- বইয়ের নামঃ রৌদ্র করোটিতে
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- প্রকাশনাঃ বিভাস
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অনুস্মৃতি
এমন একলা এই পথ, কোনোখানে সাড়া নেই
জনমানবের। বুঝি বাতাসের স্বরে
গলে গিয়ে মিশে যাবে আমাদের সত্তার সুরভি,
এমন নিঃসঙ্গ এই পথ!
‘এখানে আসে না কেউ’ তুমি বলেছিলে, ‘খরগোশ,
প্রজাপতি, জোনাকি অথবা ঝিঁঝি হরেক রকম
নানারঙা পাখ্পাখালি, কাঠবিড়ালী ছাড়া
এখানে আসে না কেউ। রৌদ্র ওঠে, মেঘ ফেলে ছায়া,
গাছাপালা আর্দ্র হয় বৃষ্টির আদরে। আর দ্যাখো
সোনালি-হলুদ ফুল গুচ্ছ অর্পিত স্তবকে
বিন্দু বিন্দু আনন্দের সমবায় শুধু।
তোমার পায়ের নিচে শুক্নো পাতাগুলো
উঠল বেজে, তুমি ছোট গাছটার ডাল ধরে দেখি,
দাঁড়ালে, রইলে মাথা নিচু করে ক্ষণকাল, আমি
বললাম, ‘সবকিছু বদ্লে গেছে তুমি আছ বলে।
আর তুমি
‘ঘুরে-বেড়ানোর মতো বেশ জায়গা। নেই
উঁকি-দেয়া চোখ, উদ্যত তর্জনী আশে-পাশে,
এবং দূরের আকাশকে
মনে হয় এখানে আকাশ অবিকল।
এরোপ্লেন উড়ে গেল মাথার উপর এক ঝাঁক
শব্দের মৌমাছি উঁচু উঁচু গাছ স্পর্শ করে
আমাদের স্তব্ধতাকে করেছে গুঞ্জিত।
তোমার আমার মধ্যে যে-শিল্পিত দূরত্ব অটুট
চিরদিন, তারই রূপ রইল এখানে ধরা এই
জনহীন পথপ্রান্তে গুচ্ছ ফুলের স্তবকে।
কোনো দিন মফস্বলে একরত্তি অখ্যাত স্টেশনে
থামলে রাত্রির ট্রেন, শেষ রাতে মরা জ্যোৎস্না ঠেলে
চা খেয়ে মাটির খুড়ি ছুড়ে ফেলে দেব প্লাটফর্মে,
(হুইসিলে পাড়াগাঁর ছবি দূরে হবে সচকিত)
হঠাৎ ধরাব সিগারেট, ভাবব কতদিনকার
সেই নদী, বন, সাঁকো, আর
তোমার পায়ের নিচে কত শুকনো পাতার মর্মর।
অস্তিত্বের তন্ময় দেয়ালে
মনের খেয়ালে গেঁথে অগণন তারা
অস্তিত্বের তন্ময় দেয়ালে
স্মৃতিকে করেছি আমি সীমাহীন সুনীল আকাশ।
সেখানে কয়টি হাঁস শৈবালের আর
বন্ধ্যা তুষারের গণ্ডি ছেড়ে পেতে চায়
রৌদ্রের জোয়ার আজও, আজও
নিরুদ্বেগ সাহসী ডানায়।
মনে পড়ে আমিও একদা পড়েছি ঝাঁপিয়ে অন্তহীন
নীলিমায়, কতদিন মেঘের প্রাসাদে
কাটিয়েছি মায়াবী প্রহর
আমি আশ্চর্যের যুবরাজ।
সেদিন আননে ছিল আঁকা
ত্রিলোকের রূপাভাস, আর
স্বপ্নের কাননে তুলে বাসনার ফুল
যথারীতি পেয়েছি মদির সঙ্গ কত
এবং বেসেছি ভালো-আস্থা রেখে সেই
দ্রাক্ষাবনে, অনন্তের প্রীত গুঞ্জরণে-
স্বপ্নের সুন্দরীদের। কাটিয়েছি কত যুগ সেই
নীলিমা-খচিত মায়ালোকে।
তাড়াতাড়ি হঠাৎ রাত্রির শেষ বাসে
উঠে প’ড়ে ভাবি এই
নেশার খোঁয়ারি কেটে গেলে
নামব কোথায় তবে, এখানে কোথায়?
থাক থাক, ক্ষতি নেই কিছু,
ভাবব পরে।
এখন দু’চোখ ভরে শুধু
দেখা যাক-কী দেখব? নিশ্চল, নিরেট
অন্ধকারে হাতড়িয়ে পথ কাকে ছোঁব শেষে? কাকে?
ডিঙিয়ে মর্ত্যের বেড়া পাব কি স্বর্গের
অবতরণিকা?
সাফল্যের গাছ যত পাখি পুচ্ছ তুলে নাচে, আজ
তাদের স্বপ্নের ঘোরে বুঝি
আমার চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে
এ-রাত্রির শেষ বাসে! ও কিছুই নয়
আসলে হৃদয় মাঝে-মাঝে
হয়ে পড়ে নেহাত অবুঝ নাবালক
নেশার খোঁয়ারি কেটে গেলে পৃথিবীকে
নির্বোধের হাসির মতোই মনে হয়।
শূন্য প্রহরের দীর্ঘশ্বাস বৃথা প্যানিক ছড়ায়
এবং নড়ায় স্তব্ধ আদর্শের ভিত।
জানি এই ভিড় ঠেলে, ঢিলে-ঢালা সস্তা স্যুট প’রে
রাস্তার দাম্ভিক শত বিজ্ঞাপন প’ড়ে, পুঁইশাক
ডাঁটার চচ্চড়ি,
নিরীহ মাছের ঝোলে ডুবিয়ে জীবন
থাকব, বাঁচব আমি দিনের চিৎকারে
রাত্রির করুণ স্তব্ধতায়।
মাঝে-মাঝে কারো
অস্তিত্বের সুরভির জন্য হয়তোবা
ধমনী চঞ্চল হবে স্পন্দিত নদীর মতো ফের,
সত্তার মিনারে চাঁদ জ্বলবে তখন।
আজ শুধু
স্মৃতিকে করেছি আমি বিশাল আকাশ।
আজীবন আমি
আমার হৃদয়ে ছিল লোকোত্তর সফল বাগান
তর্কাতীত ঐশ্বর্যে ভাস্বর।
কোনো দিন সময়ের সিংহবর্ণ মরুভূমি তাকে
পারেনি ডোবাতে তরঙ্গিত বালির কবরে,
অথবা উটের দীর্ঘ কোনো
বেঢপ পায়ের নিচে হয়নি দলিত
বাগানের কোমল পরাগ।
বরং সেখানে বহু চৈত্রসন্ধ্যা তার
সুরভিত প্রশান্ত চিকুর
দিয়েছে এলিয়ে বারবার, আর কত
চকিত রাত্রির নীলিমায়
আকাশের বাঁকা সিঁড়ি বেয়ে
এসেছে তো রক্তকরবীর ডালে শব্দহীন চাঁদ
সে-চাঁদ দু’জনে মিলে দেখেছি অনেক
সপ্রেম প্রহরে; কতবার সে চাঁদের স্মৃতি-ছবি
এঁকেছি নিভৃত মনে শিল্পীর প্রজ্ঞায়।
তুমিও দেখেছ
রাত্রির মুকুরে ভাসে অগণন তারার বিস্ময়;
হৃদয়ের হ্রদে নীল তারা
জলের শয্যায় শুয়ে দেখে কত স্বপ্ন অলৌকিক।
আমরা দু’জন সেই স্বপ্নের মেদুর
অংশ হয়ে নিয়েছি প্রাণের উন্মীলনে
জীবনের দান-আর এ বাগান আজও
মুঞ্জরিত, আজও।
এখানে বাগানে
আমার প্রভাত হয়, রাত্রি নামে, উৎসারিত কথা
হৃদয়ের সোনালি রুপালি
মাছ হয়ে ভাসে আর বসন্তের আরক্ত প্রস্তাবে
প্রজ্বলিত, উন্মোচিত তুমি।
বাগানে আবার ঐ বর্ষার সঙ্গীত
সমস্ত সত্তায় আনে অপরূপ শ্যামল আবেগ।
জ্যোৎস্নার লাবণ্যে আর রৌদ্রের স্বতন্ত্র মহিমায়
তুমি তন্বী গাছের বিন্যাসে আছ এই
বাগানে আমার গানে গানে
জীবনের দানে উল্লসিত।
এবং তোমার প্রাণ প্রতিটি ফুলের
উন্মোচনে শিহরিত আর
উত্তপ্ত তামার মতো বাস্তবের পরিধি পেরিয়ে
অভীপ্সা তোমার প্রসারিত, মনে হয়,
সম্পূর্ণ অজ্ঞাত কোনো জীবনের দিকে
যে-জীবন পৃথিবীর প্রথম দিনের
মতোই বিস্মিত চোখ রাখে
আগন্তুক ভবিষ্যের চোখে
অথবা প্রেমের মতো উজ্জ্বল সাহসে
ভাঙা-চোরা পথে,
আবর্তে আবর্তে খোঁজে চির-অচেনাকে,
এমনকি হাত রাখে নিশ্চিন্তে অকল্যাণের হাতে।
যখন জীবনে সেই বাগানের সঞ্চারী সুরভি
ধ্রুপদী গানের মতো, সন্ধ্যার ধূপের মতো অর্পিত আবেগে
করে স্তব ঈপ্সিতের, সেই ক্ষণে তোমাকেই খুঁজি
বাগানের মধুর উপমা
তোমার অস্তিত্বে সুরভিত
আজীবন আমি।