রবীন্দ্রনাথের প্রতি
লোকে বলে বাংলাদেশে কবিতার আকাল এখন,
বিশেষত তোমার মৃত্যুর পরে কাব্যের প্রতিমা
ললিতল্যাবণ্যচ্ছটা হারিয়ে ফেলেছে-পরিবর্তে রুক্ষতার
কাঠিন্য লেগেছে শুধু, আর চারদিকে পোড়োজমি,
করোটিতে জ্যোৎস্না দেখে ক্ষুধার্ত ইঁদুর কী আশ্বাসে
চম্কে ওঠে কিছুতে বোঝে না ফণিমনসার ফুল।
সুধীন্দ্র জীবনানন্দ নেই, বুদ্ধদেব অনুবাদে
খোঁজেন নিভৃতি আর অতীতের মৃত পদধ্বনি
সমর-সুভাষ আজ। অন্যপক্ষে আর ক’টি নাম
ঝড়জল বাঁচিয়ে আসীন নিরাপদ সিংহাসনে,
এবং সম্প্রতি যারা ধরে হাল বহতা নদীতে
তাদের সাধের নৌকো অবেলায় হয় বানচাল
হঠাৎ চড়ায় ঠেকে। অথবা কুসুমপ্রিয় যারা
তারা পচা ফুলে ব’সে করে বসন্তের স্তব।
যেমন নতুন চারা পেতে চায় রোদবৃষ্টি তেমনি
আমাদেরও অমর্ত্যের ছিল প্রয়োজন আজীবন।
তোমার প্রশান্ত রূপ ঝরেছিল তাই সূর্যমুখী
চেতনার সৌরলোকে রাজনীতি প্রেমের সংলাপে।
যেন তুমি রাজসিক একাকিত্বে-মধ্যদিনে যবে
গান বন্ধ করে পাখি-কখনো ফেলোনি দীর্ঘশ্বাস,
যেন গ্রীষ্মে বোলপুরে হওনি কাতর কিংবা শুকনো
গলায় চাওনি জল-অথবা শমীর তিরোধানে
তোমার প্রোজ্জ্বল বুক হয়নিকো দীর্ণ কিংবা যেন
মোহন ছন্দের মায়ামৃগ করেনি ছলনা কোনো-
এমন মূর্তিতে ছিলে অধিষ্ঠিত সংখ্যাহীন প্রাণে।
গোলাপের তীক্ষ্ণ কাঁটা রিলকের সত্তার নীলিমাকে
ছিঁড়েছিল, তবু তাও ছিল স্নানাহার, চিরুণির
স্পর্শ ছিল চুলে, ছিল মহিলাকে নিবেদিতপ্রাণ।
আমার দিনকে তুমি দিয়েছ কাব্যের বর্ণচ্ছটা
রাত্রিকে রেখেছ ভরে গানের স্ফুলিঙ্গে, সপ্তরথী
কুৎসিতের ব্যূহ ভেদ করবার মন্ত্র আজীবন
পেয়েছি তোমার কাছে। ঘৃণার করাতে জর্জরিত
করেছি উন্মত্ত বর্বরের অট্রহাসি কী আশ্বাসে।
প্রতীকের মুক্ত পথে হেঁটে চলে গেছি আনন্দের
মাঠে আর ছড়িয়ে পড়েছি বিশ্বে তোমারই সাহসে।
অকপট নাস্তিকের সুরক্ষিত হৃদয় চকিতে
নিয়েছ ভাসিয়ে কত অমলিন গীতসুধারসে।
ব্যাঙডাকা ডোবা নয়, বিশাল সমুদ্র হতে চাই
এখনও তোমারই মতো উড়তে চেয়ে কাদায় লুটিয়ে
পড়ি বারবার, ভাবি অন্তত পাঁকের কোকিলের
ভূমিকায় সফলতা এলে কিছু সার্থক জনম।
রূপান্তর
চঞ্চলা নর্তকী নও, অথচ যখন হাঁটো কিংবা ছুটে যাও,
বর্ষার বৃষ্টির পরে রামধনু উঠলে আকাশে,
বারান্দায়, চলায় সহজে লাগে ছন্দের বিদ্যুৎ।
যখন আয়নার সামনে লিপস্টিক মাখো ঠোঁটে, হাই-হিল জুতো
পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নামো, হাতে বই, বুকের উপর
কালো বেণী, চিবুকে ঘামের ফোঁটা, কী-যে ভালো লাগে।
যখন বাগান যাও, ফুল তোলো, ঝকঝকে দাঁতে
হঠাৎ কামড়ে ধরো সবুজ পেয়ারা, ময়নাকে
ছাতু দাও খেতে আর ভাঁড়ারের অন্ধকার কোণে
আঁতকে ওঠো আরশোলা দেখে, পানি চেয়ে
ভেঙে ফ্যালো গ্লাস, নখ খাও এবং চাবির রিং
ঘোরাও আঙুলে
অথবা সুরের তাল কেটে গেলে তন্ময় বিকেলে
খিলখিল ওঠো হেসে, ক্যারম খেলতে গিয়ে সারা
খেলাটাই করো মাটি
কী করে বোঝাই কতো ভালো লাগে তোমাকে তখন!
অবশ্য কখনো
কবিতা পড় না তুমি (ক্লাসের বরাদ্দ পদ্য ছাড়া)
তাতে কী? তবুও এ সুন্দর শরীরী সৌরভে মেতে
পৃথিবীতে আছ তাই মেটাই চোখের তৃষ্ণা
সারাক্ষণ।
হয়ত পারতে হতে সোনালি-নিবিড় বালুকণা
আমার মুঠোয় ঝলোমলো, ভাবি তুমি অর্গানের
ধ্বনির মতোই শ্রাবণের কালো ফোঁটা পাতাবাহারের বুকে,
বাগানের টসটসে ফলের সুরভি, মাংসে-বেঁধা
গোলাপের কাঁটা হয়তো পারতে হতে…
রৌদ্র করোটিতে
জীবনকে তুখোড় যদি সারাক্ষণ
মাতলামো করি আর শরীর গাঁজার গন্ধে ভরে
ছট করে চলে যাই সাঙাতের ফুর্তিবাজ রকে,
পাপকে হৃদয়গ্রাহী করে তুলি হ্রদের আলোর
মতো যদি উৎপীড়িত অন্ধকারে, ঘেয়ো ভিখিরির
ছেঁড়া ন্যাকড়ার ভাঁজে নক্ষত্রের ছায়া দেখি যদি
অথবা স্বপ্নের ঠাণ্ডা হরিণকে কাঁধে নিয়ে, ওহে,
কোথাও অলক্ষ্যে স’রে পড়ি, কনে-দেখা আলো সাক্ষী
রেখে বড়বাবু পৃথিবীকে একটা সালাম ঠুকে
হো-হো হেসে উঠি অতর্কিতে বদরাগী উর্দি দেখে,
তবে কি বেল্লিক ভেবে সরাসরি দেবে নির্বাসন
চিরতরে অথবা লেখাবে দাসখৎ শোকাবহ
আত্মার সাক্ষাতে? যাই করো, চিরদিন আমি তবু
থাকব অনড় সাক্ষী তোমাদের কাপুরুষতার।
জানি যারা দেখতে চায় নিষ্কলুষ জ্যোৎস্নার সারস
ঘুমেভরা ডানা দুটি গুটিয়ে রয়েছে ব’সে ভাঙা
দেয়ালের মস্ত বড় হাঁয়ের ভেতর, দেখতে চায়
বয়স্কের তোবড়ানো গালের মতন অতীতের
ধসে কয়েকটি ক্লান্ত নর্তকী ঘুঙুর নিয়ে করে
নাড়াচাড়া, যারা দেখতে চায় ঝাড়লণ্ঠনের নিচে
মোহিনী সৌন্দর্য আবর্তিত কুৎসিতের আলিঙ্গনে
রাত্রির স্খলিত গালিচায়, ফেলেনি নোঙর তারা
কোনো দিন বণিকের জ্বলজ্বলে সম্পন্ন বন্দরে।
নির্বাসন দাও যদি জনহীন অসহ্য সৈকতে,
নিহত আত্মার শোকে করব না কখনো বিলাপ।
বরং নির্মেষ মনে হাত-পা ছড়িয়ে অবিচল
দুর্দশার প্রহার গ্রহণযোগ্য করে দেখব সে
ডানপিটে সূর্যটাও সহসা উধাও অন্ধকার
বনে; নিশাচর বেদে চাঁদের প্রসন্ন মুখে পাখা
ঝাপটায় ঢাউস বাদুড়, ছিঁড়ে ফেলে শুভ্রতাকে।
কখনো দেখব স্নপ্ন-কয়েকটি জলদস্যু যেন
অবলীলাক্রমে কাটা মুণ্ডুর চামড়া নিচ্ছে তুলে
অব্যর্থ ছোরার হিংস্রতায়, গড়ায় মদের পিপে
রক্তিম বালিতে আর বর্বর উল্লাসে চতুর্দিকে
কম্পিত পাতার মতো শব্দের ধমকে। কখনোবা
হঠাৎ দেখব জেগে শুয়ে আছি হাত-পা ছড়ানো
বিকেলের সাথে নামহীন কবরের হল্দে ঘাসে,
দেখব অঢেল রৌদ্রে ঝল্সে উঠে ঝরায় চুম্বন
ওষ্ঠহীন করোটিতে, জানব না সে করোটি কার,
সম্রাট অথবা ভাঁড় যার হোক আমি শুধু একা
দেখব রৌদ্রের খেলা একটি নির্মোহ করোটির
তমসায় দেখব কে ছুঁয়ে যায় কালের বুড়িকে।