-পাল-তোলা তরঙ্গের স্মৃতিস্রোত
দীপ্ত জলযান।
আমাকে দিয়েছ ভাষা, সে-ভাষা আমার
হৃদয়ের একান্ত স্পন্দনে
প্রাণের নিভৃত উচ্চারণে
শিখা হয়ে জেগে রয় জীবনের মুক্ত দীপাধারে।
এবং নিশ্চিত জানি তোমার বাণীর
দীপ থেকে অন্য এক ভাষার প্রদীপ
জ্বালাব অযুত প্রাণে, জ্বলবে তখন
কত না হীরক সম্ভাবনা সময়ের
বিমূর্ত সন্ধ্যায়।
তুমি নও সীমিত শুধুই কোনো পঁচিশে বৈশাখে।
তোমার নামের ঢেউ একটি দিনের
সংকীর্ণ পরিধি ছিঁড়ে পড়েছে ছড়িয়ে
রূপনারানের কূলে, বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘে
অনন্তের শুভ্রতায় তুমি নও সীমিত শুধুই
পঁচিশে বৈশাখে।
যেমন রৌদ্রের তাপ জ্যোৎস্নার মদির মায়ালোকে
হাওয়ার নির্ঝরে
অথবা শ্রাবণে
অক্লান্ত বর্ষণে বেঁচে থাকি মাঝে-মাঝে
নিজেরই অজ্ঞাতে,
তেমনি তোমার
কবিতায়, গানে প্রতিধ্বনি হয়ে জাগে
আমাদের সত্তার আকাশ।
জীবন যখন ক্রমে কেবলি শুকিয়ে যায়, ডোবে
পাঁকের আবর্তে আর বর্বরের বাচাল আক্রোশে
অবলুপ্ত জ্ঞানীর সুভাষ,
জেনেছি তখন
অলৌকিক পদ্মের মতন
তোমার স্বরণ
উন্মোচিত হয়,
হয় উদ্ভাসিত
অসংখ্য প্রাণের তীর্থে এবং তোমার
গানে গানে মৃত্যুর তুহিন শীতে ফোটে
ফোটে অবিরত
জীবনের পরাক্রান্ত ফুল।