দিন রাত্রি
প্রতিদিন ভোরবেলা ঘুম ভাঙে, চেনা পৃথিবীর
রূপ ভেসে ওঠে পুনরায়, দেখি কিছু পাখি
জমায় সুরেলা আড্ডা, একজন বেড়াল একাকী
উঠোন পেরিয়ে যায়- ভোরের সৌন্দর্য কী নিবিড়
মনে হয়। দুপুর কাচের মতে চকচকে, ভিড়
বাড়ে জনপথে, চিল সুনীল চক্কর কাটে, ডাকি
মনে-মনে তাকে, যার জন্যে সদা প্রতীক্ষায় থাকি,
বিকেলও মধুর আর অপরূপ সন্ধ্যার শিশির।
প্রসিদ্ধ দিনের শোভা, তবু আমি গাঢ় নিশীথের
গান গাই, এবং অপেক্ষা করি সেই প্রহরের
যখন গভীর হয় রাত, নিদ্রার গহন চোখ
বুজে আসে, কেননা তখনই শ্রান্ত সত্তায় আমার
ঘুমের পাপড়ি জ্বলে, স্বপ্ন দেখি ভুলে দুঃখ শোক;
সে স্বপ্নে তুমিই দীপ এবং মদির দীপাধার।
দৃশ্যাবলী
প্রতিদিন কত কিছু চোখে পড়েঃ পথঘাট, যান,
এবং দোকানপাট, ঝকঝকে, মানুষের ভিড়,
রেস্তোরাঁ, শ্যামল পার্ক, নৌকোময় শান্ত নদীতীর
চিড়িয়খানার বন্দী পশুপাখী, পুরোনো অর্গান।
পথে কৃষ্ণচূড়ার বিদ্রোহ, একজন বর্ষীয়ান
নিঃশব্দে পোহান স্মৃতি, তাঁর গলকস্বলের ভাঁজে
চুমু খায় ভোরবেলা; বেহালাবাদক মাঝে মাঝে
দেখা দেয়, নোংরা গলিটাও হয়ে ওঠে ঐকতান।
দৃশ্যে পরেও দৃশ্য, ভিন্ন ভিন্ন, কেমন সুদূর
অগোচরে থেকে যায়। কল্পনায় জাগে দীপাবলি,
খৃষ্টপূর্ব কোনো কুমারীর হস্তধৃত পদ্মকলি,
মায়াবী মানস হংস, সরোবর; বিপুল বৈভবে
জেগে ওঠে সামান্যের অবয়ব কখনো বা, তবে
হে মেয়ে তোমাকে স্বপ্নে দেখাটাই সবচে মধুর।
দোরগোড়া থেকে
আমিতো স্বর্গের দীপ্ত দোরগাড়া থেকে ফিরে যাই,
ফিরে যাই বারবার এবং আমার পুণ্যফল
শূন্য বলে চতুর্দিক থেকে ক্ষিপ্ত প্রেতের দঙ্গল
তেড়ে আসে হৈ-হৈ, বলে সমস্বরে, তোর নেই ঠাঁই
অমরায়, তুই যা গন্ধুকে, আগুনের বাজখাই
আঁচ তোকে নিত্য দগ্ধ করুক, তুই যা। বেদখল
হয়েছে আমার মরুদ্যান আর এখন সম্বল
শুধু আত্মাভস্মকারী তৃষ্ণা, প্রতারক রোশনাই।
হাঁটছি তামাটে পথে, পথ দীর্ঘ মনে হয়,
মনে হয় মাঝে-মাঝে বৃষ্টি নামে, শুষ্ক ওষ্ঠে ঝরে
উৎফুল্ল স্বেহার্দ্রে বিন্দু, পর মুহূর্তেই পথময়
রৌদ্রের বৃশ্চিক ক্রীড়াপরায়ণ, ধু ধু অন্ধকার
দেখি চরাচরে, দেখি কোথাও দরজা নেই, তার
অমন পুষ্পিত অবয়ব চলে যায় অগোচরে।
দ্বিতীয় যৌবন
তোমার যোগ্য কি আমি? এখন আমার দিকে চোখ
রেখে ভালো করে দ্যাখো, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দ্যাখো এই
আমাকে নবীনা তুমি। আমার সত্তায় আর নেই
প্রখর বৈভব প্রৌঢ়ত্বের তাম্রছায়া প্রায় শোক
হ’য়ে ঝুলে থাকে ত্বকে। আমি সেই জুয়াড়ী যে তার
সর্বস্ব খুইয়ে বসে আছে একা। অথচ এখন
সহস্র নক্ষত্র-জ্বলা অনাবিল তোমার যৌবন।
আমার সত্তায় স্পষ্টাঙ্কিত রহস্যের অন্তঃসার।
আমার কিছুই নেই, না প্রতাপ, না বৈভব। শুধু
এই আধপেটা জীবনের ছকে বেয়াড়া সন্ত্রাসে
অপটু অভিনেতার মতো আওড়াই কী যে ভুল
শব্দ এলোমেলো, বস্তুত কিছুই নয় অনুকূল-
তবুও তোমার স্পর্শে জেগে ওঠে আমার এ ধু ধু,
জীবনে দ্বীপের মতো দ্বিতীয় যৌবন জয়োল্লাসে।
দ্বীপ
হঠাৎ আমার ভেলা ডুবে গেলো খর চোরাটানে
ভর সন্ধ্যাবেলা আর সাঁতারে অপটু আমি ঘোলা
জলের নিমর্ম পাকে জড়াতে জড়াতে অনবোলা
অসহায় প্রাণীর মতন ডুবি, ভাসি, কোন্ খানে
কোন্ নিরুদ্দেশে একা যাবো ভেসে অন্তিমে কে জানে।
হতিমধ্যে চতুর্দিকে থেকে ক্রুর হাঙর, হা-খোলা,
আসছে তুমুল ছুটে, হায় অচিরাৎ রক্তে গোলা
হবে জলস্রোত, চোখ বুজি; মরণ বল্লম হানে।
কী আশ্চর্য, এ কোথায় অক্ষত শরীরে দৈববলে
শুয়ে আছি অপরাহ্নে হাত-পা ছড়িয়ে শূন্য তীরে
এ কোন শ্যামল দ্বীপে? কাষ্ঠখন্ড আঁকড়ে কৌশলে
আমি কি এসেছি ভেসে? চিতার চোখের মতো চাঁদ
জ্বলে দূর আসমানে, তাহলে এসেছো তুমি ফিরে?
তুমিই জাগর দ্বীপে? করেছো হরণ অবসাদ?
নান্দনিক সত্যের পাঁচালি
এখনো উনিশ বিশ বছর আগের দ্বিপ্রহর
স্মৃতির উদাস পথে ডেকে যায় সেলুলয়েডের
মমতায়; দৃষ্টিপথে একটি প্রকৃত গ্রাম হয়
আমার নিজস্ব চেনা আরেক পল্লীর সহোদর।
সেই কবেকার উপন্যাস ভিন্ন মাত্রা পায়, দেখি
গ্রামেপথে ওরা দুটি বালক বালিকা ছোটাছুটি
করে, ঘোরে কাশবনে, গহন বর্ষার ভেজে আর
শ্যামল মাটিতে কান পেতে শোনে ট্রেনের আওয়াজ।
খদ্ধ সেলুলয়েডের সীমানা পেরিয়ে দুর্গা, অপু
খেলা করে চেতনার নীলিমায়। মিষ্টি-অলা, ভেপু
এবং পুঁতির মালা, মাটির দেয়ালে দিদিমার
রূপকথা-বলা ছায়া কী প্রগাঢ় সত্যজিৎ রূপে
মনের নানান স্তরে জেগে থাকে। ধন্যবাদ তাঁকে,
এখনো শোনান যিনি নান্দনিক সত্যের পাঁচালি।
নিজের বিষয়ে
নিজের বিষয়ে আমি কস্মিনকালেও খুব বেশি
ভাবি না, বিশ্বাস করো। মাঝে-মধ্যে ভাবি এ জীবন
চাকরিত্বে অন্তরীণ, ভীষণ নাছোড় অনটন
সর্বক্ষণ, যদিও ধনিক সংঘে কিছু ঘেঁষাঘেঁষি
করি, আর নিজেরই সংসারে অনবোলা পরদেশী
হয়ে থাকি, শ্যামলিম মফস্বলে কবি-সম্মেলন
হলে যাই কালেভদ্রে, মনে পড়ে আমার এ মন
কেড়েছিলো সে কখন নবীনা সুস্মিতা এলোকেশী।
অকুন্ঠ কবুল করি, আমার জীবনে নেই কোনো
রঙিন চমক কিংবা বীরোচিত কর্মযোগ, শোভা
নেই অসামান্য, তবে আমার দর্পণে ভেসে ওঠে
অসুখী করুণ বিদূষক আর কখনো সখনো
আমার নিমগ্ন সত্তা অন্ধকারে খুনীর বাহবা
পেয়ে যায়, মাঝে মাঝে সন্তের ভঙ্গিও কিছু ফোটে।